ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

নাজনীন বেগম

অসাম্প্রদায়িক চেতনার ধারক লালন রবীন্দ্রনাথ নজরুল

প্রকাশিত: ০৪:৪৩, ৭ অক্টোবর ২০১৬

অসাম্প্রদায়িক চেতনার ধারক লালন রবীন্দ্রনাথ নজরুল

যুগ যুগ ধরে বাংলা ছিল প্রাচীন ভারতের অবিচ্ছেদ্য এবং সম্পদশালী অংশ। ব্রাহ্মণ্যবাদের কঠিন শৃঙ্খল যখন পুরো ভারতবর্ষকে অনড়, স্থবির করে রাখে তখন প্রাচীন বাংলার এর প্রভাব কতখানি তা আমাদের ভাবিত করে। বাংলার শ্যামল উর্বর মাটি, বৈষয়িক ঐশ্বর্যের লীলা ভূমি, ঋতুবৈচিত্র্যের প্রাকৃতিক সম্ভারে সমৃদ্ধ আবহমান বাংলার চিরায়ত নান্দনিকতা বাংলাকে বরাবরই সর্বভারতীয় চেতনাকে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যে উদ্দীপ্ত করে। এই বিশিষ্ট্যতায় বাংলা তথা অবিভক্ত প্রাচীন বাংলার আধ্যাত্মিক দর্শনও ভিন্ন ধাঁচে, অন্যমাত্রায় গড়ে ওঠে। বাংলার নৈসর্গিক এবং বিষয়গত সম্পদ, বাংলার পারিপাশ্বিক অবস্থার মানুষগুলোকেও দেয় এক অপরিমেয় মানবিক শৈল্পিক এবং বিশ্বজনীনতার অপার সুষমা। ধর্মীয় ভাবানুভূতির ক্ষেত্রেও এ প্রভাব লক্ষণীয়। বাংলার এই বিশেষত্বের কথা রবীন্দ্রনাথের দৃষ্টিতে ধরা পড়ে এভাবে ‘নদীর পলি মাটি দিয়ে তৈরি এই বাংলাদেশ, এখানে ভূমি উর্বর। বীজ মাত্রই এখানে সজীব সফল হয়ে ওঠে। তাই এখানে প্রাণধর্মের একটা বিশেষ দাবি আছে। পলি মাটির দেশ বলেই এখানকার ভূমি কঠিন নয়। তাই পুরনো মন্দির প্রাসাদ প্রভৃতির গুরুভার এখানে সয় না। সেই সব গুরুভার এখানে ধীরে ধীরে তলিয়ে যায়। বাংলাদেশে তাই তীর্থ প্রভৃতি বেশি নেই। পুরনো ঐশ্চর্য তার খুবই কম। পুরাতনের মৃত পাষাণভার এখানে না সইলেও জীবনের দাবি দাওয়া এখানে পুরোপুরি সফল (বাংলার সাধনা, ক্ষিতিমোহন সেন)। মহাভারতের পঞ্চপা-ব যে সব দেশে যান বলে কিংবদিন্ত প্রচলিত সে সব অঞ্চলই সভ্যতার স্পর্শ পায় এবং আর্থ সভ্যতার প্রভাবে আসে। সেখানে ব্রাহ্মণ্যধর্ম বিস্তার লাভ করে এবং বর্ণাশ্রম প্রথা তার আসন মজবুত করে। ইতিহাসে বিধৃত আছে রাজা বল্লাল সেন নতুন করে বাংলায় কৌলিণ্য প্রথার প্রবর্তন করেন। ধারণা করা হয় বাংলাদেশ ও অসম সর্বশেষ ব্রাহ্মণ্য ধর্মের প্রভাবে আসে এবং সেটা দ্বাদশ ত্রয়োদশ শতাব্দীর আগে নয়। প্রতœতাত্ত্বি¡ক নিদর্শন থেকে প্রমাণিত হয় খ্রিস্টজন্মের বহু পূর্বেই বাংলাদেশে বৌদ্ধধর্ম প্রচারিত হয়। যেহেতু বাংলাদেশ বৌদ্ধধর্মের উৎপত্তিস্থল বুদ্ধ গয়া বা মগধ থেকে