ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

দারিদ্র্য বিমোচন ৭ম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা

প্রকাশিত: ০৩:৫৪, ৯ অক্টোবর ২০১৬

দারিদ্র্য বিমোচন ৭ম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা

(গতকালের চতুরঙ্গ পাতার পর) এসব কার্যক্রম সুবিন্যস্ত ও অধিকতর শাণিত করার প্রক্রিয়ায় এ কথা মনে রাখতে হবে যেমন, মোট জাতীয় উৎপাদনের বাড়াকে সস্তা ও জনপ্রিয় সেøাগানের বাইরে দারিদ্র্য বিমোচনের সবচেয়ে বড় ভিত্তি বলে এই পরিকল্পনার কাঠামোয় রাখতে হবে। আমাদের মনে রাখতে হবে যে, স্বল্পকালীন আয় হস্তান্তরমূলক পরিশোধন সময়ের ব্যাপ্ত পরিসরে মোট জাতীয় উৎপাদের বাড়াকে দূরে সরিয়ে দারিদ্র্য বিমোচনের কার্যক্রম সফল হতে পারে না। আর্থ-সামাজিক প্রতিরক্ষণের লক্ষ্যে বিস্তৃত কর্মসূচীর ওপর জোর দেয়ার সঙ্গে এ কথা দূরে সরিয়ে দিলে চলবে না যে, ক্রমবর্ধমান দারিদ্র্য বিমোচনে বিতরণীয় উপাদান বিত্তই বিনিয়োগ যোগ্য। বিতরণীয় অর্থনৈতিক উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় খয়রাত দিয়ে সফলতার সঙ্গে গরিবী হটানো সম্ভব হয় না। বিত্তভিত্তিক বিনিয়োগকে দারিদ্র্য বিমোচনীয় প্রকল্পে প্রয়োগ করার প্রক্রিয়ায় এ কথা মনে রাখতে হবে যে, দরিদ্রদের মধ্যে বিশেষ শ্রেণী যথা : নারী, উপজাতীয় লোকগোষ্ঠী, বেদে, হিজড়া এবং দুর্গম চর ও উপকূলীয় এলাকার অধিবাসীদের বিশেষ প্রয়োজন শনাক্ত করে বিনিয়োগ ও সহায়তামূলক পদক্ষেপ লক্ষ্যানুগ। দারিদ্র্য বিমোচনীয় সকল কার্যক্রম ও পদক্ষেপ সফল করার প্রক্রিয়ায় স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান ও সুসংহতকরণ এবং এদের সিদ্ধান্তায়ন প্রক্রিয়ায় দরিদ্রদের অন্তর্ভুক্তকরণ কর্মানুগ হবে। এসব বিষয়ে সুবিন্যস্ত প্রশাসনিক, আর্থিক ও রাজনৈতিক কার্যক্রম সার্বিকভাবে দারিদ্র্য বিমোচনীয় সকল পরিকল্পনায় অন্তর্ভুক্ত করা সমীচীন হবে। ৭ম পরিকল্পনাকালে মোট জাতীয় উৎপাদন বা বিত্ত বাড়ানোর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা দেয়া হয়েছে ব্যক্তি খাতকে। এই পরিকল্পনাকালে ব্যক্তি বিনিয়োগ মোট জাতীয় উৎপাদনের শতকরা ২২ ভাগ হবে বলে প্রক্ষেপিত হয়েছে। ব্যক্তি খাতের বিকাশের জন্য প্রয়োজন হবে ব্যক্তি-সঞ্চয় বাড়ানো এবং বর্ধিত সঞ্চয়কে ব্যাংকিং ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে নিপুণ প্রক্রিয়ায়, নিম্নতম ব্যয়ে উদ্যমী বিনিয়োগকারীর অনুকূলে বিনিয়োগ হিসেবে