ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

ট্রাম্পের বিজয় ও সামাজিক ফোরাম -স্বদেশ রায়

প্রকাশিত: ০৩:৪৪, ১০ নভেম্বর ২০১৬

ট্রাম্পের বিজয় ও সামাজিক ফোরাম -স্বদেশ রায়

রয়টার্স থেকে শুরু করে মিডিয়ার সকলেই মোটামুটি কুপোকাৎ হলেন। এমনকি বিশ্ব জনমত জরিপের অনেক কোম্পানিও এর সঙ্গে সঙ্গে চিৎপাত। কারণ, সকলকে মিথ্যে প্রমাণ করে দিয়ে ট্রাম্প আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হলেন। অনেক বড় ব্যবধানে জয়লাভ করলেন। যা তাঁর জন্যে গ্রেট নাইট। ট্রাম্পের কাছে যেমন গ্রেট নাইট তেমনি আমেরিকার ওই রাতটি মিডিয়ার জন্যে একটি ডার্ক ইভনিং বা গাঢ় অন্ধকার সন্ধ্যা। ট্রাম্পের নির্বাচনের ভিতর দিয়ে প্রমাণ হলো, মাস মিডিয়ার সেই শক্তি নেই যা মানুষকে প্রভাবিত করে। বরং এখন সোস্যাল ফোরাম যাকে কেউ কেউ সোস্যাল মিডিয়া বলেন, এই যেমন টুইটার, গুগল প্লাস, লিঙ্কডইন, ফেসবুকসহ বিভিন্ন সোস্যাল ফোরাম ও ব্লগ এদের কাছেই পরাজিত হচ্ছে মিডিয়া। আমেরিকার এই নির্বাচনে নিউইয়র্ক টাইমস ও সিএনএন-এর এডিটোরিয়াল বোর্ড সিদ্ধান্ত নিয়ে তাদের পাঠক ও দর্শককে জানিয়ে হিলারির পক্ষ নিয়েছিল। আবার ট্রাম্পের মালিকানাধীন কিছু টেলিভিশন ট্রাম্পের পক্ষে প্রচার করে। এছাড়া বিশ্বের মিডিয়ার একটি বড় অংশ হিলারিকেই সমর্থন করে। কিন্তু যারা সোস্যাল ফোরাম গত দুই বছর ধরে লক্ষ্য করেছেন তারা লক্ষ্য করতে পারেন সোস্যাল ফোরামে শ্বেতাঙ্গ আমেরিকানরা সব সময়ই এই মাস মিডিয়ার বিপরীতে কথা বলে এসেছে। মাস মিডিয়ার সঙ্গে সোস্যাল ফোরামের পার্থক্য হলো, মাস মিডিয়া জনগণের জন্যে বলে। জনগণকে ওই কথা শুনতে হয়। বিশ্বাসের বিষয়টি যার যার নিজের ওপর। অন্যদিকে সোস্যাল ফোরামে ব্যক্তি তাঁর মত প্রকাশ করে অন্যরা একজন ব্যক্তির মত পায়। মাস মিডিয়ার প্রসার বড় তবে তা সবার জন্যে নয়, অন্যদিকে সোস্যাল ফোরামের আওতা প্রায় প্রত্যেকের জন্যে। যে কারণে, সোস্যাল ফোরামকে মিডিয়া বললে একে মাস কমিউনিকেশান না বলে প্রত্যেকের সঙ্গে যোগাযোগ বলা যেতে পারে বা মিডিয়া ফর এভরিওয়ান। টেকনোলজি ও অর্থনৈতিক উন্নতি পৃথিবীকে সেদিকেই নিয়ে যাচ্ছে। আমেরিকার এই নির্বাচনে হিলারি নির্ভর করেছিলেন মাস মিডিয়ার ওপর, ট্রাম্প নির্ভর করেছিলেন সোস্যাল ফোরামের ওপর। যে কারণে হিলারির প্রচার দৃশ্যত বেশি মনে হয়েছে। আর মাস