ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

ড. আর এম দেবনাথ

২০১৬ সাল কেমন গেল, ২০১৭ সাল কেমন হবে?

প্রকাশিত: ০৬:২৩, ৩০ ডিসেম্বর ২০১৬

২০১৬ সাল কেমন গেল, ২০১৭ সাল কেমন হবে?

আজ শুক্রবার, ৩০ ডিসেম্বর। বাংলা পৌষ মাসের ষোলো তারিখ। শীতের কোন আলামতই নেই। অথচ আগামীকাল শেষ হচ্ছে ২০১৬ ইংরেজী বছর। রবিবার শুরু হবে ইংরেজী নববর্ষ। ভিন্নার্থে সরকারী অর্থবছরের শেষ ছয় মাস শুরু হবে রবিবার। এমন দিনে সবার মনেই প্রশ্ন কেমন হবে ২০১৭ সাল। এর সঙ্গে জড়িয়েই প্রশ্ন ২০১৬ সালটি কেমন গেল। এই প্রশ্নের দুটো অংশ আছে- এক রাজনৈতিকভাবে কেমন ছিল বছরটি অথবা সামাজিকভাবে কেমন গেল বছরটি। আমার আলোচ্য বিষয় রাজনৈতিক অবস্থা নয়। দেখা দরকার ২০১৬ সালটি অর্থনৈতিকভাবে কেমন গেল। এই প্রশ্নের উত্তরে প্রথমেই বলতে হয় বছরটি মোটামুটি স্থিতিশীলই গেছে, যদিও মাঝামাঝি সময়ে গুলশানের হলি আর্টিজানের দুর্ঘটনা দারুণ দুর্ভাবনায় ফেলেছিল সবাইকে। বলতেই হবে সরকারের শক্ত ও আপোসহীন অবস্থানের কারণে সন্ত্রাস বড় বেশি মাথা তুলে দাঁড়াতে পারেনি। অঙ্কুরেই অস্থিতিশীলতার লক্ষণ নির্মূল করা হয় এবং তারপর থেকে সামাজিক ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বিরাজমান ছিল। আলোচ্য বছরে একটা বড় ঘটনা ঘটেছে বেতন-ভাতার ক্ষেত্রে। বেতন-ভাতা সবার বৃদ্ধি পেয়েছে এবং তার পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন করা হয়েছে। আশঙ্কা ছিল এতে মূল্যস্ফীতি বাড়বে, জনগণের দুর্ভোগ বাড়বে। কারণ বাজারে টাকার প্রবাহ বেশি, অথচ পণ্য সরবরাহ প্রায় সমান। এরপরও বলতে হয় মূল্যস্ফীতির কোন অবনতি ঘটেনি। সরকারী হিসাবে ২০১৪ ও ২০১৫ সালের তুলনায় মূল্যস্ফীতির হার ছিল কম। বছরের শেষের দিকে সামান্য একটু বেড়ে নবেম্বর মাসে মূল্যস্ফীতির হার ৫ দশমিক ৩৮ শতাংশে স্থিতি লাভ করে। বলা যায়, এই বিচারে জনগণের দুর্ভোগ যেভাবে বাড়ার কথা ছিল সেভাবে বাড়েনি। এর কারণ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে ছিল আন্তর্জাতিক বাজারে জিনিসপত্রের দাম কম থাকার জন্য এবং দেশীয়ভাবে কারণ ছিল নিয়ন্ত্রিত ঋণ প্রবাহ। ব্যাংকে ব্যাংকে টাকার পাহাড় ছিল, যাকে বলা হয় অতিরিক্ত ‘লিক্যুইডিটি’। কিন্তু ঋণ প্রবাহ মাত্রার বাইরে যায়নি। ফলে মূল্য বৃদ্ধি ঘটতে পারে এমন ঘটনা ঘটেনি। অনুধাবনের বিষয়, বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভে উল্লম্ফন