বেশি দূরে নয় সেহেতু বুদ্ধের জীবিতকালে এ দেশে বৌদ্ধধর্মের প্রসার লাভ করে বলে অনুমান। সমকালীন সমাজ ব্যবস্থার স্থবিরতা এবং ধর্মচিন্তার ক্ষেত্রে অদৃষ্টবাদ ও ভক্তিবাদের আশ্রয়ে বর্ণবাদের উচ্চ শ্রেণীর প্রভৃত্বের দাপটে ভগবান বুদ্ধ এক বৈপ্লবিক মতবাদ নিয়ে আবির্ভূত হন। শুধু তাই নয়, পাপপুণ্যের প্রচলিত ধারাকে একজন বিপ্লবীর মতো আঘাত করেন। সাম্যবাদে বিশ্বাসী বুদ্ধের বাণী ছিল কর্মের পথেই মানুষের মুক্তি, ভক্তি ও সংস্কারের পথে নয়। কিন্তু বুদ্ধের তিরোধানের পর তাঁর ধর্ম মূল ধারা থেকে বিচ্ছিন্ন হযে ব্রাহ্মণ্য সংস্কৃতির নানা পূজা ও আচারের আবর্তে পড়ে। নদী বিধৌত বাংলার পলি মাটির কোলে লালিত আবহমান বাঙালীর স্বভাবজাত মানসিক সরলতায় কঠিন বৌদ্ধধর্মের নৈবর্তিক দর্শন বার বার বিবর্তিত হয়ে এখানকার মূল ধারার সঙ্গে মিশে যায়। তবে ধর্ম দর্শন হিসেবে বৌদ্ধধর্মই প্রথম বাংলাদেশে বিস্তার লাভ করে। নৈসর্গিক বৈচিত্র্য বাঙালীর চিত্তকে শুধু ভাবুক আর মননশীলই করেনি, আবহমান বাংলার প্রাকৃতিক শক্তির কাছেও সে হয়েছে সমর্পিতা। অজ্ঞেয় প্রচ- শক্তির কাছে বার বার মাথা নত করেছে। শক্তি মাত্রই উপাস্য এ বোধ থেকে বিভিন্ন শক্তিমান অস্তিত্ব বিশ্বাস করেছে, পূজা করেছে, ভক্তি ভরে শক্তিকে আরাধনা করেছে। আর তাই অতি প্রাচীনকাল থেকে এ অঞ্চলের জনগোষ্ঠী প্রকৃতির উপাসনা করত এবং পাথর, পাহাড়, গাছপালা প্রভৃতিতে দেবত্ব আরোপ করত। এ প্রেক্ষিতে বাঙালীর দর্শন ভাবনায় ও ধর্মে বিভিন্ন দেব-দেবীর আবির্ভাব ঘটে। প্রাকৃতিক শক্তিসহ দেব-দেবীর পূজার মাধ্যমে বাংলায় যে ধর্ম গড়ে ওঠে তা অনেকটা পারিপার্শ্বিক অবস্থার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে এক লোকজধর্মের আরাধনা করত আদিবাসী অস্ট্রিক এই বাঙালী জাতি। বৈষ্ণব দর্শনের গোড়ার কথা প্রেম, ভক্তি ও করুণা, অপরের কল্যাণে আপন স্বার্থ ত্যাগ তথা বিশ্বজনীন প্রেমানুভূতির ওপর বৈষ্ণব দর্শনের ভিত্তি। বাংলার বৈষ্ণব ধর্মের মূল প্রবক্তা শ্রী চৈতন্যদেব (১৪৮৬-১৫৩৩)। তাঁর আবির্ভাবের পূর্বে এ দেশে ছিল ব্রাহ্মণ্য সংস্কৃতির উগ্রতা। নিরস পা-িত্য আর শুদ্ধ আচার অনুষ্ঠান হিন্দু ধর্মকে করে রাখে নির্জীব, গতিহীন। বৌদ্ধধমের্রর প্রভাব ছিল প্রায় লুপ্ত। স্থবিরতার এই দুঃসময়ে কেবল জ্ঞান বুদ্ধিই নয়, প্রয়োজন ছিল অনাবিল হুদয়াবেগ ও অন্তরের অনুভূতি। আর তাই শ্রী চৈতন্য যুক্তি-তর্কের পথ অবলম্বন না করে বেছে নিলেন হৃদয়ের পথ এবং বৈষ্ণব ধর্মকে প্রতিষ্ঠিত করতে চাইলেন প্রেমধর্ম কিংবা ভক্তি ধর্ম রূপে। চৈতন্যদেবের জ্ঞান, ভক্তি ও মানবতার বাণী অবলম্বনে তাঁর পর্ষদরা রচনা করলেন শত সহস্র বৈষ্ণব পদাবলি যা বাংলা সাহিত্যের এক অমূল্য সম্পদ। বাংলার লোকজ সংস্কৃতিতে এর প্রভাব ছিল সুদূরপ্রসারী। যাতে লালন, রবীন্দ্রনাথ এবং নজরুলের মতো আধুনিক ও চিরকালের সাংস্কৃতিক অগ্রনায়করা জীবনভর অনুপ্রাণিত হন। মধ্য যুগে বাংলাদেশে ইসলাম দর্শন এক যুগান্তকারী অধ্যায়। ইসলামিক দর্শন ও তত্ত্বধারা এদেশের জনগণের মধ্যে ক্রমান্বয়ে বিস্তার লাভ করতে থাকে। এখানেও লক্ষণীয় বাংলার প্রাকৃতিক সুষমা এবং আবেগতাড়িত বাঙালী ইসলাম ধর্মের কঠিন দর্শনকে সহজ সরলভাবে গ্রহণ করা প্রবণতা দেখিয়েছে বরাবরই। এভাবে এক সময় মুসলমানরা শুধুমাত্র ধর্মীয় ভাবাদর্শই নয়, বাংলার চিরায়ত ঐতিহ্যগাথা লোককাহিনী নিয়ে নানাবিধ সৃজনশীলতায় নিজেদের সম্পৃক্ত করে। এভাবে নিজেদের উপযোগী করে ধর্ম, সংস্কৃতি, দর্শন থেকে শুরু করে প্রাত্যহিক জীবনের সমস্ত কর্মযজ্ঞ বাঙালী তৈরি করে নেয় অসাধারণ সৃজন ক্ষমতায়। ফলে সর্বশক্তিমানের ওপর আস্থা, নির্ভরতা, ধর্মীয় বিশ্বাসের ওপর অবিশ্বাস্য প্রত্যয়ের পরও বাঙালীর ইতিহাস ব্রিটিশ আসা পর্যন্ত ধর্মীয় উন্মাদনা কিংবা হানাহানির কোন রক্তক্ষয়ী অধ্যায় ছিল না। সে ধারারই সফল কৃতিপুরুষ ফকির লালন সাঁই, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং কাজী নজরুল ইসলামের মতো আরও অনেকে। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনকাল থেকেই এদেশে ব্রিটিশ প্রবর্তিত শিক্ষা, সংস্কৃতি প্রচলিত হতে থাকে। ঊনবিংশ শতাব্দীতে ইউরোপীয় সংস্কৃতির অনুপ্রবেশ অবিভক্ত বাংলায় এক যুগান্তকারী ঘটনা। এই নবজাগরণের সুবর্ণ সময়ে উঠে আসে এ দেশের কতিপয় ব্যক্তিত্ব, আধুনিক পুরুষ যাঁরা বাংলার শিক্ষা-সংস্কৃতিতে নতুন আলোর কিরণ ছড়ালেন। কলকাতাকেন্দ্রিক এই নবজাগরণের ছোঁয়া না পেয়েও কুষ্টিয়ার ফকির লালন সাঁই এই নতুন জোয়ারের একজন কীর্তিমান সাধক। অদ্ভুত সৃজন ক্ষমতায়, আপন বৈশিষ্ট্যে, নিজস্ব ধারায় সঙ্গীতের যে ভূমি রচনা করলেন, সেখানে আজও তিনি সফল ভূস্বামী, বাংলার যুগ যুগ ধরে গড়ে ওঠা অসাম্প্রদায়িক সম্প্রতি, শিকড় থেকে বেড়ে ওঠা লোকজ ধারার যে শক্ত গাঁথুনি তাকেই পাথেয় করলেন ফকির লালন সাঁই। আপন সংস্কৃতির মধ্যে সাঁতরে বেড়ালেন, ডুবে