মিডিয়ার কল্যাণে হিলারিকে অনেকে বেশি জনপ্রিয় মনে করেছেন। অন্যদিকে সোস্যাল মিডিয়া বা ফোরামে নীরবে একে অপরের কাছে এই পথে প্রায় সকলের কাছে গেছে প্রচার- যা চোখে পড়েনি। আর সোস্যাল ফোরামের মতামত মিডিয়াতে না আসাতে সাধারণ মানুষ ও মিডিয়া ব্যক্তিত্বরা মনে করেছেন ট্রাম্প অনেক পিছে পড়ে আছে। এখানে আমাদের মিডিয়ার ব্যক্তিদের একটি ত্রুটি খুব বড়ভাবে বের হয়ে এসেছে যে, টেকনোলজি ও সোস্যাল ফোরামকে যারা উপলব্ধি করতে পারে, বুঝতে পারে মিডিয়া এখনও তাদের হাতে নয়। মিডিয়া সোস্যাল ফোরামের মাধ্যমে পরিবর্তিত সমাজ ও টেকনোলজি থেকে যারা পিছিয়ে আছে তাদের হাতে। কারণ, সোস্যাল ফোরামে কিন্তু অনেক আগেই স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল নির্বাচনে হিলারি নয়, ট্রাম্পই জিতছেন। পাঠকরা মনে করতে পারবেন, এই কলামে কিন্তু দুবার সে ইঙ্গিত দিয়েছি। এবং দেশের ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু থেকে শুরু করে অনেকের সঙ্গে ব্যক্তিগত আলোচনায় বলেছি, ট্রাম্পই জিতবেন। কারণ, নির্বাচনের ফল সেদিনই নির্ধারণ হয়ে গেছে যেদিন ডেমোক্র্যাট তরুণ ভোটাররা জানতে পেরেছে ষড়যন্ত্র করে স্যান্ডার্সকে হারিয়ে হিলারিকে প্রার্থী করা হয়েছে ওয়াল স্ট্রিট ও কর্পোরেট স্বার্থে। তাছাড়া আমেরিকার ৮ নবেম্বরের নির্বাচনের আগে কিন্তু একটা ডামি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। সেটা ছিল ব্রেক্সিট। ব্রিটেনের ইউরোপ থেকে বেরিয়ে আসা কিন্তু হোয়াইট ন্যাশনালইজমের পক্ষে রায়। এ থেকেই শ্বেতাঙ্গ মনোভাব বোঝা উচিত ছিল মিডিয়ার। যাহোক, নীতিগতভাবে ওয়াল স্ট্রিট ও কর্পোরেট বিরোধী হওয়া উচিত ছিল ডেমোক্র্যাটদের। স্যান্ডার্স তাই ছিলেন। কিন্তু অনৈতিকভাবে কর্পোরেট স্বার্থ স্যান্ডার্সকে সরিয়ে হিলারিকে কর্পোরেট স্বার্থ এবং ওয়াল স্ট্রিটের পক্ষের প্রার্থী করা হয়। যা হয়ত রিপাবলিকানরা হতে পারত। কিন্তু আমেরিকার তরুণ ও ওয়ার্কিং ক্লাস শ্বেতাঙ্গরা এ মুহূর্তে চাচ্ছে, কর্পোরেট স্বার্থবিরোধী একটি অবস্থান। স্যান্ডার্সের বিদায়ের পরে যে টুপিটি হিলারির মাথায় দেয়ার কথা ছিল সেই কর্পোরেট স্বার্থবিরোধী টুপিটি মাথায় দেন ট্রাম্প। এ প্রসঙ্গে মনে পড়ে ভারতীয় কাগজের একটি কার্টুনের কথা। ১৯৮৯ সালের নির্বাচনের প্রচারকালে রাজীব গান্ধীকে হত্যার পরে ওই কার্টুনটি