ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১১ মে ২০২৪, ২৮ বৈশাখ ১৪৩১

এনামুল হক

মিথ্যাচারের রেকর্ড

প্রকাশিত: ০৭:৩৮, ২৬ অক্টোবর ২০১৬

মিথ্যাচারের রেকর্ড

যুক্তরাষ্ট্রের এবারের নির্বাচনের মতো এত অখুঁদ নির্বাচন আগে আর কখনও হয়েছে কিনা সন্দেহ। অদ্ভুত এদিক দিয়ে যে, এবারের নির্বাচনী প্রচারে মিথ্যাচার হয়েছে অজস্র এবং রাজনৈতিক বিতর্কও হয়েছে বাস্তবতা বিবর্জিত। ধারণা করা হচ্ছে যে, এ মিথ্যাচার ও অবাস্তব বক্তব্য পরিবেশন নির্বাচনের দিনটিতেও চলবে। যেমন রিপাবলিকান প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্পও তার নির্বাচনী প্রচার টিমের মিথ্যাচারগুলো হচ্ছে এই যে, প্রেসিডেন্ট ওবামা বিদেশে জন্ম নেয়া একজন মুসলমান, যিনি প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে প্রেসিডেন্ট হয়েছেন একটা বৈশ্বিক ইউটোপিয়া বাস্তবায়নের জন্য। প্রচার হয়েছিল ওবামা তৃতীয়বার প্রেসিডেন্ট পদে দাঁড়াতে চান। জলবায়ু পরিবর্তনের কথাটা একটা ভাওতা। মার্কিন স্কুলগুলোতে ইসলাম প্রচার ও প্রসার ঘটানো হচ্ছে। ড্রাগ কার্টেলগুলো সরকারকে কিনে নিয়েছে। বিগত ৮ বছরের আগপর্যন্ত আমেরিকানদের বন্দুক বা বর্ণবাদ নিয়ে কোন সমস্যা হয়নি। এসব মিথ্যাচার থেকে ট্রাম্প সমর্থক ও অন্যান্য শ্রেণীর ভোটারের মনে ‘ষড়যন্ত্র তথ্যটি’ বদ্ধমূল রূপ নিয়েছে। এই শ্রেণীর ভোটারদের ওপর সমীক্ষা চালিয়ে ‘টাইম’ সাময়িকী দেখতে পেয়েছে যে, দেশের অবস্থা, অর্থনীতির হালচাল, হিলারি প্রেসিডেন্ট হলে কী হতে পারে? তা নিয়ে তাদের মধ্যে গভীর হতাশা বিরাজ করছে। তবে একই সঙ্গে তথ্যের দ্বারা অসমর্থিত হলেও ‘ষড়যন্ত্র তথ্যটিকে’ তারা সভ্য বলে মনে করে। আরও দেখা গেছে যে, কিছু মানুষ দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে ক্লিনটন প্রেসিডেন্ট থাকাকালে ভিন্স ফস্টার নামে হোয়াইট হাউসের এইডের মৃত্যুটা ছিল হত্যাকা- এবং সেই হত্যাকা- ঘটানো হয়েছিল ক্লিনটন দম্পতির কিছু গোপন তথ্য ধামাচাপা দেয়ার জন্য। অথচ পাঁচটি সরকারী তদন্তের সবটিতে বলা হয়েছিল যে, ফস্টার আত্মহত্যা করেছিলেন। তারপরও হাজার হাজার ওয়েব পেজে ফস্টার হত্যার কাল্পনিক সব ষড়যন্ত্রের বর্ণনা আছে। ট্রাম্প নিজেও এমন সব বর্ণনায় ইন্ধন যুগিয়েছেন। সেই মে মাসেই তিনি বলেছিলেন, ফস্টারের মৃত্যুটা অতি রহস্যজনক এবং অনেকের ধারণা ওটা নিতান্তই হত্যাকা-। স্মরণকালের ইতিহাসে কোন প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থীকে নির্বাচনী প্রচারণার সময় এ ধরনের ফ্যান্টাসির সঙ্গে তাল মেলাতে দেখা যায়নি। দৃশ্যত যা বাস্তব তার ওপর সংস্কারের ছায়া ফেলা এবং যা বাস্তব নয় সেটাকে বিশ্বাসযোগ্য করে তোলাÑ এটাই হয়ে দাঁড়িয়েছে ট্রাম্পের প্রচারাভিযানের প্রধান বৈশিষ্ট্য। ট্রাম্পের মূল বক্তব্য হলোÑ বর্তমান ব্যবস্থার ওপর মানুষের আস্থা হারিয়ে গেছে এবং তিনিই হলেন এর একমাত্র সমাধান। তিনি বলেন, ‘প্রথমত, যারা এ ব্যবস্থাটিকে কারচুপিপূর্ণ করে তুলেছে তাদের ওপর নির্ভর করে কখনই এ ব্যবস্থাকে ঠিক করা যাবে না।’ এ বক্তব্যের দ্বারা তিনি যে শুধু হিলারিকে বা ওবামাকে অভিযুক্ত করছেন তা নয়, অভিযুক্ত করছেন গণতন্ত্রের। সহায়ক প্রতিষ্ঠান নির্বাচন কমিশনের লোকজনকেও তিনি বলেছেন, ভোটের দিন এরা নির্বাচনকে হিলারির পক্ষে নিয়ে যেতে পারেন। তিনি অভিযোগ করেছেন যে, ফেডারেল রিজার্ভ ওবামার প্রতি পক্ষপাতিত্ব করছে। বিতর্কে যারা মডারেটর হিসেবে কাজ করেছেন তারা ডেমোক্র্যাট বলে মিথ্যা অভিযোগে অভিযুক্ত করেছেন তিনি। আর সংবাদমাধ্যমকে তিনি প্রতিষ্ঠিত এলিটদের এজেন্ট হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। তিনি বলেছেন, মিডিয়া ও প্রেস যেভাবে হিলারিকে সুরক্ষা দিচ্ছে তেমনটি এ দেশের ইতিহাসে আর কাউকে দেয়নি। আজকের মতো এত ব্যাপক পরিসরে না হলেও চার বছর আগে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রচারাভিযানে ওবামা ও রমনিও ভোটারদের কাছে মিথ্যাচার করছেন বলে একে অপরকে অভিযুক্ত করেছিলেন। যারা সত্যতা যাচাই করে দেখেন তারা তখন বলেছিলেন, এমন মিথ্যাচার তারা জীবনে দেখেননি। তবে তুলনামূলকভাবে রমনির ভাওতাবাজি ছিল অতি ঘনঘন এবং অধিকতর নগ্ন। অবশ্য ওবামাও ধোয়া তুলসিপাতা ছিলেন না। তার প্রচারণার একটা মূল বিষয় ছিল এ মিথ্যা অভিযোগ যে, রমনি সর্বক্ষেত্রে গর্ভপাতকে বেআইনী করতে চান। কিন্তু এবারের মিথ্যাচারের কাছে সবকিছুই ম্লান হয়ে গেছে। হিলারি যে মিথ্যাচার করছে না তা নয়। পররাষ্ট্রমন্ত্রী থাকাকালে তার ই-মেইলের ব্যবস্থা, গোপন তথ্য গ্রহণ ও ধারণের আয়োজন এবং নীতিনির্ধারণী বিষয়ে ভূমিকা সম্পর্কে ভোটারদের কাছে যে বক্তব্য বা ব্যাখ্যা দিয়েছেন, তা বিভ্রান্তিকর ও সত্যের লঙ্ঘন। তবে তার সত্য লঙ্ঘনের চরিত্রটা ট্রাম্পের থেকে ভিন্ন ধরনের। ট্রাম্পের মিথ্যাচারগুলো প্রায়শই কল্পনায় ঠাসা। তবে সমস্যা হচ্ছে নির্বাচনী প্রচারের শেষপর্বে এ মিথ্যাচারগুলো সহজেই সংবাদমাধ্যমে প্রাধান্য বিস্তার করে বসবে এবং ভোটারদের চূড়ান্ত সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করবে। নির্বাচন হয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে যে এটা শেষ হয়ে যাবে তা নয়। হিলারি যদি নির্বাচিত হন তাহলেই যে সত্য ফিরে আসবে এবং মার্কিন প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর জনগণের আস্থা পুনর্প্রতিষ্ঠিত হবে তা নয়। ট্রাম্প হেরে গেলে তার সমর্থকরা বিশ্বাস করবে যে ভোটে কারচুপি করা হয়েছে। কারণ সেভাবেই তাদের বিশ্বাস করানো হয়েছে। আর মানুষ যখন মিথ্যাকেই সত্য বলে বিশ্বাস করে তখন সেটাই সত্য হয়ে দাঁড়াতে শুরু করে। সূত্র : টাইম
×