ঘটার পরেও মূল্যস্ফীতিতে কোন কুপ্রভাব পড়েনি। সর্বশেষ হিসাবে দেখা যাচ্ছে রিজার্ভের পরিমাণ হচ্ছে ৩২ বিলিয়ন (এক হাজার মিলিয়ন সমান এক বিলিয়ন) ডলার, যা দিয়ে ৮-৯ মাসের পণ্য আমদানি সম্ভব। এই প্রসঙ্গেই বলতে হয় ডলারের দাম সারা বছরই মোটামুটি স্থিতিশীল ছিল। এর মূল্য ৮১-৮২ টাকার মধ্যেই ঘোরাফেরা করে। অবশ্য ডিসেম্বরের দিকে একটু বাড়ে এবং তা কার্ব মার্কেটে। তাও ভারতে ৫০০ এবং ১০০০ রুপীর নোট বাতিলের কারণে। অবশ্য আরেকটি কারণও কার্যকর হচ্ছে। আমাদের রেমিটেন্সের পরিমাণ বছরব্যাপী চাপের মধ্যে ছিল। ২০১৬ সালের নবেম্বরে রেমিটেন্সের পরিমাণ ছিল মাত্র ৯৫ কোটি ডলার, যা এ বছরে ছিল সর্বনিম্ন। এটা আমাদের জন্য খারাপ খবর। কারণ রেমিটেন্স আমাদের অর্থনীতির জন্য দুই স্তম্ভের এক স্তম্ভ। শ্রমবাজারে অব্যাহত মন্দা, তেলের দাম হ্রাস, প্রবাসীদের মজুরিতে ট্যাক্স, খোলাবাজারে ডলারের অধিকতর মূল্য হেতু ‘হুন্ডির’ প্রবণতা বৃদ্ধিকে রেমিটেন্স হ্রাসের কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়। আশার কথা রেমিটেন্সে হ্রাসমান প্রবণতা অব্যাহত থাকলেও রফতানিতে অর্থনীতি ভাল করেছে ২০১৬ সালে। রফতানি আয় ছিল বেশ স্থিতিশীল এবং উর্ধমুখী, যদিও লক্ষ্যমাত্রানুযায়ী রফতানি আয় বাড়ছে না। বছরের শুরুতে রফতানি স্থিতিশীল থেকে বছরের শেষে তা বেশ কিছুটা বাড়ে। অক্টোবর ও নবেম্বর মাসে রফতানির পরিমাণ ছিল ২ দশমিক ৭১ এবং ২ দশমিক ৮৯ বিলিয়ন ডলার। এদিকে আমদানির পরিমাণও বাড়ছে। শুধু নবেম্বরের পরিসংখ্যান দিয়েই বলা যায় আমদানি পরিস্থিতি ভাল ছিল ২০১৬ সালে। ২০১৪ সালের নবেম্বরে আমদানির পরিমাণ ছিল ৩ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলার। ২০১৫ সালের নবেম্বরে এর পরিমাণ ছিল ৩ দশমিক ২০ বিলিয়ন ডলার। ২০১৬ সালের একই মাসে আমদানির পরিমাণ বেড়ে হয় ৩ দশমিক ৭৭ বিলিয়ন ডলার। সবচেয়ে আশার কথা হচ্ছে মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানির পরিমাণ ২০১৬ সালে বেড়েছে। অবশ্য বেসরকারী খাতে ঋণ প্রবাহ সেভাবে বাড়ছে না। এমতাবস্থায় বলা হচ্ছে সরকারের মেগা প্রকল্পগুলোর আমদানি বেড়েছে অর্থাৎ ওইসব প্রকল্পের মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানি বেড়েছে। এটা ভাল লক্ষণ। বেসরকারী খাতে বিনিয়োগ নিয়ে বেশ দুশ্চিন্তা পরিলক্ষিত হচ্ছে। বিক্রমপুরে চীনের ব্যবসায়ীদের আর্থিক সহায়তায় ‘গার্মেন্টস