থাকলেন আর একের পর এক তৈরি করলেন মরমী গানের সমৃদ্ধ ভা-ার। ঈশ্বরের প্রতি আকুতি ঝরে পড়ল তাঁর নিবেদিত সঙ্গীতে কোন ধর্মের অনুসারী হয়ে নয়, মানুষ হিসেবে। নিজেকেও কখনও জড়াননি কোন জাত, ধর্ম কিংবা বর্ণের শৃঙ্খলে। বার বার প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে সবাই, এমনকি ঈশ্বরও। জাত আর ধর্ম চেনার উপায় খুঁজেছেন বারে বারে। এক সময় মানুষ হিসেবেই নিজেকে চেনার তাগিদ অনুভব করেছেন ভেতর থেকে। তাই আজও বাংলার মাটি আর মানুষের অস্তিত্বের সঙ্গে মিশে আছে লালনের গান, বাউলের সুর। সাধন-ভজনে ঈশ্বরের স্তুতি গাইলেন, গুরুর আরাধনা করলেন, সর্বমানুষের জয়গান ধ্বনিত হলো, ধর্মকে উপেক্ষা কিংবা অবজ্ঞা না করে জাতপাতের মাঝে নিয়ে আসলেন মিলন আর একাত্মতার সুর। লালনের ধর্ম, বর্ণ ও জাত নিয়ে অনেক রহস্য এবং প্রচলিত ধারণা যার কোনটাই লালন জীবদ্দশায় কখনও আমল দেননি। তার জন্ম নিয়েও রয়েছে অনেক কিংবদন্তি, কল্পকাহিনী। বিভিন্ন লালন গবেষক, বিশেষজ্ঞ তাঁর আলো- আঁধারির জন্মবৃত্তান্ত উদ্ঘাটন করার চেষ্টা করেন। কখনও তাঁকে মুসলমান হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। আবার এটিও বলা হয়ে থাকে তিনি কায়স্থ। শেষোক্ত মতটি বিশিষ্ট সাহিত্যিক মীর মোশাররফ হোসেনের। লালনের গানের ভক্তি, প্রেমের যে রস, মানব বন্দনার যে নির্যাস তা মূলত এদেশীয় ঐতিহ্যিক ধারা। মরমিয়া গানে লালনের যে আকুতি, নিবেদন তাও চিরায়ত বাংলার মূল শিকড়ের সারবত্তা। ফলে মধ্যযুগের শ্রী চৈতন্যদেব ও লালনের সঙ্গীত সাধনায় ঝঙ্কার তোলে, সুর দেয় অমৃতময় বাণী। তাই রাধা-কৃষ্ণের বিরহ, মা যশোদা এবং গৌরপ্রেম নিয়ে লালন ফকিরের কথামালা গাথা, সুরবিন্যাস করা প্রচলিত হিন্দু-মসুলমান, বৌদ্ধ কোন ধর্মেরই আওতায় পড়ে না। সাধক ফকির লালন সাঁই সর্বজীবের প্রেমের বাণী, মানবতার শুদ্ধ জয়গান এবং অদৃশ্য এক সর্বশক্তিমান নিয়ন্ত্রকের কাছে নিজেকে সমর্পন করা, নিবেদন করার আকুতিই তাঁর সঙ্গীতের মূল শৌর্য। ১৮৯০ সালে রবীন্দ্রনাথ কুষ্টিয়ার শিলাইদহে আসেন তার পৈত্রিক জমিদারি দেখাশোনার দায়িত্ব নিয়ে। নগরকেন্দ্রিক নবযুগের হাওয়া, আর ঠাকুরবাড়ি ঐতিহ্যিক পরিম-লের সঙ্গে কবির অদ্ভুত সৃজনশক্তিতে রবীন্দ্রনাথের তৈরি হওয়া প্রথম তিরিশটা বছর ছিল তাঁর জীবনে এক রকম। কিন্তু এর পর গ্রামীণ বাংলার মনোরম রূপমাধুর্য, অপরূপ স্নিগ্ধছায়ায় লালন বাউলের দেশ কুষ্টিয়ার