ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

ড. আর এম দেবনাথ

দশ টাকা কেজি দরে চাল ॥ প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ

প্রকাশিত: ০৫:৫৯, ৯ সেপ্টেম্বর ২০১৬

দশ টাকা কেজি দরে চাল ॥ প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ

সারাদেশের মানুষ যখন পবিত্র কোরবানির ঈদ উপলক্ষে ব্যস্ততার মধ্যে দিন কাটাচ্ছে প্রধানমন্ত্রী তখন কুড়িগ্রামে। গত বুধবার সকালে তিনি উত্তরবঙ্গের প্রত্যন্ত অঞ্চলে যান একটি কর্মসূচী উদ্বোধন করতে। কর্মসূচীটি হচ্ছে : ‘হতদরিদ্রদের জন্য খাদ্যবান্ধব কর্মসূচী।’ প্রধানমন্ত্রী আজকাল সব অনুষ্ঠানের উদ্বোধন জায়গায় জায়গায় গিয়ে করেন না। হতদরিদ্রদের জন্য খাদ্যবান্ধব কর্মসূচীটি উদ্বোধন করতে গিয়ে তিনি গেলেন কুড়িগ্রাম। এতেই বোঝা যায় কর্মসূচীটির গুরুত্ব এবং কুড়িগ্রামের গুরুত্ব। কুড়িগ্রাম বাংলাদেশের প্রত্যন্ত একটি অঞ্চল। কয়েকদিন আগের বন্যায় কুড়িগ্রাম মারাত্মভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তাই তিনি খাদ্য কর্মসূচীটি ঐ জায়গা থেকেই উদ্বোধন করলেন। কর্মসূচীটির উদ্বোধন উপলক্ষে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, দেশের একটি মানুষকেও উপোস থাকতে দেয়া হবে না। তিনি কুড়িগ্রাম অঞ্চলের ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের বাসস্থানের ব্যবস্থা করে দেবেন বলেও ঘোষণা দেন। ততোধিক গুরুত্বপূর্ণ আরেকটি অঙ্গীকার প্রধানমন্ত্রীরÑ কুড়িগ্রামে একটি অর্থনৈতিক অঞ্চল (ইকোনমিক জোন) গড়ে তোলা হবে। যে কর্মসূচীটি কুড়িগ্রামের চিলমারী উপজেলার থানাহাট ইউনিয়নে উদ্বোধিত হলো তাতে দেখা যাচ্ছে ঐ জেলার ৯টি উপজেলার এক লাখ ২৫ হাজার ২৭৯টি পরিবার উপকৃত হবে। হতদরিদ্রদের জন্য খাদ্যবান্ধব কর্মসূচীটি সারাদেশের ৫০ লাখ পরিবারকে উপকৃত করবে। প্রতি পরিবারে চারজন করে সদস্য ধরে নিলে এই কর্মসূচীর আওতায় আসবে বাংলাদেশের দুই কোটি অতি দরিদ্র (হার্ডকোর পুওর)। সরকার কর্তৃক প্রকাশিত তথ্যে জানা যাচ্ছে এই কর্মসূচীর অধীনস্থ দরিদ্ররা ১০ টাকা কেজি দরে চাল পাবে। প্রতি মাসে চালের পরিমাণ হবে ৩০ কেজি। বছরের বারো মাস এই চাল দেয়া হবে না। যে পাঁচ মাসে কাজ-কাম কম থাকে সেই সেপ্টেম্বর, অক্টোবর, নবেম্বর এবং মার্চ ও এপ্রিলে বিশেষ এই খাদ্য কর্মসূচীর অধীনে চাল দেয়া হবে। এর জন্য ইতোমধ্যেই দরিদ্রদের চিহ্নিত করে কার্ড বিতরণ করা হয়েছে বলে জানা গেছে। প্রতি ৫০০ পরিবারের জন্য একজন ডিলার থাকবে, যার মাধ্যমে চাল বিতরণ করা হবে। বর্তমানে মোটা চাল বাজারে বিক্রি হয় ৩৫-৩৬ টাকা দরে। এই ভিত্তিতে বলা যায় দরিদ্ররা প্রতি কেজিতে ২৫-২৬ টাকা ভর্তুকি পাবে। এতে ২০১৬-১৭ অর্থবছরে খাদ্য ভর্তুকি বাবদ সরকারের খরচ হবে ২৮২১ কোটি টাকা। আর চালের পরিমাণ সাড়ে পাঁচ লাখ টন। বলা হয়েছে নারীপ্রধান পরিবার, বিধবা, স্বামী পরিত্যক্তা ও পরিত্যক্তা মহিলা এবং শিশুসহ দরিদ্র পরিবারকেই এই কর্মসূচীতে প্রাধান্য দেয়া হবে। কোন দাবি, আন্দোলন ছাড়াই দেখা যাচ্ছে