ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১১ মে ২০২৪, ২৮ বৈশাখ ১৪৩১

এনামুল হক

কণ্ঠে যার সুধা ঝরে

প্রকাশিত: ০৩:৪২, ৩ নভেম্বর ২০১৬

কণ্ঠে যার সুধা ঝরে

সেই তিন বছর বয়স থেকে শিশুটি মঞ্চে গান গেয়ে আসছে। তখন নানা ও চাচার সঙ্গে যেত। ওরা কাওয়ালী গাইতেন। সেও গাইত। কালক্রমে শিশুটি বড় হলো ও মস্ত বড় গায়ক হয়ে উঠল। তার গান সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ভারতীয়দের হৃদয়ে দোলা দিল। সেই শিশুটিই আজকের রাহাত ফতেহ আলী খান- ২০০৪ সালে ‘পাপ’ ছায়াছবিতে ‘লাগি তুমসে মান কি লাগান’ গান দিয়ে যার বলিউডে প্রবেশ। ১২ বছর ধরে বলিউডের সঙ্গীত ভুবনের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে আছেন। তথাপি অন্যদের আনন্দদানে আগ্রহের ব্যাপারে শিশুর মতোই সারল্য তার মধ্যে। বাণিজ্যিক জগতের আলঙ্কারিক দিকগুলো তাকে স্পর্শ করে না। কিছুদিন আগে তার সিঙ্গেল ‘দিল্লাগী’ মুক্তি পেয়েছে সেখানে ভিডিওতে আছে বিদ্যুৎ জামাওয়াল ও হুমা কোরায়েশী। বলা হয় যে সঙ্গীতের এ্যালবামে তারকারা পারফর্ম করলে সঙ্গীতশিল্পী দৃশ্যমান হতেও পারেন নাও হতে পারেন। তার ফলে কণ্ঠশিল্পীর গুরুত্ব খর্ব হতে পারে। কিন্তু রাহাত ফতেহ আলী খান মনে করেন যে লোকে কণ্ঠশিল্পীদের কারণেই গান শোনে- ভিডিওর কারণে নয়। তবে দুর্ভাগ্যজনক ব্যাপার হচ্ছে দর্শকের সংখ্যা শ্রোতার সংখ্যার চেয়ে বেশি। তরুণ প্রজন্ম যত না সঙ্গীত শোনে তার চেয়ে বেশি ভিডিও দেখে। সম্ভবত গানের প্রতি তাদের আকর্ষিত করার জন্যই ভিডিও বানানো হয় বলে মনে করেন তিনি। রাহাত ফতেহ আলী দৈনিক তিন থেকে চার ঘণ্টা রেওয়াজ বা অনুশীলন করেন। তাকে রেকর্ডিংয়ের পেছনে এবং এক স্থান থেকে অন্য স্থানে যাওয়া আসার পেছনে সময় দিতে হয়। প্রচুর ব্যস্ততার মাঝেও তিনি ঠিকই রেওয়াজের সময়টা বের করে নেন। বলেন, ‘সঙ্গীতই আমার সাধনা, আমার পেশা ও নেশা। এ আমি বাদ দিতে পারি না। আমার শ্বাস-প্রশ্বাস বন্ধ হয়ে যেতে পারে কিন্তু গান বাদ দিতে পারি না। যে গান আমাকে গাইতে হয় তা নিয়েই আমি রেওয়াজ করি।’ বড় বড় সঙ্গীতঙ্গ ও শিল্পীরা আজ তাদের ছাত্রদের মধ্য থেকে আগের মতো ভাল শিল্পী তৈরি করতে পারছেন না। এই বাস্তবতাকে স্বীকার করে নিয়ে তিনি বলেন যে, ছাত্ররা আজ শেখার পেছনে সেই ধরনের সময় ও শ্রম দিচ্ছে না। তাদের অগ্রাধিকার বদলে গেছে। তাদের মতো ওই অর্থে শেখার সময় ও সুযোগ তিনি পাননি। অতি ছোট বেলা থেকে বাপ-চাচার সঙ্গে মঞ্চে তার সময় কেটেছে। সৌভাগ্যক্রমে এই মঞ্চ থেকেই তিনি শিখেছেন। মঞ্চই হয়ে দাঁড়িয়েছিল তার পাঠশালা। যে কারণে বড় হয়ে মঞ্চে অনুষ্ঠান পরিবেশনে কখনও তার ভয় হয়নি। আর যতদিন সুর ও বেসুরের ধারণা সম্পর্কে তিনি সচেতন ছিলেন না ততদিন ভয় জাগেনি। যখনই পার্থক্যটা জেনেছেন তখনই তার ভয় লাগতে শুরু করেছিল। সালমান খানের ছবিতে প্রচুর গান গেয়েছেন রাহাত ফতেহ আলী খান। তার সঙ্গীত জীবনের বাণিজ্যিক দিকটা এই সালমান খানই দেখেন। অভিনেতা ও শিল্পী হিসেবে সালমান সম্পর্কে বেশ উঁচু ধারণা তার। তিনি মনে করেন যে শিল্পীর চেয়েও সালমানের বড় পরিচয় তিনি অনেক ভাল মানুষ এবং ভাল কাজ করেছেন। তাদের দুজনের সম্পর্ক ভাল মানুষের সম্পর্ক বলে মন্তব্য করেছেন তিনি। কেউ কেউ বলেন যে, রাহাত ফতেহ আলীর প্রতিযোগিতা এখনও আরিজিত সিংয়ের সঙ্গে। আরিজিত তার বাজারে ভাগ বসিয়েছেন এমন কথাও শোনা যায়। এ সম্পর্কে ফতেহ আলী বলেন যে, তার সঙ্গীতের ধারা আর আরিজিতের সঙ্গীতের ধারা সম্পূর্ণ আলাদা। তা ছাড়া সবকিছুই চূড়ান্ত অর্থে দর্শক-শ্রোতাদের ওপর নির্ভর করে। তারা কোন্টা শুনতে চান, কোন্ ধারা পছন্দ করেন, কোন্ কণ্ঠ বেশি ভাল লাগে সবকিছুই তার ওপর নির্ভর করে। সঙ্গীতের মতো সৃজনশীল ক্ষেত্রটিতেও প্রচুর কানাঘুষা রাজনীতি আছে। এতে ব্যক্তিগত ও পেশাগতভাবে তিনি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারেন বলে স্বীকার করেছেন ফতেহ আলী। তিনি মনে করেন সঙ্গীতের জগতে কোন প্রতিযোগিতা থাকা উচিত নয়। কাওয়ালী, সুফিয়ানা কালাম ও ধ্রুপদী ধারা থেকে সরে এসে বিভিন্নমুখী পথে বিচরণ করেছেন রাহাত ফতেহ আলী। জিঙ্গেলস ও লঘু সঙ্গীত থেকে বলিউড সঙ্গীত, স্টেজ শো, সিরিয়ালÑ সবকিছুই করেছেন। বিশুদ্ধবাদীরা একে সঙ্গীতের বিশুদ্ধ রূপকে গুলিয়ে ফেলা বলে অভিযোগ করতে পারেন। বলতে পারেন যে রাহাত ফতেহ আলী নিজের শিল্পের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন। কিন্তু না। আজ পর্যন্ত কেউ কখনও এ ধরনের কোন অভিযোগ করেননি বা প্রশ্ন তোলেনি। তিনি বলেন, সঙ্গীতের নানা ধারায় তিনি গান গাইলেও তার জন্য তিনি কখনও সমালোচিত হননি। এদিক