সঞ্চালন। এই প্রেক্ষিতে ও লক্ষ্যে দেশের ব্যাংক ও আর্থিক ব্যবস্থাকে উন্নত করা এবং পুঁজিবাজারের নিপুণতা বাড়ানোর জন্য বিশেষ কার্যক্রম গ্রহণ করতে হবে। ভেঞ্চার ক্যাপিটাল বা ঝুঁকি মূলধন সরবরাহের লক্ষ্যে বিশেষায়িত ব্যাংক প্রতিষ্ঠাকরণ জরুরী প্রয়োজন হয়ে দাঁড়িয়েছে। সরকারের রাজস্ব এবং প্রশাসনিক ও বাণিজ্যিক আয় অর্জনমূলক কার্যক্রমে নিপুণতা বাড়িয়ে সরকারী সঞ্চয়ের পরিমাণ বাড়াতে হবে। সরকারী বিনিয়োগ খাতে সরকারী সঞ্চয়ের পরিমাণ ব্যক্তি-খাতের সঞ্চয়কে কমিয়ে বা নিরুৎসাহিত না করে যাতে সুসম্পন্ন হতে পারে তার দিকে সচেতন দৃষ্টি রাখতে হবে। এই বিষয়ে পরিকল্পনাবিদদের অধিকতর মনোযোগ দেয়া লক্ষ্যানুগ হবে। ব্যক্তি-খাতের সঞ্চয় ও বিনিয়োগ বাড়ানোর জন্য অন্যান্য উপকরণের সঙ্গে প্রয়োজন হবে যথাযথ আইন প্রণয়ন ও প্রশাসনের মাধ্যমে নাগরিকদের সম্পত্তির অধিকার অধিকতর দ্রুত ও দৃঢ়তার সঙ্গে যথাসম্ভব কম খরচে বলবতকরণ এবং রুগ্ণ শিল্পের পুনর্বাসনের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যিক সংহিতা বা কোডের ১১ পরিচ্ছেদে বিবৃত প্রকল্প বা প্রতিষ্ঠান বিশেষে ব্যবস্থাপনা, বিনিয়োগকারী, শ্রমিক ও মালিকসহ সর্বপাক্ষিক সংস্কার ও ত্যাগ স্বীকারমূলক কার্যক্রম গ্রহণ ও বাস্তবায়ন। সম্পত্তি ও ব্যবসা বাণিজ্যকেন্দ্রিক বিবাদ বা মতপার্থক্য দূরীকরণে সাধারণভাবে বিচার ব্যবস্থা ও প্রক্রিয়াকে দ্রুততর সিদ্ধান্ত দেয়ার মানসিকতা ও উপযুক্ততা সম্পর্কে অধিকতর সচেতন ও সক্ষম করতে হবে। এদিকে এখনও জাতিগতভাবে যথা প্রয়োজন মনোযোগ দেয়া হয়েছে বলা যায় না। ব্যক্তি খাতে সব বিনিয়োগ প্রথম থেকেই লাভ অর্জন করবে এ ধরে নেয়া অবাস্তব। ব্যক্তি খাতে প্রতিষ্ঠিত শিল্প ও ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানে সময়ান্তরিক অসুবিধা বা অলাভজনকতা দূর করার লক্ষ্যে শিল্প বা ব্যবসা বিশেষের পুনর্বাসনের জন্য সংশ্লিষ্ট শ্রমিক, ব্যবস্থাপনা, ব্যাংক বা অর্থ বিনিয়োগকারীর সমন্বিতভাবে নিজ নিজ পাওনা-দেনা, দায়িত্ব ভিন্নতর পরিস্থিতিতে আইনের ভিত্তি ও শক্তি নিয়ে পালন করার প্রক্রিয়া এবং ব্যবস্থা থাকতে হবে। এরূপ আইনী বিধান ভারতে বিদ্যমান। এরই প্রেক্ষিতে ও লক্ষ্যে রুগ্ণ শিল্প ও প্রতিষ্ঠান পুনর্বাসন সংক্রান্ত সুনির্দিষ্ট আইন প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করা ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগকে অধিকতর সাহসী, তৎপর ও টেকসই করবে এবং কর্মসংস্থানের ব্যাপ্তি