ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ০৮ মে ২০২৪, ২৫ বৈশাখ ১৪৩১

শীতের পদধ্বনি

প্রকাশিত: ০৩:৫৫, ৯ নভেম্বর ২০১৬

শীতের পদধ্বনি

হেমন্তের মনোরম নাতিশীতোষ্ণ আমেজের মধ্যেই অল্পস্বল্প শীত অনুভূত হতে শুরু করেছে। মাঝে মধ্যে বিশেষ করে রাতের বেলা বন্ধ রাখতে হয় অনেকের বাতানুকূল যন্ত্র; কমিয়ে দিতে হয় সিলিং ফ্যানের রেগুলেটর। চাই কি শেষ রাতের দিকে আপাদমস্তক পাতলা একটি চাদর কিংবা কাঁথায় মুড়িয়ে দিতে চায় মন। গলি-গিঞ্জি যানজট-জনজট, ধূলি ও ধোঁয়ায় ধূসরিত সর্বোপরি অগণিত অট্টালিকাশোভিত খোদ রাজধানীতেই যখন এই অবস্থা, তখন বুঝতে আদৌ অসুবিধা হয় না যে, শীত এসে কড়া নাড়ছে দরজায়। অবশ্য ঢাকার বাইরে শহরতলি ও আশপাশে, গ্রামগঞ্জে এবং বিশেষ করে উত্তরাঞ্চলে শীত বুঝি এসে গেছে কিছু আগেই। সেখানে সকাল-সন্ধ্যা কুয়াশা পড়ে। দিন অপেক্ষাকৃত ছোট এবং রাত প্রলম্বিত। রোদ ওঠে বেলা করে। নবান্নের সুপক্ব সোনালি ধান এবং গোধূলির রক্তিম আভাসে দেখা মেলে শীতের আগমনীর। আবহাওয়া ও জলবায়ু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে গত ক’বছর ধরেই ঋতু পরিবর্তনের আলামত তথা খামখেয়ালিপনা পরিলক্ষিত হচ্ছে। পৃথিবীর আহ্নিক গতি, বার্ষিক গতি ঠিকই আছে, তবে আবর্তনের নিয়ম মেনে ঋতুগুলো যেন আর আগের মতো যথাসময়ে আসে না। গ্রীষ্মকাল হয় প্রলম্বিত, খরাপ্রবণ, তাপদগ্ধ। ফলে বর্ষার আগমন ঘটে অপেক্ষাকৃত বিলম্বে। কালিদাসের কালের নিয়ম মেনে আষাঢ়ের প্রথম দিবসেই বুঝি আর কদম ফুল ফোটে না। স্বল্পস্থায়ী শরত-হেমন্তের আভাস মেলে স্বচ্ছ নীল আকাশ এবং নবান্নের ঘ্রাণে। তবে সবাইকে বুঝি টেক্কা দিতে চায় শীত ও বসন্ত। শীতকাল এসেই বলেÑ যাই। বিশেষ করে নগরজীবনে বড়জোর দু’চারদিন শৈত্যপ্রবাহ অনুভূত হয় কি হয় না। আর বসন্তকাল! বাংলার এক কবিই দীর্ঘশ্বাস ফেলে আক্ষেপ করে লিখেছেন, ‘ফুল ফুটুক না ফুটুক আজ বসন্ত।’ আবহাওয়া বিজ্ঞানী ও জলবায়ু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ সবই নাকি প্রধানত মনুষ্যসৃষ্ট। মানুষের আত্মঘাতী প্রবণতা। বায়ুম-লে অবিরাম অপরিকল্পিত কার্বন নিঃসরণের পরিণাম। মানুষ তার ক্রমবর্ধমান চাহিদা ও আরাম-আয়েশের জন্য গাছপালা-বনাঞ্চল ধ্বংসসহ নানাভাবে নানা উপায়ে প্রকৃতিকে ধ্বংস করছে, প্রাকৃতিক সম্পদকে কাজে লাগাচ্ছে। আর এর চূড়ান্ত পরিণামেই ঘটছে ভয়াবহ পরিবেশ বিপর্যয়। পৃথিবী ক্রমশ উত্তপ্ত হয়ে ওঠায় সুমেরু-কুমেরুর বরফ গলে যাচ্ছে; হিমবাহ যাচ্ছে গলে। ফলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ছে। মহাসাগরীয় স্রোতে আসছে পরিবর্তন। সুতরাং ঋতুচক্রে পরিবর্তন অনিবার্য হয়ে উঠবে, তাতে আর বিচিত্র কি? আর এ কারণেই বুঝি রাজধানীতে শীত নামে হেমন্তের শেষে। রাজধানীতে প্রতিদিন কেবলই অহর্নিশ ছুটে চলা, প্রতিনিয়ত দিনযাপনের গ্লানি। তবে এর মাঝেও ক্ষণকালের জন্য চোখে পড়ে প্রায় পত্রহীন বৃক্ষ, শোনা যায় ঝরা পাতার গান, রাস্তার পাশে জ্বলন্ত উনুনে পিঠা-পুলির সমারোহ, লেপ-তোশক-কম্বলের সমাহার। এ যে প্রকৃতির অবস্থা যাই হোক, এই শেষ কার্তিকেই শীতের আমেজ এবার পুরোপুরি লক্ষ্য করা যাচ্ছে সবখানে, সবকিছুতে। আজকাল শীতের বহু সবজি শীতের পরও পাওয়া যায়। তাহলেও শীতের আসল সবজি শীতে ওঠা যেটা বিশেষ আনন্দদায়ক। নতুন আলু বেগুন শিম ইত্যাদি ওঠাও শুরু করেছে। কপির সাইজ এখন শীতের আসল সাইজে হতে চলেছে। কয়েকদিন আগে আগাম কপি উঠলেও এখন উঠতে শুরু করেছে বড় সাইজের দু’রকম কপি। ওলকপি উঠতে বেশি বাকি নেই। খালে বিলে পানি শুকাচ্ছে। শুরু হয়েছে মাছ ধরার আনন্দ। বিলের মাছ হাওড়ের মাছ আসতে শুরু করেছে। গ্রামীণ এবং শহুরে দুই পরিবেশেই এখন শীতের পিঠার আয়োজন সব সময় থাকে। এবারও হয়েছে তাই। কিছু দিনের মধ্যেই ব্যাপকভাবে শুরু হবে খেজুরের রস আর গুড়। শীত এলে গ্রামগঞ্জে বসে মেলা। এটা বহুকালীয় ঐতিহ্য। এবারও কোথাও না কোথাও এ মেলা আয়োজিত হবে। রাজধানীতেও এবার আয়োজন করা হয়েছে সাংস্কৃতিক উৎসব। ধান কাটা শুরু হয়েছে। ক’দিন পরই নবান্ন। রাজধানীর এবং বিভিন্ন গ্রামে। মানুষের মন নাচবে আনন্দে। নতুন ধানের গন্ধ এখানে ওখানে বাড়িতে বাড়িতে কৃষাণ-কৃষাণী মহাব্যস্ত। এই তো এসে যাচ্ছে শীত। প্রকৃতি আরও অনেকখানি বদলাবে তখন। উত্তরে হাওয়া ধীরে ধীরে প্রবল হবে। তখন বলা যাবে কবির ভাষায় : ‘শীতের হাওয়ার লাগলো নাচন/আমলকীর এই ডালে ডালে।/পাতাগুলো শিরশিরিয়ে/ঝরিয়ে দিল তালে তালে।’
×