ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

স্বামী অবিচলানন্দ

রাসলীলা

প্রকাশিত: ০৩:৫৯, ১৫ নভেম্বর ২০১৬

রাসলীলা

রাসলীলা শ্রীকৃষ্ণের অপার্থিব লীলা। একদিন কথা প্রসঙ্গে শ্রীরামকৃষ্ণদেব বলেছিলেন- রাধাকৃষ্ণ মান আর না মান, ঐ টানটুকু লও। অর্থাৎ ভগবানের ওপর শ্রীরাধার যে তীব্র অনুরাগ ভক্তিশাস্ত্রে বর্ণিত হয়েছে, সেই অনুরাগকে জীবনের আদর্শ কর। কথাটা হচ্ছে এই যে, ভগবানকে ভালবাসতে হবে, তাঁর মাধুর্য আস্বাদন করতে হবে। গান-বাজনার সঙ্গে যদি অসংখ্য নর্তকী একজন নটের সঙ্গে ম-লাকারে নৃত্য করে, তবেই তাকে ‘রাসনৃত্য’ বলা হয়। রাসলীলা শ্রীকৃষ্ণের অপার্থিব লীলা। রাসলীলা ভগবানের অপ্রাকৃত প্রেমলীলা হলেও এতে প্রাকৃত রসের, জাগতিক স্ত্রী-পুরুষের মিলন-রসের সাদৃশ্য রয়েছে। রাসলীলা হচ্ছে মুক্তিদায়িনী, ভক্তি এবং মুক্তি রসই এই লীলার একমাত্র রস। তাই ভগবান শ্রীকৃষ্ণ রাসলীলায় গোপীদের সঙ্গে বিহার করে দেখালেন যে, অজেয় কামকে জয় করতে হলে রাসবিহারীর চরণে শরণাগতিই একমাত্র উপায়। গোপীরা তো বহুদিন থেকেই শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে বিহার করতে ইচ্ছা করেছিলেন। ভগবান তো আমাদের সব সময়ই ডাকছেন; কিন্তু আমরা তাঁর আহ্বান শুনতে পাই না; তার কারণ, শুনবার মতো আমরা তৈরি হইনি। ভগবানের জন্য এখানে লজ্জা ত্যাগের কথা বলা হয়েছে। ভক্তের হৃদয় হচ্ছে ভগবানের বৈঠকখানা; যার হৃদয় যত বেশি পরিষ্কার অর্থাৎ বাসনা-কামনা কম, ভগবানের প্রকাশ সেখানেই তত বেশি। গোপীদের হৃদয় ছিল সংসার-শূন্য; তাই ভগবানের আহ্বানে তাঁদের সংসারের যাবতীয় জিনিস- ধর্মাধর্ম বিচার, শুদ্ধাশুদ্ধ বোধ, লৌকিক ব্যবহার, দেহাভিমান- সব তুচ্ছ হয়ে গেল। বহুজন্মের সুকৃতির ফলে ভগবানকে এইভাবে লাভ করা যায়। স্বামী বিবেকানন্দ এই গোপীপ্রেমের বিষয়ে বলেছেন- ‘প্রথমে এই কাঞ্চন, নাম-যশ, এই ক্ষুদ্র মিথ্যা সংসারের প্রতি আসক্তি ছাড়ো দেখি। কেবল তখনই তোমরা গোপীপ্রেম কি তাহা বুঝিবে’। কৃষ্ণ অবতারের মুখ্য উদ্দেশ্য এই গোপীপ্রেম শিক্ষা দেয়া। গোপীরা তখন সকলে মিলে পাগলের মতো উচ্চৈঃস্বরে কৃষ্ণগুণ-গান করতে করতে বন থেকে বনান্তরে সেই প্রেমময়ের সন্ধান করতে লাগলেন। গভীর ভালবাসায়, প্রগাঢ় প্রেমে এরকম অবস্থা হয়ে থাকে। ভক্তিশাস্ত্রে বলে যে, ভগবানের জন্য ঐভাবে পাগল হতে না পারলে তাঁকে পাওয়া যায় না। শ্রীরামকৃষ্ণদেবের দেহত্যাগের পর শ্রীসারদাদেবীর সময় সময় এরকম ভাব হতো; তখন তিনি এমনভাবে কথা বলতেন কিংবা এমনভাবে পান খেতেন, যা দেখে লোকের মনে হতো যে, তিনি ঠাকুরেরই অনুকরণ করছেন। তিনি তখন শ্রীরামকৃষ্ণদেবের ভাবে একেবারে বাহ্যহারা হয়ে যেতেন। কৃষ্ণের চিন্তা করে গোপীদের এই ভাব সমাধির কথা রাসলীলায় বর্ণিত হয়েছে। শ্রীরামকৃষ্ণদেব বলতেন- সচ্চিদানন্দ-সমুদ্র কোথাও কোথাও ভক্তিহীমে অবতার রূপ ধারণ করেন। যদি এখনও কেউ ভগবানের জন্য গোপীদের মতো কাঁদতে পারেন, তবে তিনিও গোপীদের মতোই ভগবানের পদচিহ্ন দেখতে পাবেন। জগতের কাছে এই আশার কথা প্রচারের জন্যই ভগবানের এই লীলাখেলা। শ্রীরাধার ভগবৎ-প্রেম সর্বশ্রেষ্ঠ। প্রার্থনা করি তোমার ঐ চরণ আমাদের বুকে রেখে আমাদের হৃদগত কামানল দূর কর। এই হচ্ছে মহাভাবের অবস্থা; এই অবস্থায় সাধকের শরীরে অসহ্য জ্বালা হয়। সাধনার