ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

ড. মো. হুমায়ুন কবীর

কলসিন্দুরের আলোই ছড়িয়ে পড়ছে সবখানে

প্রকাশিত: ০৪:০১, ৫ অক্টোবর ২০১৬

কলসিন্দুরের আলোই ছড়িয়ে পড়ছে সবখানে

খেলাধুলায় বেশ এগিয়ে গেছে বাংলাদেশ। তবে তার মধ্যে ক্রিকেটেই সাফল্য সবচেয়ে বেশি। সেখানে ফুটবল, হকি, সাফ গেমস, এসএ গেমস, এএফসি, এমনকি অলিম্পিকের বিভিন্ন ইভেন্টে বাংলাদেশের সাফল্য একেবারে কম ছিল না। এ সময়ের মধ্যে আমরা অজপাড়াগ্রাম কলসিন্দুরের এক ঝাঁক তরুণী ফুটবলার পেয়েছি জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে লড়ার জন্য। এরই মধ্যে আমরা আরও পেয়েছি বাংলাদেশ ক্রিকেটের এক নতুন সম্ভাবনাময় বিস্ময় সাতক্ষীরা এক্সপ্রেস নামে খ্যাত মুস্তাফিজকে। প্রায় এক বছর যাবত বাংলাদেশে ক্রিকেটের কোন আন্তর্জাতিক ম্যাচ হয়নি। তবে এর মধ্যে বাংলাদেশের ক্রিকেটাররা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে গিয়ে তাদের ব্যক্তিগত ক্যারিয়ারের জন্য খেলেছে। এদের মধ্যে আবার কেউ কেউ বিদেশের মাটিতেও নিজেদের ক্রীড়ানৈপুণ্য দেখিয়ে নিজেদের যেমন আলোকিত করেছে, তেমনি দেশের জন্যও সুনাম কুড়িয়ে এনেছে। দীর্ঘ প্রায় এক বছর বিরতির পর সেপ্টেম্বরে শেষ সপ্তাহে আবার বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের জন্য আফগানিস্তানের সঙ্গে একটি তিন ম্যাচ সিরিজের আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টের আয়োজন করা হয়। স্বভাবতই বর্তমানে বাংলাদেশে ক্রিকেট দলের যে ফরম ও দক্ষতা রয়েছে তাতে বাংলাদেশ ক্রিকেট টিমসহ পুরো দেশবাসীর প্রত্যাশা ছিল ক্রিকেট বিশ্বে তুলনামূলক দুর্বল প্রতিপক্ষ হিসেবে আফগানিস্তানকে সহজেই হোয়াইট ওয়াশ করা যাবে। কিন্তু বিধিবাম! প্রথম ম্যাচেই ক্রিকেটপ্রেমীদের মনে এক ধরনের ভয় ধরিয়ে দেয় বাংলাদেশ দল। এর ফলে বেশ কয়েকটি বিষয় সামনে চলে আসে। আর সেগুলো হলো- যুদ্ধের ময়দানে কিংবা খেলার মাঠে শত্রু কিংবা প্রতিপক্ষকে কখনই দুর্বল ভাবতে নেই, আফগানিস্তান ক্রিকেট টিমে পাকিস্তানের অনেক ঝানু ক্রিকেটার সেদেশের হয়ে খেলছেন, কাজেই সে টিমটি মোটেও তত দুর্বল নয় যতটুকু ধারণা করা হয়েছিল, বাংলাদেশ দল কর্তৃক দেশের মাটিতে দীর্ঘদিন যাবত সিরিজ কিংবা টেস্ট খেলার অভিজ্ঞতায় ভাটা পড়েছে। এক বছর আগের ম্যাচগুলোতে ধারাবাহিক বিজয়ে মনের মধ্যে অগাধ আত্মবিশ্বাস সৃষ্টি ইত্যাদি। কিন্তু তারপরও টাইগাররা সিরিজের প্রথম ম্যাচে প্রাণপণে লড়ে শেষ পর্যন্ত খুব কম ব্যবধানে জিতেছে ঠিকই; কিন্তু সৃষ্টি হয়েছে একটি চাপা ভয়ের, যা তাদের পুরো টুর্নামেন্টের শেষ অবধি তাড়া করে বেড়িয়েছে। কারণ, এখানে প্রথম ম্যাচে হারের ফলে হোয়াইট ওয়াশের স্বপ্নে তো কালিমা লেগেছেই, উপরন্তু সিরিজ জেতা নিয়ে দেখা দিয়েছিল সন্দেহ ও আশঙ্কা। দ্বিতীয় ম্যাচটিতে নিয়ন্ত্রণহীনভাবে