শিকড়ে প্রোথিত আবহমান বাংলার সাস্কৃতিক আবহাওয়া রবীন্দ্রনাথের জীবনে যে স্বর্ণযুগের সূচনা করে তা তার দীর্ঘ জীবনের বহু স্মৃতিতে উজ্জ্বল হয়ে আছে। গানে তো অনেক খানিই, চিন্তা-চেতনায় সৃষ্টিশীলতায় তার প্রভাব ছিল সুদূরপ্রসারী। গ্রাম বাংলার সাধারণ মানুষের নৈকট্য, নিত্যদিনের জীবনযাত্রার সঙ্গে অকৃত্রিম যোগ এবং অনুক্ষণ বাউল সঙ্গীতের প্রেরণা তাঁর সৃজনভা-ারকে যেভাবে পূর্ণ করে তার অনেক ছাপ তাঁর জীবনাচরণে প্রতিভাত হয়। মুসলিম অধ্যুষিত এলাকায় জমিদারি তদারকি করতে গিয়ে হিন্দু-মুসলমান সঙ্কটও কাছ থেকে দেখতে পান। ফলে ধর্মীয় দর্শনেও আসে বৈপ্লবিক সংযোজন। জন্ম ও পারিবারিক সূত্রে কবি ব্রাহ্ম্য ধর্মের বাঁধনে বাঁধা, কিন্তু ভেতর থেকে ছিলেন ধর্মের বাঁধন ছাড়া এক মরমী বাউল। নিজেকে তিনি রবীন্দ্র-বাউলও বলেছেন। হিন্দু-মুসলমান সংঘাত-সংঘর্ষ, জাতিভেদ প্রথা, অভেদ্য বর্ণাশ্রমের কঠিন শৃঙ্খলকে তিনি কখনও মানতে পারেননি। ঠা-া মাথায়, নীরব বিদ্রোহে ভাঙতে চেয়েছেন সে সব শক্ত বাঁধন যা মানুষের মর্যাদাহানি করে, অধিকার নিয়ে বাঁচতে দেয় না, সহজ মিলনের পথে অন্তরায় হয়। শিলাইদহে প্রথম জমিদারের যে রাজসিক অভিষেক নিয়মের ব্যত্যয় ঘটানো হয় সেখান থেকেই। প্রজামিলনের এই দিনে তিনি জমিদারের আসনে না বসে প্রজাদের সঙ্গে চাদও পাতা মেঝের মাঝখানে গিয়ে বসেন। যেমন হতবিহ্বল আমলা-কর্মচারীরা একইভাবে বিস্ময়াভিভূত প্রজারাও। প্রথম দিন জমিদারি দেখতে গিয়ে কাছারি ঘরে দেখেন জাজিমের এক পাস ওল্টানো। প্রশ্ন করলে উত্তর আসে মুসলমান প্রজাদের জন্য এই ব্যবস্থা। সঙ্গে সঙ্গে এই দৃষ্টিকটূ ব্যবধান তিনি উঠিয়ে দেন শিলাইদহে কোরবানির গরু জবাই নিয়ে হিন্দু-মুসলমানের বিরোধও তিনি সূক্ষ্ম বুদ্ধিতে সমাধান করেছিলেন। আর এটাই ছিল তার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের আদর্শিক নমুনা। ‘কালান্তর’ এবং ছিন্নপত্রে’ এসব ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ঘটনা বিধৃত আছে। ১৮৯০ সালে কবি শিলাইদহে আসলেও তার গানে বাউলের সুর আসে ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গে সময়। বাংলা বিভাগকে একদম মানতে পারেননি। শিলাইদহে থাকাকালীন গগন বাউল কবিকে নিয়মিত গান শুনিয়ে যেত। তার মধ্যে একটি বিশেষ গানÑ আমি কোথায় পাবো তারে আমার মনের মানুষ যেরে। গানটির সুর কবির হৃদয়ের নিভৃতে গাঁথা ছিল। