ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

প্রসঙ্গ ইসলাম ॥ অধ্যাপক হাসান আবদুল কাইয়ূম

পবিত্র হজের তাৎপর্য

প্রকাশিত: ০৬:০০, ৯ সেপ্টেম্বর ২০১৬

পবিত্র হজের তাৎপর্য

আরবের মক্কা নগরীতে অবস্থিত বায়তুল্লাহ বা কা’বা ঘরকে কেন্দ্র করে প্রতিবছর ৮ থেকে ১৩ জিলহজ পর্যন্ত মক্কা শরীফ এবং এর পার্শ্ববর্তী আরাফাত-মুযদালিফা এবং মিনাতে নির্দিষ্ট তারিখে, নির্দিষ্ট সময়ে, নির্দিষ্ট নিয়মে যে সমস্ত বিধি-বিধান পালন করা হয় তাকে হজ বলা হয়। জিলহজ মাসের ওই নির্দিষ্ট তারিখসমূহে আমল বাস্তবায়নের মধ্যে হজের প্রকৃত অর্থ নিহিত রয়েছে এবং হজের তাৎপর্যও তাতেই নিহিত। কা’বা শরীফে যে বিশ্বমানব সভ্যতার ইতিহাসে সর্ব প্রাচীনগৃহ সে সম্পর্কে কুরআন মজীদে ইরশাদ হয়েছে : মানবজাতির জন্য সর্বপ্রথম যে গৃহ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, তা তো বাক্কায় (মক্কার প্রাচীন নাম) যা বরকতময় ও বিশ্বজগতের দিশারী। (সূরা আল-ইমরান : আয়াত ৯৬)। মানব জাতির আদি পিতা হযরত আদম আলায়হিস সালাম প্রথম এই ঘর নির্মাণ করেন। এই ঘর নির্মাণের আগে এর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন ফেরেস্তারা। জানা যায়, এই ঘরের সোজাসুজি উর্ধে সপ্তম আকাশে বায়তুল মামুর নামে ফেরেস্তাদের সালাত আদায় ও প্রদক্ষিণ করার জন্য একটি গৃহ রয়েছে। হযরত নূহ আলায়হিস সালামের সময়কার মহাপ্লাবনে কা’বা শরীফ বিলীন হয়ে গেলেও এর ভিত্তিপ্রস্তর থেকে যায়। হযরত ইবরাহীম আলায়হিস সালামকে আল্লাহ জাল্লা শানুহু এই ঘর পুনরায় স্থাপনের নির্দেশ দেন। তিনি এবং তার জ্যেষ্ঠপুত্র হযরত ইসমাইল আলায়হিস সালাম মিলে এই ঘর পুনর্নির্মাণ করেন। তারা কা’বা গৃহের প্রাচীর যখন গাঁথছিলেন তখন যে দু’আটি পাঠ করেছিলেন সেটি কুরআন মজীদে বিধৃত হয়েছে এইভাবে : স্মরণ করো, ইবরাহীম ও ইসমাইল যখন কা’বা গৃহের প্রাচীর তুলছিল তখন তারা বলেছিল : হে আমাদের রব, আমাদের এই কাজ কবুল করো। (সূরা বাকারা : আয়াত ১২৭)। ঘর নির্মাণ শেষ হলে আল্লাহ জাল্লা শানুহু হযরত ইবরাহীম আলায়হিস সালামকে দুনিয়ার মানুষকে এই গৃহে হজ করার জন্য ঘোষণা দেবার নির্দেশ দেন। হযরত ইবরাহীম (আ) আবূ কুবায়স পাহাড়ের চূড়ায় দাঁড়িয়ে আল্লাহর এই নির্দেশ পালন করার ঘোষণা প্রদান করেন। এ সম্পর্কে কুরআন মজীদে ইরশাদ হয়েছে : আর স্মরণ করো, যখন আমি ইবরাহীমের জন্য নির্ধারণ করে দিয়েছিলাম সেই গৃহের স্থান, তখন বলেছিলাম, আমার সঙ্গে কোন শরিক স্থির করো না বরং আমার গৃহকে পবিত্র রেখো তাদের জন্য যারা তওয়াফ করে এবং কিয়াম করে, রুকু করে সিজদা করে এবং মানুষের নিকট হজেও ঘোষণা করে দাও, ওরা আসবে পদব্রজে, ক্ষীণকায় উটের