দিয়ে তিনি অতি ভাগ্যবান। রাহাত ফতেহ আলী বলেন, ‘তবে এটা ঠিক যে যারা নুসরাত ফতেহ আলীর গান শুনে থাকেন তারা আমার গান শুনতে নাও চাইতে পারেন। সঙ্গীতে তার যে জ্ঞান, যে মেধা ও দক্ষতা তা থেকেই আমি শিখেছি। তিনিই আমার ওস্তাদ। আমার যা কিছু হওয়া, যা কিছু পাওয়া সবই তার জন্য। চেষ্টা করি তার মতো গান গাইতে। কিন্তু তিনি ছিলেন একজন সঙ্গীতঙ্গ। যে ব্যাপ্তি তিনি অর্জন করেছিলেন তা অতি বিস্তৃত। সেটা অর্জন করা অনেক কঠিন। তথাপি চেষ্টা করছি।’ প্রশ্ন ওঠে যে, রাহাত ফতেহ আলীর আজকের যে খ্যাতি তা চলচ্চিত্র সঙ্গীতের কারণেই কেন হয়েছে। কেন ধ্রুপদী সঙ্গীতের জন্য হয়নি। দেখা যায় যে ধ্রুপদী সঙ্গীত শিল্পীরা শিল্পের সাধনা জীবন পার করে দিয়ে থাকেন। অথচ প্রায়শই তাদের খ্যাতিটা অর্জিত হয় মৃত্যুর পর। জীবদ্দশায় তারা তেমন একটা খ্যাতিমান হন না। সঙ্গীতের এই পরম স্বর্গীয় রূপটি চলচ্চিত্র সঙ্গীতের কাছে বলি হয়ে গেছে। কেন হয়েছে সে ব্যাপারে রাহাত ফতেহ আলীর ব্যাখ্যা হলো, প্রশ্নটা ঘুরে ফিরে সেই মৌলিক বিষয়ে চলে আসে যে লোকে আসলে কি দেখতে বা শুনতে চায়। অর্থাৎ সেই ব্যবসার ব্যাপারটাই আবার এসে যায়। তারা পরিমাণগতভাবে যেটা বেশি শুনছে স্বভাতই সেটা বেশি জনপ্রিয়তা পায়। ফলে ধ্রুপদী সঙ্গীত পিছিয়ে পড়েছে। তার পরও সঞ্চয় লীলা ভানসালির মতো পরিচালকরা আছেন যারা এই সঙ্গীতকে চলচ্চিত্রেও বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে হিসেবে ব্যবহার করে থাকেন। আরও বেশি বেশি ছায়াছবিতেও এমনটা হওয়া উচিত বলে মনে করেন তিনি। রাহাত ফতেহ আলী বলেন, তিনি বিভিন্ন ধরনের সঙ্গীত গাইতে ভালবাসেন। তবে ধ্রুপদী সঙ্গীত অধিকতর কঠিন। তিনি মনে করেন তার কণ্ঠস্বর কাওয়ালীর জন্য সবচেয়ে বেশি উপযোগী। তিনি বলেন, ‘লোকে আমার ফিল্মি গানই বেশি শুনে থাকে। তবে অন্তর থেকে আমি কাওয়ালী ও ধ্রুপদী গাইতে চাই। পাকিস্তানে আমি মঞ্চে কাওয়ালী গেয়েছি। হিন্দুস্তান হচ্ছে ধ্রুপদী সঙ্গীতের জন্মস্থান। আমি নিশ্চিত যে এই ধ্রুপদী সঙ্গীতেও ধাতস্থ হয়ে যাব। রাহাত আলী পাকিস্তান থেকে এসেছেন। তবে ভারতেই বেশি কাজ করেন। দুটো দেশের মধ্যে কোন্টিকে তিনি স্বদেশ বলে ভাবেন এমন প্রশ্নে তার জবাব ‘স্বদেশ তো থাকে ব্যক্তির হৃদয়ে। আমার স্বদেশ হচ্ছে দুটো।’ সূত্র : স্টারডাস্ট
×