পল্লী’ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু জমির উচ্চমূল্যের কারণে ওই প্রকল্প বাতিল ঘোষণা করা হয়েছে। এছাড়া বেসরকারী খাতে নতুনভাবে কোম্পানিও আসছে না। ২০১৫ সালে বাজার থেকে শেয়ার বিক্রি করে পুঁজি সংগ্রহ করা হয়েছিল ৬৭৫ কোটি টাকা। ২০১৬ সালে মাত্র ৮টি কোম্পানি ৬৫৯ কোটি টাকা শেয়ারবাজার থেকে সংগ্রহ করে। এর থেকে দেখা যায় নতুন কোম্পানি বাজারে আসছে কম। পুরনো কোম্পানিগুলো বাজার থেকে সেভাবে পুঁজি তুলছে না, যার অর্থ বেসরকারী বিনিয়োগে একটা স্থবিরতা দেখা দিয়েছে। অবশ্য এই স্থবিরতা কিছুটা কাটিয়ে তোলা হচ্ছে সরকারী বিনিয়োগ দিয়ে। উল্লেখ্য, শুধু বিনিয়োগ নয়, সঞ্চয়ের ক্ষেত্রেও আমরা অনেক পিছিয়ে আছি। বিগত এক দশক যাবত বাংলাদেশে সঞ্চয় পরিস্থিতিতে স্থবিরতা চলছে। এর থেকে পরিত্রাণের কোন লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। অবশ্য এরই মধ্যে ভাল, খুবই ভাল একটা লক্ষণ পরিলক্ষিত হয়েছে ২০১৬ সালে। চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিংপিং বাংলাদেশ সফর করে গেলেন। যে চীন বাংলাদেশে শুধু বাণিজ্য করে, রফতানি করে দীর্ঘদিন যাবত সেই চীন দীর্ঘদিন বিনিয়োগের অঙ্গীকার করেছে। প্রায় ৪২ বিলিয়ন ডলারের প্রস্তাব, যার মধ্যে আছে চীনা ঋণ ও বিনিয়োগ। অবশ্য এখনও জানা যায়নি এর মধ্যে কতটুকু ঋণ এবং কতটুকু বিনিয়োগ। চীনা বিনিয়োগ যদি সত্যি সত্যি আসে তাহলে বাংলাদেশে একটা বড় রকমের পরিবর্তন হবে। বিশ্বব্যাংকও ২০১৬ সালে নতুন ঋণ প্রস্তাবের অঙ্গীকার করেছে। করেছেন স্বয়ং বিশ্বব্যাংক প্রেসিডেন্ট, যিনি জিংপিংয়ের পরপরই ঢাকা সফর করে গেছেন। ২০১৬ সালে বিশ্ববাজারে স্বর্ণের দাম যেমন হ্রাস পেয়েছে, তেমনি বাংলাদেশের বাজারেও হ্রাস পেয়েছে। অবশ্য বছরের শেষের দিকে ডলারের দাম বাড়তে শুরু করে। ডলার ও স্বর্ণের দাম ওতপ্রোতভাবে জড়িত। এই দুইয়ের দামের নিরিখে অর্থনীতির শক্তি যাচাই করা যায়। এই বছরেই একটা বড় দুর্ঘটনা ঘটে ব্যাংকিং খাতে। আই-এর শত কোটি টাকা ‘হ্যাকিং’ করে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে চুরি করে নেয় দুর্বৃত্তরা। এর দ্বারা প্রমাণিত হয় বাংলাদেশের ব্যাংকগুলো কম্পিউটারায়নের ক্ষেত্রে বেশ অরক্ষিত। সুরক্ষার অভাবে ভুগছে ব্যাংকিং জগত। ২০১৬ সালে ব্যাংকিং খাতে শ্রেণীবিন্যাসিত ঋণের পরিমাণ বেশ বেড়েছে। বস্তুত সারা বছরই ‘ক্লাসিফাইড লোন’ ছিল একটা বড় আলোচিত বিষয়। এদিকে ঋণের ক্ষেত্রে