পিঠে চড়ে, ওরা আসবে দূর-দূরান্ত থেকে দুর্গম পথ অতিক্রম করে। (সূরা হজ : আয়াত ২৬-২৭)। সেই তখন থেকেই অর্থাৎ প্রায় পাঁচ হাজার বছর আগে থেকেই হজ পালিত হয়ে আসছে। বিশ্বমানব সভ্যতার ইতিহাসের সর্বপ্রাচীন মহাসম্মেলনে এই হজ। কিন্তু হযরত ইবরাহীম (আ) আল্লাহর নির্দেশে যে হজের প্রবর্তন করেছিলেন তা এক পর্যায়ে এসে শিরক ও কুফরের দ্বারা আচ্ছাদিত হয়ে যায়, অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে যায় এবং কুসংস্কারে পরিণত হয়। আখেরি নবী, সাইয়েদুল মুরসালিন হযরতে মুহাম্মাদুর রসুুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম এই হজকে পুনরায় তওহীদের ওপর প্রতিষ্ঠিত করেন। নবম হিজরীতে হজ ফরজ ইবাদতের অন্তর্ভুক্ত হয়। হজ ইসলামের পঞ্চবুনিয়াদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়। আল্লাহ জাল্লাহ শানুহু ইরশাদ করেন : সেই সব মানুষের জন্য ওই গৃহে হজ করা অবশ্য কর্তব্য যাদের সেখানে যাবার সামর্থ্য আছে। (সূরা আল ইমরান : আয়াত ৯৭) সেই নবম হিজরী অর্থাৎ ৬৩১ খ্রিস্টাব্দের জিলহজ মাসে শিরকমুক্ত প্রথম হজ পালিত হয়। প্রিয় নবী (সা) মদীনা মনওয়ারা থেকে হযরত আবূ বকর সিদ্দীক রাদিআল্লাহ তা’আলা আনহুর নেতৃত্বে মক্কা শরীফে হজ পালনের জন্য একটি দল পাঠান। এই হজ যাত্রীদের তিনি তওহীদভিত্তিক হজের নিয়ম-কানুন শিক্ষা দিয়ে দেন। পরের বছর তিনি নিজে প্রায় দেড় লাখ সাহাবী নিয়ে হজ করতে মক্কায় যান। লাব্বায়েক, আল্লাহুম্মা লাব্বায়েক, লাব্বায়েকা লা শারিকা লাকা লাব্বায়েক, ইন্নাল হামদা ওয়ান্নিয়ামাতা লাকা ওয়াল মূল্্ক লা শারিকা লাক-হাজির, হাজির, হে আল্লাহ তোমার দরবারে হাজির। তোমার কোন শরিক নেই, নিশ্চয়ই সব প্রশংসা তোমারই, সব নিয়ামত তোমারই, রাজত্ব ও সার্বভৌমত্ব তোমারই, তোমার কোন শরিক নেইÑ এই উচ্চারণে মুখরিত হয়ে ওঠে আকাশ বাতাস, তা ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হয় দিক-দিগন্তে। সেই উচ্চারণ আজও অব্যাহত রয়েছে। লাখ লাখ মানুষের কাফেলা এসে জড়ো হয় মক্কা মুয়াজ্জামায়। ৬৩২ খ্রিস্টাব্দে প্রিয় নবী (সা) প্রায় ১ লাখ চল্লিশ হাজার সাহাবায়ে কেরামের বিশাল কাফিলা নিয়ে হজ করতে যান। সেই ৬৩২ খ্রিস্টাব্দের ৯ জিলহজ শুক্রবার আরাফাত ময়দানে দাঁড়িয়ে সারোয়ারে কায়েনাত তাজেদারে মদীনা হযরত মুহাম্মাদুর রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম যে ভাষণ দিয়েছিলেন তা বিদায় হজের ভাষণ নামে অভিহিত হয়। তিনি সেদিন সমবেত সেই বিশাল জনতাকে উদ্দেশ করে বলেন : আজ অন্ধকার যুগের সকল অন্ধ বিশ্বাস, শিরক, কুফর, অজ্ঞতা ও কুসংস্কার আমার পায়ের তলে দলিত-মথিত