সময় শ্রীরামকৃষ্ণদেবের শরীরেও এরকম জ্বালা হতো। এই জ্বালা উপশমের জন্য গোপীরা ভাবছেন যে, শ্রীকৃষ্ণের চরণস্পর্শেই হয়ত এই জ্বালা দূর হবে। গোপীরা বলছেন- তোমার কথারূপ অমৃত সংসার-তাপ-দগ্ধ জীবের প্রাণস্বরূপ এবং তোমার কথা পাপনাশক। তোমার কথা শ্রবণমাত্রই জীবের মঙ্গল হয়; তাই ব্রহ্মাদি তত্ত্বদর্শীরা তোমার কথাকেই সর্বোৎকৃষ্ট বলে বর্ণনা করেছেন। পৃথিবীতে যারা তোমার কথা কীর্তন করেন, তারা নিশ্চয়ই পূর্বজন্মে বহু দান করেছিলেন; সেই সুকৃতির ফলেই তোমার কথাকীর্তনে তাদের রুচি হয়। শ্রীচৈতন্যদেব যখন পুরীতে বাস করছিলেন, সেই সময় সেখানকার রাজা প্রতাপ রুদ্র মহাপ্রভুর সঙ্গে মিলিত হবার জন্য অত্যন্ত ব্যাকুল হয়েছিলেন। সে বছর রথযাত্রার সময় মহাপ্রভু যথারীতি রথের সামনে নৃত্য-কীর্তনাদি করে অত্যন্ত পরিশ্রান্ত হয়ে পড়েন এবং শ্রীমতীর ভাবে বিভোর হয়ে পাশের একটি বাগানে গিয়ে অর্ধবাহ্য অবস্থায় শুয়েছিলেন। ভক্ত এবং ভগবানের সম্বন্ধ অচ্ছেদ্য। ভক্ত না থাকলে ভগবানের করুণার কথা, তাঁর মহিমার কথা জগতে কে প্রচার করত? ভক্ত ও ভগবান দুইজনেই উভয়ের ঋণে চির-আবদ্ধ। কৃষ্ণ যেমন বলছেন- চিরজীবনেও তোমাদের সদাচারের ঋণ শোধ করতে পারব না, ঠিক সেইভাবেই গোপীরাও হয়ত বলবেন- হে করুণাময়! তোমার অসীম কৃপার জন্য আমরা চিরজীবন তোমার কাছে ঋণী হয়ে রইলাম। পাছে ভগবানের এই পরম পবিত্র লীলা শ্রবণ করে মানুষের মনে জাগতিক ভাবের উদয় হয় এই আশঙ্কায় কৌশলে এখানে শ্রীকৃষ্ণ গোপীদের স্বরূপ দেখিয়ে দিলেন। তিনি বললেন, বালক যেমন নিজের প্রতিবিম্বের সঙ্গে খেলা করে, ভগবান শ্রীকৃষ্ণও সেরকম আপন শক্তিস্বরূপা গোপীদের সঙ্গে খেলা করেছেন। বালক এবং তার প্রতিবিম্বের মতো শ্রীকৃষ্ণ ও গোপীরা আলাদা নয়। অতএব শ্রীকৃষ্ণ কোন নারীর সঙ্গে বিহার করেননি; তিনি তাঁর শক্তির সঙ্গেই খেলা করেছেন। শ্রীকৃষ্ণ আত্মারাম হয়েও যত গোপী তত কৃষ্ণ হয়ে বিহার করেছিলেন। বহুক্ষণ নৃত্য-গীতাদিতে ক্লান্ত হয়ে পড়লে কৃপাময় ভগবান নিজের করকমল দিয়ে গোপীদের মুখ মুছিয়ে দিলেন। ঈশ্বরতত্ত্ব বুঝতে হলে সর্বপ্রথমেই চাই বিশ্বাস। যার বিশ্বাস হয়েছে যে, শ্রীকৃষ্ণই স্বয়ং ভগবান, তার কাছে সমস্ত প্রশ্নের মীমাংসা এক মুহূর্তেই হয়ে যায়। যিনি গোপী, তাঁদের পতি এবং সর্বদেহধারী জীবমাত্রেরই অন্তরে অন্তর্যামীরূপে বিরাজ করেন, তিনিই লীলাবিগ্রহধারী শ্রীকৃষ্ণ। বাইরের দৃষ্টিতেই কৃষ্ণ ও গোপীদের বিহার; কিন্তু অন্তর্দৃষ্টিতে আপন জীব-রূপা প্রকৃতির সঙ্গে পরমাত্মার মিলন- নিজের সঙ্গেই নিজে খেলা করছেন। বিশ্বব্রহ্মা-জুড়েই জীবাত্মার সঙ্গে খেলা চলছে। আসলে এই লীলা মুক্তি প্রদায়িনী। অনুগ্রহ করার জন্যই ভগবান নরদেহ ধারণ করে এমন সব চিত্তাকর্ষক লীলা করেন, যাতে মানুষ সেইসব লীলার কথা শুনে, ধ্যান করে ভগবৎ-পরায়ণ হতে পারে। গোপীরা ভগবান শ্রীকৃষ্ণের অনুমতি নিয়ে নিজ নিজ গৃহে ফিরে গেলেন। যে ব্যক্তি শ্রদ্ধাশীল হয়ে গোপীদের সঙ্গে ভগবান বিষ্ণুর এই রাসলীলা শ্রবণ বা কীর্তন করেন, তিনি অচিরেই কামনামক উৎকট হৃদরোগ থেকে মুক্ত হয়ে ভগবানে পরাভক্তি লাভ করেন। আধ্যাত্মিক জীবন লাভেপ্সু ব্যক্তির পক্ষে এর চেয়ে বড় প্রাপ্তি আর কি হতে পারে! লেখক : সন্ন্যাসী মহারাজ, রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশন, ঢাকা
×