ছাপা হয়। ওই নির্বাচনে কংগ্রেসের সেøাগান ছিল স্থিতিশীলতা। কারণ, কংগ্রেস ও তার নেতা রাজীব গান্ধীই একমাত্র দিতে পারে স্থিতিশীলতা। তাই, তাদের নেতা কে তা স্থির হয়ে আছে। যাহোক, রাজীবের মৃত্যুর পরে ওই কার্টুনটি ছিল এমন যে, বিজেপি জোট স্থিতিশীলতার নামাবলীটি চুরি করে নিয়ে যাচ্ছে। কারণ রাজীবের মৃত্যুর পরে কংগ্রেসের কে নেতা তা স্থির নেই। অন্যদিকে বিজেপি জোটের নেতা অটল বিহারী বাজপেয়ী তা স্থির করেছে তারা। এবারের মার্কিন নির্বাচনে স্যান্ডার্সের বিদায়ের পরে ডেমোক্র্যাট ও রিপাবলিকানদের ক্ষেত্রে ওই কার্টুনটিই সত্য হয়েছে। কর্পোরেট স্বার্থ এবং ওয়াল স্ট্রিটবিরোধী টুপিটি ট্রাম্প চুরি করে নেন। এছাড়াও স্যান্ডার্সের বিদায়ের পরে যখন হিলারি প্রার্থী হিসেবে ডেমোক্র্যাট শিবিরে নিশ্চিত হয়ে গেছেন তখন কিন্তু সোস্যাল ফোরাম যারা লক্ষ্য করেছেন তারা দেখেছেন। সেখানে কিন্তু বেশি ক্ষেত্রে বলা হচ্ছে, একজন ব্যর্থ মানুষকে তারা প্রেসিডেন্ট হিসেবে দেখতে চায় না। সেখানে স্পষ্ট বলা হচ্ছে, হিলারি স্ত্রী হিসেবে ব্যর্থ কারণ তিনি কখনই ক্লিনটনকে নিজের করে রাখতে পারেননি। তারপরে সিনেটর হিসেবে ব্যর্থ। আবার পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে তিনি ব্যর্থ। অন্যদিকে রিপাবলিকানদের সোস্যাল ফোরামের এই বক্তব্যের যারা কড়া জবাব দিতে পারত সেই তরুণ শ্রেণী স্যান্ডার্সকে হারিয়ে ডিপ্রেসড হয়ে পড়ে বেশি অংশ। নির্বাচনের কিছুদিন আগে থেকে সোস্যাল ফোরামে লক্ষ্য করা যাচ্ছিল তরুণদের ওই ডিপ্রেসড অংশ নির্বাচনী প্রচারেও নেই তারা ভোট দিতেও যাবে না। অন্যদিকে সোস্যাল ফোরামে লক্ষ্য করা যাচ্ছিল ইউরোপীয় আমেরিকানরা (শ্বেতাঙ্গ) অধিকাংশই ট্রাম্পের পক্ষে, কারণ, তারা মনে করছে ইউরোপের দেশগুলো যে সন্ত্রাসকবলিত হয়েছে, ফ্রান্সে, জার্মানিতে যে জঙ্গী হামলা হয়েছে এর কারণ হিসেবে তারা এক টার্ম ব্যর্থ পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে হিলারিকেই মনে করছে অনেকখানি। হিলারিকে আর যে দায় কাঁধে নিতে হয়েছে তা হচ্ছে, ওবামার ব্যর্থতা। ওবামার দুই ধরনের ব্যর্থতা কিন্তু এ নির্বাচনে বড় হয়ে দেখা দিয়েছে। একটি ওবামার ব্যর্থতা নয় সেটা পৃথিবীর সভ্যতার ব্যর্থতা। অর্থাৎ একজন ব্লাক দুই দুইবার আমেরিকার প্রেসিডেন্ট এই বিষয়টি হোয়াইটদের একাংশ মন থেকে মেনে নিতে পারেনি। তাই এর একটা ব্যাকলাস হয়েছে আমেরিকায়। সভ্যতার এই ব্যর্থতার ইগো অনেক বড়। বাংলা ভাগের অন্যতম কারণও এই ইগো, ভবিষ্যতে সে বিষয়ে লেখার ইচ্ছে রইল। এখন প্রসঙ্গান্তরে নয়। দুই, ওবামা যে ‘উই ক্যান’ সেøাগান দিয়ে এসেছিলেন তার কোন প্রকাশ তিনি দেখাতে পারেননি। বরং তিনিও নিজেকে একজন যুদ্ধবাজ হিসেবে প্রমাণ করেছেন। এবং তার পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে হিলারি নিজেকে আরও বেশি যুদ্ধবাজ হিসেবে প্রমাণিত করেছিলেন। যে কারণে ট্রাম্প থেকে শুরু করে নীল ফারগুসন পর্যন্ত নির্বাচনের আগে বলেন, হিলারি প্রেসিডেন্ট হলে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ হবে। এই তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের অর্থনৈতিক ধাক্কার ভয় আমেরিকান ওয়ার্কিং ক্লাসকে অনেক বেশি কাঁপিয়ে দেয়। যেটা ট্রাম্পের জন্যে আরও বেশি লাভের হয়। এরপরে যে আফ্রিকান আমেরিকান ভোটের ওপর হিলারি ব্যাংক করতে চেয়েছিলেন, সেটা তার খুব বেশি কাজ দেয়নি। কারণ, আফ্রিকান আমেরিকানরা ওবামাকে প্রার্থী পেয়ে যে মাপে উজ্জীবিত হয়েছিল হিলারিকে পেয়ে তারা তেমনটি হয়নি। কিন্তু ওবামা, মিশেল ও হিলারির এই আফ্রিকান আমেরিকান ভোট নিয়ে যত বেশি টানাটানি করেছেন ততই হোয়াইট ওয়ার্কিং ক্লাস ট্রাম্পের পক্ষে এসেছে। এমনিভাবে গত এক বছরে সোস্যাল ফোরামে এমন বহু কারণ দেখা গেছে। তবে উল্লিখিত কারণগুলো ছাড়াও আর যেটা বড় তা হলো বাইবেলিক হোয়াইট ন্যাশনালইজম, সারা বিশ্বে যেমন হিন্দুইজম, ইসলামইজম, বৌদ্ধইজম জেগে উঠছে তেমনি বাইবেলিক ন্যাশনালইজম বা খ্রীস্টানইজম জেগে উঠছে। এ মুহূর্তের পৃথিবীতে এ অনেক বড় ঘটনা। ট্রাম্পের বিজয়ের অন্যতম কারণও এই খ্রীস্টানইজম বা বাইবেলিক ন্যাশনালইজমও। যাহোক, এই লেখা যখন শেষ করছি তার মাত্র কয়েক ঘণ্টা আগে ট্রাম্প বিজয়ী হয়েছেন। তাই তার ভবিষ্যত নিয়ে এখনই কিছু বলা ঠিক নয়। তবে আগেও এই কলামে লিখেছি ট্রাম্প আরেক রিগ্যান হবেন। রিগ্যান যেমন পৃথিবীর রাজনীতির ভারসাম্য নষ্ট করে এক নতুন পৃথিবীতে মানুষকে ঢুকিয়ে দিয়ে গেছেন। ট্রাম্পও সেই চেষ্টা করবেন। তার সামনে এখন যেমন মিডল ইস্ট তেমনি তার জন্যে বড় হলো চায়না যা তার কাছে একটি থিওসিডিডিস ট্র্যাপ। এই ট্র্যাপ থেকে তিনি কীভাবে বের হবেন তার ওপরও পৃথিবীর নতুন রূপ নির্ভর করছে। [email protected]
×