দেখা যায় ২০১৬ সালে কৃষিঋণ বিতরণের পরিমাণ বেশ বেড়েছে। ২০১৫ সালের নবেম্বরে কৃষিঋণ বিতরণের পরিমাণ ছিল ৬১৬৬ কোটি টাকা। সেইস্থলে ২০১৬ সালের নবেম্বরে কৃষিঋণের পরিমাণ ছিল ৭৫৭১ কোটি টাকা। সার্বিক অবস্থা বিবেচনা করে বলা হচ্ছে সরকারের ‘জিডিপি’ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা বছর শেষে অর্জিত হবে। উল্লেখ্য, ২০১৬ সালেই বাংলাদেশ প্রবৃদ্ধির ক্ষেত্রে একটা মাইলফলক অর্জন করেছে। সাত শতাংশের উর্ধে প্রবৃদ্ধির হার অর্জিত হয়। এই হার ২০১৬-১৭ অর্থবছরে আবারও অর্জিত হবে বলে আশা করা যায়। এই প্রেক্ষাপটে ২০১৭ সাল কেমন যাবে বলে মনে হয়। ধারণা করা হচ্ছে বিশ্ব অর্থনীতি ২০১৭ সালে ৩ দশমিক ২ শতাংশ হারে বৃদ্ধি পাবে। তবে একটা কথা বলা দরকার। দেশীয় ক্ষেত্রে আমাদের অর্থনীতিতে যাই ঘটুক না কেন, ২০১৬ সালে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে কতগুলো ঘটনা ঘটে গেছে। যার প্রভাব হবে সুদূরপ্রসারী। ২০১৬ সালে ‘গ্রেট ব্রিটেন’ ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে গেছে। এই সালেই সারা দুনিয়াকে বিস্মিত করে মার্কিন নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন। সিরিয়া, ফিলিফিন্স, হাঙ্গেরী, পোল্যান্ড ইত্যাদি দেশের ঘটনা এবং সারা বিশ্বের হাবভাব দেখে মনে হচ্ছে বিশ্ব একটা ‘ক্রসরোডে’ দাঁড়িয়ে। বিশ্বায়ন ও অবাধ বাণিজ্য প্রশ্নের মুখে। মার্কিনীরা মনে করছে তাদের অধোগতির জন্য বিশ্বায়ন দায়ী। দেশে দেশে মানুষের অবাধ গমনাগমন প্রশ্নের মুখে; অভিবাসন প্রশ্নের মুখে, ‘ফ্রিডম’ প্রশ্নের মুখে। ‘আইডিয়া’র অবাধ বিনিময় প্রশ্নের মুখে। বিশ্বায়নে উপকৃত কোন কোন দেশ আগ্রাসী ভূমিকায় অবতীর্ণ। বিশ্বায়ন বৈষম্য তৈরি করেছে। পৃথিবীর ধনসম্পদ এক শতাংশ লোকের হাতে। বিশ্ব আজ একটি বড় কোম্পানিতে পরিণত হয়েছে। এসব কথা আজ আমেরিকাতেই বলা হচ্ছে। ট্রাম্প বলছেন তিনি আমেরিকার আমদানির ওপর বিভিন্ন হারে কর বসাবেন। এটি হলে বাংলাদেশসহ পৃথিবীর অনেক দেশের রফতানি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। ক্ষতিগ্রস্ত হবে বিশ্বের ফ্যাক্টরি বলে পরিচিত চীনের অর্থনীতিও। চীনের অর্থনীতি দুনিয়ার দুই নম্বর অর্থনীতি। ক্ষতিগ্রস্ত হবে ভারতের অর্থনীতিও। এতে বাংলাদেশের অর্থনীতি কী ঠিক থাকতে পারবে? তাই ২০১৭ সালটি এ প্রেক্ষাপটে একটা অনিশ্চয়তার মধ্যে বিশ্বকে ফেলে দিতে পারে। লেখক : সাবেক শিক্ষক, ঢাবি
×