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের সময় লিখলেন পরম আবিষ্টতায় আমাদের জাতীয় সঙ্গীতÑ ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি’Ñ আর গুন গুন করতেই ভেতর থেকে ঝঙ্কার দিয়ে ওঠে গগণহরকরার সেই গানের সুর। নিজের মতো করে বসিয়ে দিলেন সে গানের সুর ‘আমার সোনার বাংলায়’। এভাবে অনেক গানে বাউলের সুর দিয়ে বললেনÑ এ সবই রবীন্দ্র বাউলের গান। অর্থাৎ কবি এক ও অভিন্ন বাংলা ও বাঙালীর মূল শিকড় থেকে তুলে আনেন তার সঙ্গীতের নানামাত্রিক উপাদান। যা বাংলার অসাম্প্রদায়িক চেতনাকে বার বার উজ্জীবিত করে। বাংলা ও বাঙালীর জীবন এবং সাহিত্যে আর এক স্বপ্নদ্রষ্টা, নির্ভীক, বিপ্লবী চেতনায় উদ্দীপ্ত, প্রবাদপুরুষ কাজী নজরুল ইসলাম যেভাবে সৃজনশীলতায় দীপ্ত পদচারণা করেন একইভাবে সমাজ জীবনেও বলিষ্ঠ বিদ্রোহীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। নজরুল ইসলামের জন্ম ১৮৯৯ সালে। অতি বাল্যকাল থেকে কিশোর বয়স আর যৌবনের স্বর্ণ অধ্যায়েও জীবন চলে নানা ঘাত-প্রতিঘাত এবং সংগ্রামের বৈতরণী পার হতে হতে। সৃষ্টিশীলতায় যে আনন্দ আর উন্মাদনা সেভাবে চলার পথকেও করেছেন আপন মহিমায়, স্বকীয় বৈশিষ্ট্যে উজ্জ্বল আর নিরন্তর। ঝড়ঝঞ্জায় বিপদে-সঙ্কটে, অন্যায়-অবিচারে কণ্টকাকীর্ণ পথক দুমড়ে, মুচড়ে, ঋজুচিত্তে, অকুতভয়, অজেয় সৈনিকের মতো সমস্ত বাধাকে অতিক্রম করেছেন। অবাদ, মুক্ত আর গতিশীল রবীন্দ্র প্রতিভার বিরাট কালপর্বে বিদ্রোহী কবির জন্ম, বেড়ে ওঠা, সৃষ্টিশীল জগত তৈরি করা আর নিজেকে শক্ত আসনে বাংলা সাহিত্যে ও সমাজে প্রতিষ্ঠা করা। অদ্ভুত সৃজনশক্তি, অজেয় মনোবল আর মানবিকতার দিশারী হয়ে সমকালের সমস্ত ঐশ্বর্যকে দৃপ্তভাবে অতিক্রম করে নিজের স্বকীয়তা বজায় রাখলেন দর্পভরে। আপন বৈশিষ্ট্যে, উন্নত মস্তকে নিজেকে শুধু যে দাঁড় করালেন তা নয়, মানবতার জয়গান গেয়ে সৃষ্টিভা-ার পূর্ণ করলেন। অত্যাচার আর অবিচারের বিরুদ্ধে খড়গ্হস্ত হলেন, জাতি, ধর্ম আর বর্ণের করাল গ্রাসে পিষ্ট সমগ্র দেশকে জাগানোর তাগিদে শক্ত লেখনীর দাগ কাটলেন। মানুষের অসাম্য বৈষম্যকে তীক্ষè বাক্যবাণে বিদ্ধ করলেন ‘মানুষ’ কবিতায়Ñ গাহি সাম্যের গান মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান। নাই দেশ-কাল-পাত্রের ভেদ, অভেদ ধর্ম জাতি, সব দেশে সব কালে ঘরে ঘরে তিনি মানুষের জ্ঞাতি। বিভেদপূর্ণ সমাজের অমানবিক বিরোধগুলো তার শৈল্পিক দ্যোতনায় মূর্ত