সংরক্ষণ করে ও বাড়িয়ে দারিদ্র্যবান্ধব কার্যক্রমকে টেকসই করবে বলা যায়। বাংলাদেশে সামষ্টিকভাবে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার কমে এসেছে। এই অর্জন আমাদের সঙ্গে তুলনীয় অন্যান্য দেশের তুলনায় বেশি হওয়া সত্ত্বেও এ কথা স্বীকার করতে হবে যে, স্বল্প ও নিম্নবিত্ত পরিবারের ক্ষেত্রে জন্ম নিয়ন্ত্রণ ও পরিবার কল্যাণমূলক কার্যক্রম যথেষ্ট মাত্রায় বিস্তৃত হয়নি। ফলত দেখা গেছে যে, স্বল্প ও নিম্নবিত্ত শ্রেণীর মধ্যে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার কমানোর পরিধি যথেষ্ট বিস্তৃত। এই অসঙ্গতি দূর করার জন্য পরিবার পরিকল্পনামূলক কার্যক্রম সংশোধন করতে হবে। সময়ের ব্যাপ্ত পরিসরে প্রযুক্তিকে দূরে রেখে বা প্রযুক্তির ক্রম-উন্নয়নকে উৎসাহিত না করে জাতীয় উৎপাদন টেকসইভাবে বাড়ানো সম্ভব নয়। এই প্রেক্ষিতে অর্থ ব্যবস্থার প্রাযুক্তিক উন্নয়ন ও প্রসারণের প্রতি অধিকতর গুরুত্ব দেয়া প্রয়োজন। প্রযুক্তির সৃষ্টি, প্রয়োগ ও ক্রমবর্ধমানতা বিষয়ে অধিকতর সচেতন হওয়ার জন্য দেশের শিল্প ও প্রশিক্ষণ ব্যবস্থায় দ্রুততার সঙ্গে ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে হবে। সমকালের গোলকায়িত পৃথিবীতে প্রযুক্তির এভাবে আহরণ, সৃষ্টিকরণ, প্রয়োগ ও ক্রমবিবর্তনকে যথাযথ গুরুত্ব দেয়ার জন্য ৭ম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার আওতায় অধিকতর সুনির্দিষ্ট কার্যক্রম প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করতে হবে। অর্থ ব্যবস্থায় প্রযুক্তি উন্মুখ তারুণ্য দারিদ্র্য বিমোচনের অন্যরকম ফলদায়ক মাধ্যম হিসেবে কাজ করবে। দারিদ্র্য বিমোচনের লক্ষ্যে বন্যা, খড়া, ঝড়, ভূমিকম্প ইত্যাদি প্রাকৃতিক দুর্যোগের বিপর্যয় থেকে দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে রক্ষাকরণের লক্ষ্যে স্বয়ংক্রিয়ভাবে দ্রুত কার্যশীল ব্যবস্থা বিস্তৃত ও সমুন্নত রাখতে হবে। এক্ষেত্রে ও লক্ষ্যে জননেত্রী শেখ হাসিনার সরকার ইতোমধ্যে যে সফলতা অর্জন করেছে তার আলোকে তাৎক্ষণিকভাবে গ্রহণীয় কার্যক্রমকে প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা দিয়ে অধিকতর শাণিত করতে হবে। প্রথাগতভাবে প্রযুক্ত সামাজিক নিরাপত্তার জাল জাতীয় সামাজিক নিরাপত্তার মৌল কৌশলে উন্নীত করা প্রয়োজন হবে। সাম্প্রতিক ক্রমবর্ধমান বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ বা রিজার্ভ উৎপাদনশীলতার নিরিখে অবকাঠামোমূলক উন্নয়নের