হলো। আজকের এই দিনটির মতো, এই মাসটির মতো, এই জনপদের মতো তোমাদের একের ধন দৌলত, জান-প্রাণ ও মান-ইজ্জত অপরের কাছে পবিত্র। তিনি বলেন; হে লোক সকল তোমরা শোনো, তোমরা সবাই ভাই ভাই। কোন কর্তিতনাশা কাফ্রি গোলামও যদি তোমাদের শাসক হয় আর সে যদি আল্লাহ ও তার রসুলের বিধান অনুযায়ী তোমাদের পরিচালিত করে তাহলে তোমরা তাকে মান্য করবে। তিনি সেই দিন মানবতার বিজয় বারতা ঘোষণা করেন। তিনি বলেন : কোন আরবের ওপর কোন অনারবের শ্রেষ্ঠত্ব নেই, কোন অনারবের ওপর কোন আরবের শ্রেষ্ঠত্ব নেই। কোন কালোর ওপর কোন সাদার শ্রেষ্ঠত্ব নেই, কোন সাদার ওপর কোন কালোর শ্রেষ্ঠত্ব নেই। সবাই আদম থেকে এবং আদম মাটি থেকে, শ্রেষ্ঠত্বের মাপকাঠি হচ্ছে তাকওয়া। তার সেই ভাষণে মানবতার মর্যাদা, নারীদের মর্যাদা, দাস-দাসীদের মর্যাদা সমুন্নত হয়ে ওঠে। মানুষে মানুষে ভেদাভেদ দূর করে একটি সমমর্যাদাসম্পন্ন বিশ্ব মানবগোষ্ঠীর রূপরেখা প্রস্ফুটিত হয়ে ওঠে। ইসলামের পরিপূর্ণরূপ সেই ভাষণে উচ্চারিত হয়। সেই ভাষণ শেষে তিনি সবাইকে আলবিদা জানান। এমন সময় আল্লাহর তরফ থেকে ওহী নাযিল হয় : আজ তোমাদের জন্য তোমাদের দীনকে পরিপূর্ণ করলাম আমার নিয়ামতরাজি তোমাদের প্রতি পূর্ণাঙ্গ করে দিলাম এবং ইসলামকে তোমাদের দীন হিসেবে সানন্দ অনুমোদন দান করলাম। (সূরা মায়িদা : আয়াত-৩)। হজের চিরন্তন সৌন্দর্য বিশ্ব ভ্রাতৃত্বের মধ্যে নিহিত রয়েছে। প্রতিবছর একই পোশাকে, একই উদ্দেশ্যে, একই উচ্চারণে, একই নিয়মে, একই সময়ে দুনিয়ার নানা বর্ণের, নানা ভাষার, নানা দেশের মানুষ সমবেত হয় একই অনুভবে আপ্লুত হয়ে মক্কা মুয়াজ্জমায়। কুরআন মাজীদে ঘোষিত হয়েছে : হে মানুষ আমি তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছি এক পুরুষ ও এক নারী হতে। পরে তোমাদেরকে বিভক্ত করেছি বিভিন্ন জাতি গোত্রে। যাতে তোমরা একে অপরের সঙ্গে পরিচিত হতে পার। তোমাদের মধ্যে সেই ব্যক্তিই আল্লাহর নিকট অধিক মর্যাদাসম্পন্ন যে অধিক তাকওয়া অবলম্বনকারী (সূরা হুজুরাত : আয়াত ১৩)। কুরআন মাজীদের এই ঘোষণার স্পন্দন অনুরণিত হয় হজের মধ্যে। বিশ্ব মানবতার এই মহাসম্মেলন বিশ্বমানবাত্মাকে ঐক্য ও সংহতির পথ প্রদর্শন করে শান্তি ও সমৃদ্ধির দুনিয়া গড়ার প্রেরণায় উদ্ভাসিত করে। আড়াই গজ কাপড়ের সেলাইবিহীন একটি লুঙ্গি এবং আড়াই গজ কাপড়ের সেলাইবিহীন একটি চাদর পরিধান করে খালি মাথায় হজের নিয়ত করতে হয় এবং ইহ্্রাম বাঁধতে হয়। জগত-সংসারের সকল চিন্তা-ভাবনা দূরে ঠেলে রেখে আল্লাহর মেহমান হয়ে মক্কা শরীফে যে বিশাল সমাবেশ ঘটে তা জীবন-চেতনায় আল্লাহ্ প্রেমের অপূর্ব মহিমায় ভাস্বর। হজের সমস্ত হুকুম-আহকাম রয়েছে কা’বা শরীফ সাতবার তওয়াফ বা প্রদক্ষিণ করা, সাফা-মারওয়া পাহাড়ের মাঝখানে সায়ী করা, ৮ জিলহজ মিনাতে এসে জোহর, আছর, মাগরিব, ইশা, ফজর নামাজ আদায় করা। ৯ জিলহজ সমালে আরাফাতের উদ্দেশে মিনা ত্যাগ করে আরাফাতে আসা এবং জোহরের ওয়াক্তে আরাফাতে ইমাম সাহেবের খুতবা শোনা, খুতবা শেষে জোহর এবং আছরের কসর নামাজ জামাতের সঙ্গে আদায় করা, সূর্যাস্ত পর্যন্ত আরাফাতে অবস্থান করা, সূর্যাস্তের সঙ্গে সঙ্গে আরাফাত ত্যাগ করে মুযদালিফার উদ্দেশে রওনা হওয়া, মুযদালিফা এসে মাগরিব ও ইশার নামাজ এক সঙ্গে আদায় করা, রাতে মুযদালিফায় অবস্থান করা। এই অবস্থানকালে শয়তানকে মারার জন্য অন্তত পক্ষে ৭০টি ছোট ছোট কঙ্কর সংগ্রহ করা। সকালে সূর্য উদয়ের সামান্য আগে মিনার উদ্দেশে মুযদালিফা ত্যাগ করা, মিনায় পৌঁছে জামরায়ে আকাবাতে গিয়ে শয়তানকে একে একে ৭টি কঙ্কর মারা, কঙ্কর মারা শেষে কোরবানি দেয়া এবং মাথা মু-ন করা, মাথা মু-ন শেষে ইহ্্রাম ছেড়ে দেয়া, ইহ্্রাম ছেড়ে স্বাভাবিক পোশাক পরিধান করা। অতঃপর ঐদিন কিংবা পরের দিন মক্কা শরীফে গিয়ে কা’বা শরীফ তওয়াফ করা, কা’বা শরীফ তওয়াফ করে মিনাতে ফিরে আসা। ১১ জিলহজ ও ১২ জিলহজ প্রত্যেক দিন ছোট, মেজ ও বড় শয়তান তিনটাকে সাতটি করে একে একে কঙ্কর মারা এবং ১২ জিলহজ সূর্যাস্তের পূর্বেই মিনা ত্যাগ করে চলে আসা। এসবের মধ্যেই মহাশৃঙ্খলা উজীবিত হয়ে ওঠে এবং আল্লাহর নিকট পূর্ণ আত্মসমর্পণের মহানিদর্শন পরিস্ফুটিত হয়ে ওঠে। মানব সভ্যতার ইতিহাসের এই সর্বপ্রাচীন ও সর্ববৃহৎ মহাসম্মেলন বিশ্বশান্তির বারতা বহন করে আসছে সুপ্রাচীনকাল থেকে। এই মহাসম্মেলন স্রষ্টার প্রতি সৃষ্টির এবং প্রতি সৃষ্টির দায়িত্ব ও কর্তব্যবোধ জাগ্রত করে দেয়। হক্কুল্লাহ্্ ও হক্কুল্্ ইবাদের মহাপ্রশিক্ষণ লাভ করে হাজীগণ। হজে গিয়ে যে আরেকটি মহাসুযোগ লাভ করে হাজীগণ তা হচ্ছে মদীনা মনওয়ারায় গিয়ে প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ও সাল্লামের রওজা মুবারক জিয়ারত। এ ছাড়া হজ সফরে অনেক ঐতিহাসিক নিদর্শন অবলোকন করে হাজী অন্তরে ইতিহাসের জ্ঞান সঞ্চারিত হয়। হজ বিশ্বমানবতার জন্য এক অনন্য সম্মেলন ব্যবস্থা যা স্বয়ং আল্লাহ জাল্লা শানুহুই নির্ধারণ করে দিয়েছেন। হজের শিক্ষা বিশ্বের প্রতিটি ঘরে পৌঁছে দেয়ার মাধ্যমে বিশ্ব মানবতাকে এক সূত্রে আবদ্ধ করা সম্ভব, অশান্তির পৃথিবীতে প্রকৃত শান্তির হাওয়া প্রবাহিত করা সম্ভব, মানুষ যে আল্লাহর খলীফা বা প্রতিনিধি তা বাস্তবায়ন করা সম্ভব। লেখক : পীর সাহেব, দ্বারিয়াপুর শরীফ উপদেষ্টা, ইনস্টিটিউট অব হযরত মুহম্মদ (সা.) সাবেক পরিচালক, ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ
×