হয়ে জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সব মানুষের জয়গান ধ্বনিত হলো। আল্লাহর প্রশংসা, রসুলের মহিমা যেমন তার গানে-কবিতায় একইভাবে শ্যামা সঙ্গীত, কীর্তন ও তার সাহিত্যে স্থান করে নেয়। ধর্ম মানুষের জন্য, মানুষ ধর্মের জন্য নয়Ñ এ বাণী স্পষ্ট হয় তার লেখনীর যত্রতত্র। নিজেকে জানা, অন্তরের আলো উদ্ভাসিত করা, হৃদয় নিঃসৃত ভক্তি রসে সত্তাকে পূর্ণ করা নজরুলের ধর্ম সাধনার মহান ভিত্তি। আপন অন্তরে ঈশ্বর, মানুষের মাঝে সৃষ্টিকর্তা এই অনুভবে নজরুল বিশ্ব নিয়ন্তাকে প্রতিনিয়তই নিজের মধ্যে উপলব্ধি করেছেন। ধর্মীয় মৌলবাদ, শ্রেণীবিভক্ত সমাজের উচ্চবিত্তের শাসন-শোষণ, জাত-বর্ণের বিভাজন, অসাম্য-বৈষম্যের নগ্ন থাবায় উদ্বিগ্ন, উৎকণ্ঠিত নজরুল সরল সোজা পথে অমৃতের যে বাণী মানুষের দ্বারে পৌঁছে দেন তা আজও তাকে সর্বোত্তম মানুষের মর্যাদায় আসীন করে। আবহমান বাংলার ঐতিহ্যিক ধারায় অদৃশ্য পরম শক্তির ওপর বিশ্বস্ততা বাংলা ও বাঙালীর জীবনে যে চিরস্থায়ী শুদ্ধতা এনে দেয় যুগ আর সময়ের দীর্ঘ পরিবর্তনের পরও সেই চিরন্তন সত্যের আজ অবধি কোন ব্যত্যয় ঘটেনি। প্রাক-ব্রিটিশ পর্যন্ত বিভিন্ন ধর্মের অনুপ্রবেশ সে ধারাই নব সংযোজন। ঊনবিংশ শতাব্দীজুড়ে লালন ফকিরের ভক্তি রস তারই এক বিশিষ্ট আয়োজন। তারও আগে মধ্যযুগের শ্রী চৈতন্যের আবির্ভাব, প্রেম, ভালবাসা, ভক্তি আর অর্ঘ্যরে এক অবিস্মরণীয় যোগসাজশ। এদেরই সার্থক উত্তরসূরি রবীন্দ্রনাথ ও অসাম্প্রদায়িক চেতনায় ঈশ্বর বন্দনার বাণী নিয়ে হাজির হলেন দেশের সীমানা পার করে বিশ্বের দরবারে। বাংলার চিরন্তন বৈশিষ্ট্যের আধ্যাত্মদর্শনের নমনীয়-কমনীয় ধারা লালন রবীন্দ্রনাথ শান্ত সমুদ্রের মতো ধারণ করলেন। কিন্তু বিংশ শতাব্দীর শুরুতে যে সংঘাতময় আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক পরিস্থিতি সারা বাংলাকে বিপর্যয়ের মুখে ঠেলে দেয় নজরুল তারই যথার্থ কা-ারী। তাই লালন-রবীন্দ্রনাথের মতো ভাবদর্শনে অবগাহন করেও, মরমিয়া আর সুফীবাদের কোমল ধারায় নিজেকে সেভাবে সিক্ত করতে পারেননি। নজরুল হাঁটলেন ব্যতিক্রমী ধারায়, ভিন্ন পথে। অশান্ত ঢেউয়ের বাঁধভাঙ্গা জোয়ার তাঁকে বার বর আলোড়িত করে, তিনি বিক্ষুব্ধ হন, বিদ্রোহী আর বিপ্লবীর ভূমিকায় নিজেকে দাঁড় করান। অসাম্প্রদায়িক চেতনায় সিদ্ধ এই ত্রয়ী কিংবদন্তিই আমাদের সামনে এগিয়ে চলার সাহস যোগাবেন। পথ দেখাবেন।
×