হেরে যাওয়ায় সে নিরাশা আরও বেশি করে দানা বাঁধতে থাকে। তারপর পহেলা অক্টোবর আসে সেই আশঙ্কাময় দিন, যেদিন সিরিজের জয়-পরাজয় নির্ধারণী খেলাটি অনুষ্ঠিত হয়। কিন্তু সেদিনের খেলা দেখে মনে হলো টাইগাররা তাদের স্বমূর্তিতে ফিরতে শুরু করেছে। আসলে হলোই তাই। ১৪১ রানের বিরাট ব্যবধানে প্রতিপক্ষকে হারিয়ে ২-১ পয়েন্টে জিতে মাশরাফি বিন মুর্তজার দল অভাবনীয় পারফরমেন্স করতে সমর্থ হয়। সেখানে তামিম ইকবাল বেশ কয়েকটি রেকর্ড গড়ে তোলেন। তিনি পুরো ম্যাচজুড়ে দাপিয়ে অনবদ্য ১১টি চার এবং দুটি ছক্কা হাঁকিয়ে শেষ পর্যন্ত ১১৮ বলে ১১৮ রান সংগ্রহ করেন। তিনিই বাংলাদেশের একমাত্র ব্যাটসম্যান যিনি সর্বপ্রথম বাংলাদেশের হয়ে সর্বোচ্চ ওয়ান ডে সেঞ্চুরির এ রেকর্ড সৃষ্টি করলেন। আর টিম হিসেবে বাংলাদেশের জন্য ছিল সেটি দেশের মাটিতে শততম ওয়ান ডে-তে জেতার গৌরব। দলের মনোবল চাঙ্গা করতে এবং স্বমূর্তিতে ফেরার জন্য বাংলাদেশ দলের এ টুর্নামেন্টটি জেতা খুব প্রয়োজন ছিল। তা না হলে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট র‌্যাংকিংয়ে এখন বাংলাদেশের যে অবস্থান সেটাও একটু কমে যেত। তাছাড়া এমনিতেই দেশের অভ্যন্তরে ইতোমধ্যে বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক ম্যাচ নিরাপত্তার অজুহাতে স্থগিত করার প্রক্রিয়ায় ছিল। কিন্তু এরই মধ্যে ইংল্যান্ড ক্রিকেট দল বাংলাদেশের সঙ্গে খেলার জন্য পূর্ব নির্ধারিত সময়সূচী অনুযায়ী এসে পৌঁছেছে। আশার কথা, গণমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হয়েছে ইংল্যান্ড ক্রিকেট টিম বাংলাদেশের গৃহীত নিরাপত্তা ব্যবস্থায় তারা সন্তুষ্ট। এখন বাকিটা নিশ্চয়ই খেলার পর হিসাব-নিকাশ করা যাবে। বর্তমানে ক্রিকেটের যখন আবার এটি নতুন বছর হিসেবে নতুন খেলার মাধ্যমে শুভ সূচনাই হয়েছে, কাজেই এর আগের আরেকটি অন্য ধারার সাফল্যের কথা এখানে উল্লেখ না করলেই নয়। সেটি হলো এএফসি অনূর্ধ্ব-১৬ চ্যাম্পিয়নশীপের মূল পর্বে খেলার জন্য বাছাই পর্বে মহিলা দলের যোগ্যতা অর্জন। ‘সি’ গ্রুপে অপরাজিত চ্যাম্পিয়নের গৌরব অর্জন করতে সমর্থ হয়, দলনেত্রী কৃষ্ণা রানী সরকারের বাহিনী। আগামী বছর অর্থাৎ ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বরে থাইল্যান্ডে অনুষ্ঠিত হবে মূল পর্বের এ প্রতিযোগিতা। সে সময় তাদের প্রতিপক্ষ হিসেবে থাকবে জাপান, চীন, অস্ট্রেলিয়া, উত্তর ও দক্ষিণ কোরিয়া, থাইল্যান্ড ও লাওসের মতো শক্তিশালী টিমর। সেজন্য তাদের উক্ত প্রতিযোগিতার জন্য উপযোগী করে গড়ে তুলতে এসব স্বর্ণ কিশোরীকে সেই কলসিন্দুরের গ্রাম থেকে ঢাকায় এনে বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের তত্ত্বাবধানে প্রস্তুত করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে তাদের এটুকু যোগ্যতা অর্জনের স্বীকৃতিস্বরূপ মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে এসব মেয়েকে ঢাকার পাঁচতারকা হোটেলে সংবর্ধনা দেয়া হয়। ক্রীড়াবান্ধব প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যদি তাদের সংবর্ধনার সময় জাতিসংঘের ৭১তম সাধারণ পরিষদে ভাষণ দেয়ার জন্য যুক্তরাজ্য, কানাডা ও যুক্তরাষ্ট্র সফরে না থাকতেন তাহলে হয়ত এসব স্বর্ণ কিশোরীকে তাঁর সরকারী বাসভবন গণভবনেই যে এ সংবর্ধনার আয়োজন করতেন তাতে কোন সন্দেহ নেই। আর সেই সংবর্ধনায় এসব কোমলমতি মেয়ের জন্য ছিল নগদ আর্থিক ও অন্যান্য প্রণোদনামূলক পুরস্কার এবং সম্মাননা। কোন এক কোম্পানি তাদের জন্য মোবাইল ফোন উপহার দিয়েছে তো অপর কোন কোম্পানি তাদের লেখাপড়ার খরচের দায়-দায়িত্ব নিয়েছে আগামী এক বছরের জন্য। বাফুফে দিয়েছে লেখাপড়ার জন্য হাউস টিউটর সুবিধা, যাতে মেয়েরা তাদের লেখাপড়া চালু রাখতে কোন অসুবিধায় না পড়ে। যা হোক, একটি বিষয় সবাইকে খুব আশ্চর্যান্বিত করেছে যে, রাজধানী নয়, মহানগর নয়, জেলা নয়, এমনকি উপজেলাও নয়, সম্পূর্ণ গ্রাম পর্যায়ের অখ্যাত একটি স্কুলের মহিলা ফুটবল দলের বিখ্যাত কৃতিত্বপূর্ণ অবদান রাখার বিষয়টি ভাবাই যায় না। এরাই আবার বিগত কয়েক বছর যাবত স্কুল পর্যায়ে অনুষ্ঠিত বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের নামে দেশব্যাপী ফুটবল টুর্নামেন্টে চ্যাম্পিয়ন হয়ে স্বর্ণপদক জয়ের গৌরব অর্জন করছে। অথচ সেই কলসিন্দুরের মাটিতেও তাদের কতই না নিগ্রহের শিকার হতে হয়েছে বলে গণমাধ্যমের খবরে প্রকাশিত হয়েছে। স্কুলের নাম কলসিন্দুর। এক সময়ের বাংলাদেশের সতেরো জেলার একটি ছিল ময়মনসিংহ। ময়মনসিংহের পিছিয়ে পড়া একটি এলাকার নাম হলো কলসিন্দুর। সেই ময়মনসিংহের ধোবাউড়া উপজেলার চারদিকে গারো পাহাড় পরিবেষ্টিত একটি অজপাড়া গ্রামের নাম কলসিন্দুর। কিছুদিন আগে থেকে কলসিন্দুর গ্রামটি বেশ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে কৃষ্ণা সরকারদের সাফল্য দিয়ে। কলসিন্দুর গ্রামটি গারো পাহাড়ের পাদদেশে আদিবাসী অধ্যুষিত। সেখানে নেই ঠিকমতো রাস্তাঘাট, নেই যাতায়াতের জন্য কোন ভাল যানবাহন, নেই ভাল কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, নেই কারও পারিবারিক সচ্ছলতা। কিন্তু এতকিছুর অভাবের মধ্যেও নেই কারও কোন অভিযোগ। এরা এখন যেমন এলাকার ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করছে, আগামীতে যে তারা দেশের ভাবমূতি উজ্জ্বল করবে তাতেও কোন সন্দেহ নেই। আর এবারে কলসিন্দুরের মেয়েদের সাফল্য দিয়েই যাত্রা শুরু হলো, যার একটি প্রভাব আফগানিস্তান-বাংলাদেশ সিরিজে লক্ষ্য করা গেছে। তাদের আলোতেই আলোকিত হোক ইংল্যান্ডের সঙ্গে টুর্নামেন্টসহ সামনের বাংলাদেশের সব খেলা। লেখক : ডেপুটি রেজিস্ট্রার, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয় [email protected]
×