ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

দৈন্যের রশিতে বাঁধা পরিবারের পাঁচ শিল্পী

প্রকাশিত: ০৬:২০, ২৪ সেপ্টেম্বর ২০১৬

দৈন্যের রশিতে বাঁধা পরিবারের পাঁচ শিল্পী

মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রথম প্রহর একাত্তরের বিভীষিকাময় ২৫ মার্চ কালরাত ঢাকাস্থ মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল এ্যান্ড কলেজের তৃতীয় শ্রেণীর ছাত্র শাহ আলম বাবা-মায়ের সঙ্গে পালাতে গিয়ে পাক হানাদারের ছোঁড়া গোলা বারুদের ধোঁয়ায় অসুস্থ হয়ে পড়েন। এরপর চিরদিনের জন্য হারিয়ে যায় তাঁর চোখের আলো। ৮ম শ্রেণীতে ওঠার পর সামনের দিকে আর এগোতে পারেননি তিনি। চোখের আলো নিভে যাওয়ার পর অপরের সহযোগিতা ব্যতীত তিনি চলাফেরা করতে পারছিলেন না। বাবা আবদুল আজিজ পাক আমলে রেডিওর শুরু থেকে ঢাকাস্থ চাঁনখারপুল, পরে শাহবাগ কেন্দ্রে চাকরি করতেন। বাবা-মার সঙ্গে শাহ আলম মতিঝিল এজিবি কলোনিতে থাকতেন। লেখাপড়া শুরু করেন, কলোনি সংলগ্ন ‘মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল এ্যান্ড কলেজে।’ বাবার সঙ্গে যেতেন ‘বাংলাদেশ বেতার’ ঢাকা অফিসে। বাবা আজিজ ছিলেন, রেকর্ড শুটার। হাতের কাছেই ছিল, বিভিন্ন শব্দযন্ত্র। হাতের কাছে পেতেন কঙ্গো। বাবার অনুপ্রেরণায় তিনি কঙ্গো বাজানোর দিকে মনোনিবেশ করেন। চোখের আলো না থাকলেও আস্তে আস্তে শুরু করেন কঙ্গো। হাতে খড়ি দেন কঙ্গো বাদক কোরবান আলী। এরপর তবলা, বঙ্গো, নাল এ সবই তিনি রপ্ত করেন। তবে কঙ্গো বাজানোই ছিল তার বেশি পছন্দ। এরপর বাবা চলে গেলেন না ফেরার দেশে। শাহ আলম চলে আসেন, লক্ষ্মীপুরে বাঞ্ছানগরে গ্রামের বাড়িতে। বাবার তেমন সম্পদ ছিল না। লক্ষ্মীপুর জেলা সদরের বাঞ্ছানগরে দুশতক জমির ওপর টিনের দো-চালা ডেরা তাঁর। একটু বৃষ্টি হলে ঘরের ভেতর সব একাকার হয়ে যায়। এর ভেতরেও লেখাপড়ার পাশাপাশি ছেলেমেয়েদের সঙ্গীতচর্চার ঘাটতি নেই। কঙ্গো বাজিয়ে বিভিন্ন অনুষ্ঠান থেকে তাঁর কিছু আয় হতো এক সময়। তা দিয়ে ছেলেমেয়ের লেখাপড়াসহ সংসারের যাবতীয় চাহিদা মেটাতেন। ডিজিটাল যন্ত্র বের হওয়ায় এখন আর তাঁর কদর নেই। তবে এর মাঝেও যান্ত্রিক দলের কাউকে পাওয়া না গেলে তাঁর ডাক পড়ে। তবে তা কালে-ভদ্রে। কোন মতে চলছে জীবন। পাঁচ সন্তানের চারজনই গানের শিল্পী। লক্ষ্মীপুর সরকারী বিশ^বিদ্যালয় কলেজ থেকে বিএসএস পাস করেছে জ্যেষ্ঠ মেয়ে শারমিন চৌধুরী যুথি, কারিগরি স্কুলের ছাত্র একমাত্র ছেলে সাজ্জাদ চৌধুরী বাবু, অপর তিন বোনের মধ্যে ৯ম শ্রেণীতে পড়ুয়া শাহানা চৌধুরী মন ও হুমায়েরা চৌধুরী মীম এবং দ্বিতীয় শ্রেণীর ছাত্রী নুসরাত জাহান কাকন। সবাই গানের শিল্পী। লোক, পপ, আধুনিক, দেশাত্মবোধকসহ সব ধরনের গানেই তাদের দখল রয়েছে। এদের মধ্যে শারমিন জেলা পর্যায়ে তিনবার সঙ্গীত প্রতিযোগিতায় ১ম স্থান অধিকার করেছে। চট্টগ্রাম বিভাগীয় পর্যায়েও একাধিকবার। মীম সঙ্গীতের পাশাপাশি ব্যাডমিন্টনেও জেলা পর্যায়ে প্রথম স্থান অধিকার করার পর চট্টগ্রাম বিভাগীয় পর্যায়ে রানার্স হয়েছে ২০১৪ সালে। গান বাজনা করেই মূলত এ পরিবারটির সংসারের চাকা ঘোরে। এর মাঝে শারমিনের ৬টি অডিও ক্যাসেট ও সিডি বাজারে এসেছে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে, হাফেজ বাবার দরবারে, আইসক্রিম ওয়ালা, অল্প পয়সার কেরানি, ভাইসাব। তবে এ থেকে সামান্য সম্মানী পেয়েছে বলে আক্ষেপ শারমিনের। অপরদিকে মীমকে গেল বছর জেলা শিল্পকলা একাডেমির একমাত্র বাছাই শিল্পী হিসেবে ঢাকা শিল্পকলা একাডেমিতে পাঠানো হয়। সেখানে তার লোক সঙ্গীতের রেকর্ড বের হয়। আর্থিক দৈন্যদশা এবং উপকরণ সঙ্কটের কারণে সম্ভাবনাময় এ পরিবারটি সামনে এগোতে পারছে না। পৃষ্ঠপোষকতা ও প্রয়োজনীয় উপকরণ পেলে সঙ্গীত পরিবারটি ঘুরে দাঁড়াতে পারবে। Ñমহিউদ্দিন মুরাদ, লক্ষ্মীপুর থেকে
×