ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

মিলু শামস

ক্যাস্ট্রো এবং কমিউনিস্ট আন্দোলন

প্রকাশিত: ০৩:৩৮, ৩০ নভেম্বর ২০১৬

ক্যাস্ট্রো এবং কমিউনিস্ট আন্দোলন

আঠারো বছর বয়স কি দুঃসহ/ স্পর্ধায় নেয় মাথা তুলবার ঝুঁকি, আঠারো বছর বয়সেই অহরহ/ বিরাট দুঃসাহসেরা দেয় যে উঁকি।/ আঠারো বছর বয়সের নেই ভয়/ পদাঘাতে চায় ভাঙতে পাথর বাধা,/ এ বয়সে কেউ মাথা নোয়াবার নয়-/ আঠারো বছর বয়স জানে না কাঁদা। ঠিক আঠারো বছর নয় একুশ বছরে স্পর্ধায় মাথা তুলেছিলেন। তেত্রিশে দেশের মালিক জনগণকে দেশ ফিরিয়ে দিয়ে স্পর্ধায় উচ্চারণ করেছিলেন, ‘আমি বিরাশি জনকে নিয়ে বিপ্লব শুরু করি। তা যদি আমাকে আবার করতে হয়, তবে আমি দশ বা পনেরো জনকে নিয়ে করব এবং সম্পূর্ণ বিশ্বাস নিয়ে করব। সংখ্যায় আপনি কত কম, সেটা কোন বিষয় নয়, যদি আপনার বিশ্বাস ও কর্মপরিকল্পনা থাকে।’ এ দৃঢ়তা ফিদেল ক্যাস্ট্রোকেই মানায়। আঠারো বছরের স্পর্ধা নিয়েই যিনি বেঁচেছিলেন নব্বই বছর। তাঁর ঋজু শরীরের উঁচু মাথা কখনও নত হয়নি। দীর্ঘ গেরিলা যুদ্ধের পর তিনি যখন কিউবায় সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার দায়িত্ব নেন আন্তর্জাতিকভাবে সমাজতান্ত্রিক শিবিরে তখন চলছে নানা ধরনের ষড়যন্ত্র ও সংস্কার। সোভিয়েত ইউনিয়ন ও গণচীনের মধ্যে টানাপড়েন। উনিশ শ’ ছাপ্পান্ন সালে সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টির বিশতম কংগ্রেসে বৈশ্বিক ঐক্যবদ্ধ সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনে চিড় ধরার বিষয়টি স্পষ্ট হয়। বিপ্লবের যে নীতির ওপর সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টি ও রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল তা থেকে সরে ক্রুশ্চেভের সময়ে এসে সংস্কারের নামে যা দাঁড়ায় তা ছিল স্পষ্টতই সমাজতন্ত্রবিরোধী চক্রান্ত। বিশতম কংগ্রেসে ক্রশ্চেভের বক্তব্যে যা পরিষ্কার হয়। চীন এতে অস্বস্তিবোধ করলেও তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া দেখায়নি। তারা মত দিয়েছিল উনিশ শ’ একষট্টি সালের আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট সম্মেলনে। এখানেই চৌ এন লাই সোভিয়েত ইউনিয়নের সংস্কারবাদ বা সমাজতন্ত্রবিরোধী লাইন নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। এবং সোভিয়েত ও চীনের-বিরোধ প্রকাশ্য হয়। এরপর চীনা কমিউনিস্ট পার্টির পক্ষ থেকে ‘লং লিভ লেনিনিজম’ নামে দীর্ঘ এক বিবৃতি দেয়া হয়। যাতে ক্রশ্চেভের নেতৃত্বে সোভিয়েত সমাজতন্ত্রবিরোধী কার্যকলাপ এবং পার্টির সংস্কারবাদী ধারা ও চক্রান্তের স্বরূপ পুরোপুরি উন্মোচিত হয়। এরপরই কমিউনিস্ট আন্দোলনে চীন ও সোভিয়েত বিভাজন সৃষ্টি হয়। সমাজতান্ত্রিক আলবেনিয়ার নেতা আনোয়ার হোজাও সোভিয়েত সংস্কারবাদের বিরোধিতা করেছিলেন। মূলত তিনিই প্রথম এ নিয়ে কথা বলেছিলেন আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট সম্মেলনের আগে সোভিয়েতের বিশতম কংগ্রেসে। কিন্তু কমিউনিস্ট আন্দোলনে সোভিয়েত ইউনিয়ন বা চীনের মতো আলবেনিয়ার উচ্চকিত কণ্ঠ না থাকায় তা তেমন প্রভাব রাখেনি। এসব যখন হচ্ছে ফিদেল তখন নতুন কিউবা নির্মাণে ব্যস্ত। আন্তর্জাতিক ওই সম্মেলনে তিনিও হয়ত ছিলেন, কিন্তু আলবেনিয়ার মতো তার কণ্ঠও হয়ত ক্ষীণ ছিল। অবশ্য তার দীর্ঘ শাসনকালের দিকে তাকালে মনে হয়, তত্ত্ব নির্মাণের চেয়ে লেনিনের সেই বিখ্যাত উক্তি ‘বাস্তব পরিস্থিতির বাস্তব বিশ্লেষণ’কে বেশি গুরুত্ব দিয়েছিলেন। তাই তথাকথিত চীন বা সোভিয়েত পন্থার আক্ষরিক অনুগামী না হয়ে সমাজতন্ত্রের নীতি থেকে একটুও বিচ্যুত না হয়ে কিউবার জন্য তিনি নির্মাণ করেছিলেন সমাজতন্ত্রের কিউবান মডেল। পঞ্চাশ বছরের বেশি সময় ধরে যাতে সমর্থন দিয়ে গেছেন কিউবার জনগণ। তার মৃত্যুর পর একালের আঠারো বছরের তরুণের কণ্ঠে তাই দৃঢ় উচ্চারণ- ‘ফিদেলের মৃত্যু নেই, আমিই ফিদেল, আমিই কিউবা’। নয়া উদারবাদী অর্থনীতিতে ভেসে যাওয়া দুনিয়ার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় পেটের মধ্যে বাস করে এমন উত্তরসূরি রেখে যেতে পারেন যিনি তার প্রচণ্ড ব্যক্তিত্বের কাছে শুধু বাম নয়, ডানপন্থী আদর্শে বিশ্বাসীদের মাথাও শ্রদ্ধায় নত হয়। উনিশ শ’ ঊনষাটের একেবারে শুরুতে ক্ষমতায় এসেছিলেন, ছিয়াত্তর পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী, ছিয়াত্তর থেকে দু’হাজার আট- প্রেসিডেন্ট। দীর্ঘ কর্মময় জীবন। দু’শ’ আটষট্টিটি ব্যর্থ হত্যা প্রচেষ্টার পর মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থাগুলোও সম্ভবত তার বেঁচে থাকার সুতীব্র ‘জিদ’-এর কাছে হার মেনেছিল। একা নন জেনারেল বাতিস্তার আমলে না খেতে পাওয়া সাধারণ মানুষদের সঙ্গে নিয়েই বেঁচেছিলেন। ক্ষমতাধর ওই দেশটির অর্থনৈতিক অবরোধ ও নানান ষড়যন্ত্রের মুখে দাঁড়িয়ে চ্যালেঞ্জ করেছিলেন- দেশের জনগণের খাদ্য, স্বাস্থ্যসহ শিক্ষার অধিকার শতভাগ নিশ্চিত করবেন। তা তিনি করেওছিলেন। তার পূর্বসূরি লাতিন আমেরিকার মুক্তিদাতা সিমন বলিভবারও আঠারো শ’ পাঁচ সালে রোমের মাউন্ট এ্যাভোল্টনের চূড়ায় দাঁড়িয়ে শপথ করেছিলেন, যতদিন পর্যন্ত না গোটা দক্ষিণ আমেরিকা বিদেশী শাসন থেকে মুক্ত হবে ততোদিন তিনি বিশ্রাম নেবেন না। কথা রেখেছিলেন বলিভার। সশস্ত্র লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে দক্ষিণ আমেরিকার ছ’টি দেশ স্পেনের উপনিবেশ থেকে মুক্ত করেছিলেন তিনি। বলিভারের প্রতি অবিচল শ্রদ্ধা ও ভালবাসা ছিল ক্যাস্ট্রোর। এক সাক্ষাতকারে বলেছেন সে কথা- ‘ইতিহাসের সব চরিত্রের মধ্যে বলিভার এবং হোসে মার্তি আমার সবচেয়ে প্রিয়... বলিভারের প্রতি আমার যে সহমর্মিতা ইতিহাসের আর কোন চরিত্রের প্রতি ততোটা নেই।’ কিউবার কমিউনিস্ট পার্টি গঠিত হয় উনিশ শ’ একষট্টি সালে। আমৃত্যু তার সেক্রেটারি ছিলেন ক্যাস্ট্রো। অভ্যন্তরীণ ও বাইরের নানামুখী ষড়যন্ত্রে কমিউনিস্ট বিশ্বে যখন ধস নেমেছে তখনও তার আদর্শিক দৃঢ়তা টলেনি একটুও। কিউবায় যে বছর কমিউনিস্ট পার্টি গঠিত হয় সে বছরই আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলন সোভিয়েত ইউনিয়ন ও চীন দু’শিবিরে ভাগ হয়। সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলন বা যে কোন সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রকে সোভিয়েত ইউনিয়ন আন্তর্জাতিকভাবে সমর্থন ও সহায়তা দিত। সে হিসেবে যতদিন সোভিয়েত ইউনিয়ন ছিল কিউবা তার সহায়তা নিয়েছে। তবে কিউবান কমিউনিস্ট পার্টির শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে। এজন্য সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর বিধ্বস্ত হয়নি কিউবা। দিশাহারা হয়নি কিউবান কমিউনিস্ট পার্টি। আমাদের এখানে যেমন হয়েছিল। আন্তর্জাতিক বিভাজনের প্রভাবে এখানেও কমিউনিস্ট আন্দোলন ভাগ হয়েছে সোভিয়েতপন্থী, চীনপন্থী দুই শিবিরে। দেশের বাস্তব পরিস্থিতিকে গুরুত্ব দেয়ার চেয়ে এদের বেশিরভাগের কাছে বেশি গুরুত্ব পেয়েছে মস্কো ও পিকিং। এমনকি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ-বিপক্ষ প্রশ্নেও এরা প্রভাবিত হয়েছেন সমাজতন্ত্রের আন্তর্জাতিক দুই শিবিরের অবস্থান দিয়ে। সোভিয়েত ইউনিয়ন মুক্তিযুদ্ধকে সমর্থন দিয়েছিল। সুতরাং মস্কোপন্থীদের এ নিয়ে সমস্যা হয়নি। সমস্যা হয়েছিল চীনপন্থী গ্রুপগুলোর একাংশের। ইয়াহিয়া খানের সহায়তায় সে সময় চীন-মার্কিন সম্পর্ক দৃঢ় হয়েছিল এবং যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে এক হয়ে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করে পাকিস্তানকে সমর্থন দিয়েছিল। তারই অন্ধ অনুকরণে চীনপন্থীদের একটি অংশ মুক্তিযুদ্ধকে ‘দুই কুকুরের লড়াই’ আখ্যায়িত করে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছিল। এ অংশের নেতৃত্বে ছিলেন মোহাম্মদ তোয়াহা ও অন্যান্যরা। অন্য অংশটি সাম্রাজ্যবাদী যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চীনের অন্তরঙ্গতার কঠোর সমালোচনা করেছেন। বিশেষত যা গড়ে উঠেছিল ইয়াহিয়া খানের সহায়তায়। ‘দুই কুকুরের লড়াই’ তত্ত্বকে ঘৃনাভরে প্রত্যাখ্যান করে তারা যুক্ত হয়েছিলেন মুক্তিযুদ্ধে। এ অংশের নেতৃত্বে ছিলেন বদরুদ্দীন উমর। চীনপন্থি পার্টিগুলো মুক্তিযুদ্ধের সময়ই টুকরো টুকরো হয়ে প্রায় বিলুপ্ত হয়ে যায়। আর মস্কোপন্থিরা বরাবরই কাজ করেছে বুর্জোয়া বড় দলের ছত্র ছায়ায়। কোন একক কমিউনিস্ট আন্দোলন এখানে গড়ে ওঠেনি। আরও অনেক দেশে এমন দৃষ্টান্ত রয়েছে। ফিদেল ক্যাস্ট্রোর কিউবা এর ব্যতিক্রম। সেখানে সফল সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব হয়েছে এবং আন্তর্জাতিক নানান বিপর্যয়ের পরও কমিউনিস্ট পার্টি নীতিতে অটুট ও ঐক্যবদ্ধ রয়েছে। এখন ক্যাস্ট্রোর অনুপস্থিতির কিউবা কেমন হবে তা ভবিষ্যতই বলবে।
×