ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

২৫ বছর ধরে নির্বাচনে ইস্যু হয়ে থাকলেও এখনও নির্মিত হয়নি

‘শীতলক্ষ্যা সেতু’ এবারও মুখ্য ইস্যু

প্রকাশিত: ০৫:৫৬, ১৭ ডিসেম্বর ২০১৬

‘শীতলক্ষ্যা সেতু’ এবারও মুখ্য ইস্যু

স্টাফ রিপোর্টার ॥ ২৫ বছর ধরেই নারায়ণগঞ্জের ‘শীতলক্ষ্যা সেতু’ নির্বাচনী ইস্যু হয়ে আছে। ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপিত হলেও আজ পর্যন্ত কাজ শুরু হয়নি নারায়ণগঞ্জ শহর ও বন্দর এলাকার বাসিন্দাদের এ দাবির। আগামী ২২ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিতব্য নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনকে সামনে রেখেও ‘শীতলক্ষ্যা সেতু’ ইস্যুটি মুখ্য হয়ে উঠেছে। জানা যায়, ১৯৯১ সাল থেকে সংসদ নির্বাচনগুলোতে নারায়ণগঞ্জ-৫ (শহর ও বন্দর) আসনের প্রার্থীরা নির্বাচনী প্রচারে শীতলক্ষ্যা নদীর ওপর সেতু নির্মাণের আশ্বাস দিয়ে আসছেন। এবারের সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনেও রাজনৈতিক দলের নেতারা বিভিন্ন উন্নয়নের ইস্যু সামনে আনলেও হালে এই ইস্যুটিই বড় হয়ে উঠেছে। এ নিয়ে প্রধান দুই মেয়র প্রার্থীর মধ্যে আক্রমণ, পাল্টা আক্রমণও চলছে। আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী সেলিনা হায়াত আইভী, যিনি ১৩ বছর ধরে বিলুপ্ত পৌরসভা ও সিটি কর্পোরেশনের মেয়র ছিলেন, তিনিসহ বিএনপির প্রার্থী সাখাওয়াত হোসেন খানও মেয়র নির্বাচিত হতে পারলে এই সেতু নির্মাণের আশ্বাস দিয়েছেন। সম্প্রতি তাদের নির্বাচনী প্রচারে সেতুর বিষয়টি মুখ্য হয়ে উঠেছে। কিন্তু ২৫ বছরেও সেই সেতু নির্মাণ হয়নি। নারায়ণগঞ্জের বন্দর উপজেলা প্রশাসনের ওয়েব পোর্টাল থেকে জানা যায়, উপজেলাটির মোট জনসংখ্যা ৩ লাখ ১২ হাজার ৮৪১ । এর মধ্যে পুরুষ ১ লাখ ৫৮ হাজার ৯৪১ ও নারী ১ লাখ ৫৪ হাজার ৩৫০। এদিকে নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের আওতাধীন বন্দর এলাকার ৯টি ওয়ার্ডের মোট ভোটার ১ লাখ ১৩ হাজার ২৮৩। যার মধ্যে পুরুষ ৫৬ হাজার ৬০২ ও নারী ৫৬ হাজার ৬৮১। শীতলক্ষ্যা সেতু নিয়ে শহর ও বন্দরবাসীর মনে দীর্ঘদিন ধরে ক্ষোভ বিরাজ করছে। বন্দরের সাবদি এলাকার বাসিন্দা মামুন হোসেন জানান, তিনি পরিবার-পরিজন নিয়ে পৈতৃক ভিটাতেই বসবাস করেন। প্রতিদিন মোটরসাইকেলে নারায়ণগঞ্জ শহরে তিনি আসা-যাওয়া করেন। বেশ আক্ষেপ করেই বললেন, বাড়ি থেকে নৌকার ঘাটে আসতে সময় লাগে ১৫ মিনিট, আর মোটরসাইকেল কষ্ট করে নৌকায় তুলে নদী পার হতে সময় দিতে হয় কমপক্ষে আধা ঘণ্টা। যেতেও হয় একইভাবে। যদি একটা সেতু থাকত...। বন্দরের আফাজনগরে কিছুদিন আগে জায়গা কিনেছিলেন ঢাকার গুলশানের একটি প্রতিষ্ঠানের চাকরিজীবী আহমেদুল হক। তার খুব শখ, একটি ছোট গাড়িতে চড়ে সেতু পার হয়ে যাতায়াত করবেন। কারণ শীতলক্ষ্যার ওপর সেতু হবে। প্রধানমন্ত্রী ইতোমধ্যে সেখানে ভিত্তিপ্রস্তরও স্থাপন