জন্য যাতে পরনির্ভরতা কমিয়ে প্রযুক্ত হতে পারে সে দিকে দৃষ্টি দিতে হবে। রফতানিতে প্রদানীয় ভর্তুকি যুক্তিসঙ্গতভাবে সুসংহত করে অবাধে রূপান্তরক্ষম মুদ্রার সঙ্গে টাকার বিনিময় হার যুক্তিসঙ্গত ও বৈষম্যবিহীন করা প্রয়োজন হবে। মনে রাখতে হবে যে, প্রয়োজনবিহীন বা অনুৎপাদনশীল ভর্তুকি প্রদান সরকারের আয়ের অপব্যবহার করে দারিদ্র্য বিমোচনে সরকারের প্রত্যক্ষ ভূমিকাকে ছোট করে ফেলতে পারে। টাকার বিনিময় হার যথা প্রয়োজন নির্ধারণ বা প্রশাসিত করার প্রয়োজনীয়তার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট হয়ে আছে আঞ্চলিক মুক্ত বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক সহযোগিতা সম্পর্কিত চুক্তিতে অংশগ্রহণ এবং এই প্রক্রিয়ায় বাণিজ্য প্রসারণ। সাম্প্রতিক নাফটা (বা উত্তর আমেরিকার মুক্ত বাণিজ্য এলাকা) এর আদলে বিমসটেক ও আন্তঃপ্রশান্তীয় অংশীদারিত্ব (ট্রান্স প্যাসিফিক পার্টনারশিপ) ইত্যাদির আওতায় আঞ্চলিক পর্যায়ে আমাদের করণীয় বা বাণিজ্য ও বিনিয়োগমূলক পদক্ষেপগুলো অচিরেই শনাক্তকরণ প্রয়োজনীয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার আওতায় আঁতেল সম্পত্তি বিষয়ক এবং বাণিজ্য সম্পর্কিত বিনিয়োগ কার্যক্রমের আন্তর্জাতিক তত্ত্বাবধান ও সহযোগিতার ক্ষেত্রে অধিকতর মনোযোগের সঙ্গে আমাদের অগ্রসর হওয়ার লক্ষ্যে যথাযথ পথনির্দেশিকা ৭ম পরিকল্পনাকালে বস্তুনিষ্ঠভাবে শনাক্ত করে এগিয়ে যাওয়ার পরিধি যথেষ্ট বিস্তৃত। পরিকল্পিতভাবে দারিদ্র্য বিমোচনের পথ প্রদর্শকের ভূমিকা পালন করে এসেছেন জননেত্রী শেখ হাসিনা। দারিদ্র্য বিমোচনে, নারীর ক্ষমতায়ন এবং আর্থ-সামাজিক প্রগতির অনুঘটক হিসেবে তিনি আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিপ্রাপ্ত। তার অনুকূলে ইতোমধ্যে প্রতিফলিত জাতির গভীর আস্থার অনুসরণে ৭ম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনাকালে গ্রহণীয় ও বাস্তবায়নীয় পদক্ষেপগুলো উপরোক্তভাবে অধিকতর শাণিত করে বস্তুনিষ্ঠতার ভিত্তিতে জাতির অর্জিত বিত্তকে অধিকতর বিত্ত সৃষ্টি ও তাকে অধিকতর জনকুশল ও কল্যাণমুখী করার ফলপ্রসূ পথে প্রযুক্ত করে দারিদ্র্য বিমোচনের সময়ের ব্যাপ্তিক পদক্ষেপগুলো নিতে আমাদের সকলকে একমত ও দৃঢ় সঙ্কল্পবদ্ধ হতে হবে। এই হবে আমাদের সংবিধানে বঙ্গবন্ধু কর্তৃক সুস্পষ্টভাবে উল্লিখিত সর্ব প্রকার বৈষম্যের ইতি টেনে স্বাধীন সত্তায় সমৃদ্ধি অর্জনের লক্ষ্যে রাষ্ট্রের সব কর্মকাণ্ড পরিচালনের জয়যাত্রা। (সমাপ্ত)
×