করেছেন। কিন্তু সেই সেতু তৈরির কোন লক্ষণ না দেখে তিনি ভীষণ হতাশ। আহমেদুল হক বলেন, কয়েকদিন আগে স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে নৌকা পার হওয়ার সময় বালুবাহী বাল্কহেড আর কার্গোর বেপরোয়া চলাচল দেখে আমরা ভয় পেয়েছিলাম। পরে শুনেছি, এ নদীতে প্রায়ই দুর্ঘটনা ঘটে। তবু জীবিকার প্রয়োজনে ঝুঁকি নিয়েই নদী পার হতে হয়। ১৯৯১ সালে ৫ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বন্দরবাসীকে শীতলক্ষ্যা সেতুর প্রতিশ্রুতি দিয়ে নির্বাচনী বৈতরণী পার হন বিএনপির সাবেক এমপি এ্যাডভোকেট আবুল কালাম। তবে তিনি প্রতিশ্রুতির কোন বাস্তবায়ন করতে পারেননি। ১৯৯৬ সালের জুনে অনুষ্ঠিত ৭ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও একই ধরনের প্রতিশ্রুতি দিয়ে আওয়ামী লীগ থেকে এমপি নির্বাচিত হন এসএম আকরাম। তবে তিনিও কিছুই করতে পারেননি। বিগত বিএনপি সরকারের শেষের দিকে সেতু নির্মাণের কোন সম্ভাব্যতা যাচাই ও ফান্ড যোগাড় না করেই ২০০৬ সালের ৮ অক্টোবর ওই সময়ের প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া শহরের নবীগঞ্জ খেয়াঘাট এলাকায় সেতুর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করলেও সেটা ছিল নিছক নির্বাচনী প্রচার। ২০০৮ সালের সংসদ নির্বাচনের আগে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদও সেতুর আশ্বাস দিয়েছিলেন। ২৯ ডিসেম্বর সংসদ নির্বাচনের পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বন্দরের মদনগঞ্জে সমাবেশ করে দ্রুত সেতু নির্মাণের ঘোষণা দেন। নানা প্রতিকূলতার পর ২০১১ সালে সেতু নির্মাণের জন্য পরিকল্পনার চূড়ান্ত অনুমোদন দেয় একনেক। সর্বশেষ খবর হলো, গত বছরের ১৪ ফেব্রুয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে শীতলক্ষ্যা সেতুর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। তখন জানানো হয়, এই সেতুর নির্মাণ ব্যয় ধরা হয়েছে ৩৭৭ কোটি ৬৩ লাখ টাকা। সৌদি ফান্ড ফর ডেভেলপমেন্টের অর্থায়নে এটি বাস্তবায়ন করবে বাংলাদেশ সরকারের সড়ক ও জনপথ (সওজ) অধিদফতর। চারটি লেনে ১৫ মিটার চওড়ায় ৩৫ স্প্যানবিশিষ্ট সেতুর দৈর্ঘ্য হবে ১ হাজার ২৯০ মিটার। শীতলক্ষ্যা সেতু নির্মাণ প্রকল্পের মেয়াদ ছিল ২০১৪ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত। সেতু নির্মাণের জন্য ইতোমধ্যে ৬২ দাগে ৩০ জমির মালিকের ১০ দশমিক ৩ একর জায়গা অধিগ্রহণ করা হয়েছে। ওইসব জমি মালিকদের অধিগ্রহণের মূল্য হিসেবে গত বছরের ২২ নবেম্বর ১৫ কোটি ৭৯ লাখ ৬৫ হাজার ৫৬০ টাকার চেক দিয়েছে সরকার। তবে সেতু নির্মাণে ঠিকাদার নিয়োগ এখনও চূড়ান্ত হয়নি। যদিও এরই মধ্যে এক দফা মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে প্রকল্পটির। সম্প্রতি প্রকল্পটির মেয়াদ বাড়ানোর জন্য একটি চিঠি সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগে পাঠিয়েছেন সওজের প্রধান প্রকৌশলী। সওজের প্রধান প্রকৌশলী ইবনে আলম হাসান জানান, সেতু নির্মাণে ঠিকাদার নিয়োগ প্রক্রিয়া চলছে। শীঘ্রই ঠিকাদার চূড়ান্ত করা হবে। তবে সেতুটি নির্মাণে প্রায় তিন বছর লাগবে। এজন্য প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। গত ২৩ জুলাই পরিকল্পনামন্ত্রী আ হ ম মোস্তফা কামাল বন্দর খেয়াঘাট এলাকা সরেজমিন ঘুরে নদী পারাপার হওয়া যাত্রীদের সঙ্গে কথা বলেন। তখন তিনি লাখো যাত্রীর দুর্ভোগ লাঘবের জন্য বন্দর খেয়াঘাট দিয়ে একটি ফুটওভার ব্রিজ ও নবীগঞ্জ খেয়াঘাটে একটি পূর্ণাঙ্গ ব্রিজ নির্মাণের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। তার পরিপ্রেক্ষিতে ১১ আগস্ট সংসদ সদস্য সেলিম ওসমানের সঙ্গে সভা চলাকালে মন্ত্রী তাৎক্ষণিকভাবে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের প্রধান প্রকৌশলীকে বন্দর খেয়াঘাটে ফুটওভার ব্রিজ ও নবীগঞ্জ খেয়াঘাটে একটি পূর্ণাঙ্গ ব্রিজ নির্মাণের ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দেন। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি। সরকার যখন শহরতলির সৈয়দপুর ও বন্দরের মদনগঞ্জ পয়েন্টে তৃতীয় শীতলক্ষ্যা সেতু নির্মাণের তোড়জোড় করছিল তখন ২০১৩ সালের ২০ জুলাই জাইকার ১০ সদস্যের একটি টিমও শহরের ৫নং ঘাট ও নবীগঞ্জ এলাকায় শীতলক্ষ্যা নদীর ওপর সেতু নির্মাণের সম্ভাব্যতা যাচাইয়ে পরিদর্শনে আসেন। তখন সেলিনা হায়াত আইভী বলেছিলেন, শীতলক্ষ্যা নদীতে একটি ব্রিজ নির্মাণের বিষয়ে জাইকা কমিটমেন্ট করেছে। তারা আগামী দু-তিন বছরের মধ্যেই শীতলক্ষ্যা সেতু নির্মাণের বিষয়ে কাজ শুরু করবে। সম্প্রতি শহরের ১২ নং ওয়ার্ডের ইসদাইর উত্তর চাষাঢ়ায় গণসংযোগের সময়ে আইভী শীতলক্ষ্যা সেতু প্রসঙ্গে বলেন, শীতলক্ষ্যার উওর সেতু করে দেব এ ধরনের কোন প্রতিশ্রুতি আমি কখনও দেইনি। তবে সেতু নির্মাণের জন্য ৫ বছর অনেক চেষ্টা করেছি। এ সেতু নির্মাণের প্রক্রিয়া অনেকদূর এগিয়েছে। সেতুর ফাইল একনেকে যাওয়ার অপেক্ষায়। আশা করছি, প্রধানমন্ত্রী জনগণের প্রত্যাশা পূরণ করে সেতু নির্মাণ করে দেবেন। তিনি আরও বলেন, তবে কয়লাঘাট এলাকায় আরেকটি সেতু নির্মাণের পথে, যার অর্ধেকের বেশি কাজ হয়েছে। ইতোমধ্যে জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে। রাস্তা বাড়ানো হচ্ছে। আমি সিটি কর্পোরেশনের মাধ্যমে ৫নং খেয়াঘাট এলাকা দিয়ে সেতু তৈরি করতে যাচ্ছি। সেটার কাজও অনেকদূর এগিয়ে গেছে। নির্বাচন বলে আমি নারায়ণগঞ্জবাসীকে মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দিতে পারব না। তবে আমি চেষ্টা করব এ সেতুটা যেন করা যায়। একই দিন শহরের বঙ্গবন্ধু সড়কের পাশে ১৪ নং ওয়ার্ডের উকিলপাড়া এলাকায় গণসংযোগের সময়ে সাখাওয়াত হোসেন অভিযোগ করে বলেন, বিগত দিনে আইভী সেতু করতে পারেননি। এটা তার ব্যর্থতা। তবে আমি মেয়র হলে প্রথমেই এ সেতুর কাজ ধরব।
×