সরকার এই উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। পরিবেশবাদীরা কী হতদরিদ্রদের খাওয়ানোর জন্য কোন আন্দোলন দাবি করেছে? মনে পড়ে না। এতদসত্ত্বেও সরকার এই ধরনের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। এর জন্য আমি প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানাই। সত্যি সত্যি এই খাদ্য কর্মসূচীটি ছিল সময়ের দাবি। দরিদ্র ও অতি দরিদ্ররা এমনিতেই ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় জীবনযাপন করে। এক বেলা, দুই বেলা খেয়ে তারা জীবনযাপন করে; কিন্তু সমস্যা হয় বছরের বিশেষ কয়েকটা মাসে যখন কাজ থাকে না। আবার সমস্যা হয় প্রাকৃতিক দুর্যোগ ঘটলে। ঝড়-বৃষ্টি, খরা, বন্যা ইত্যাদি প্রাকৃতিক কারণে সমাজের কিনারে থাকা মানুষ দারুণ কষ্টে পড়ে যায়। এটা আমাদের দেশের নিত্যদিনের ঘটনা। উত্তরবঙ্গে তো এই সমস্যা ভীষণ প্রকট ছিল কয়েক বছর আগেও। কুড়িগ্রাম ইত্যাদি অঞ্চলে ‘মঙ্গা’ লেগেই থাকত। মানুষের ভাত মিলত না। কাজ নেই, টাকা নেই, খাদ্যও নেই। ভিক্ষা করেও খাবার মিলত না। সেই অবস্থার পরিসমাপ্তি ঘটেছে। এখন আর উত্তরবঙ্গে ‘মঙ্গা’য় মানুষ ভোগে না। সর্বব্যাপী উন্নয়ন কর্মকা-, রাস্তাঘাটের উন্নতি, বঙ্গবন্ধু ব্রিজ নির্মাণ ইত্যাদির ফলে উত্তরবঙ্গ পূর্বাবস্থায় নেই। লাখ লাখ লোক এখন এই ঢাকা শহরেই আছে যারা উত্তরবঙ্গবাসী। এরা রিক্সা চালায়, পোশাক কারখানায় কাজ করে, নির্মাণ শিল্পে কাজ করে এবং কাজ করে শ্রমজীবী হিসেবে। এসবই এখন দৃশ্যমান। হাজার হাজার লোক ‘উত্তরবঙ্গ-ঢাকা’ ‘ঢাকা-উত্তরবঙ্গ’ করে নিয়মিত। প্রচুর ‘ক্যাশ’ যায় এখন উত্তরবঙ্গে। তবে কথা আছে। এর মধ্যে সমস্যা হয় সময় সময়। মানতেই হবে বছরের সব সময় সমানভাবে কাজ থাকে না। তখনই সমস্যা হয়। এই যেমন এখন বন্যা এবার উত্তরবঙ্গ এবং দক্ষিণবঙ্গের প্রচুর ক্ষতি করেছে। মানুষের ঘরবাড়ি গেছে, ফসল নষ্ট হয়েছে, গবাদিপশুর ক্ষতি হয়েছে, বহুদিন কাজের দিন নষ্ট হয়েছে। এ ধরনের মানুষ সারাদেশে এখন লাখ লাখ। এই মানুষের দুই বেলা খাবার দেয়ার জন্যই সরকারের বর্তমান কর্মসূচী। কর্মসূচীর উদ্দেশ্য, আদর্শ, আওতা, খাদ্যের পরিমাণ, ভর্তুকি ইত্যাদির ব্যাপারে কোন প্রশ্ন উঠার কারণ নেই। শত হোক এক নম্বর কাজ মানুষ, দরিদ্র মানুষ বাঁচানো। এই কাজে কোন অবহেলা করা যাবে না। তবে সতর্কতা অবলম্বন করা দরকার বেশকিছু ক্ষেত্রে। এসব কর্মসূচীর একটাই দুর্বলতা। আর সেটা হচ্ছে ‘বেনিফিসিয়ারি’ নির্বাচন। অতি দরিদ্রদের চিহ্নিতকরণ। সাদামাটা চোখে ‘অতিদরিদ্র’ কারা তা যে কেউ বোঝে। কিন্তু সরকারী কর্মকর্তা, ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও মেম্বার, স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তি এবং সর্বোপরি নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে যখন এই ‘দরিদ্র ব্যক্তি’ নির্বাচনের দায়িত্ব যায় তখন বিপত্তি ঘটে। দরিদ্রদের তালিকায় এমন লোকেরও নাম স্থান পায় যা হওয়া কোনভাবেই কাম্য নয়। এটা শুধু খাদ্য কর্মসূচীর ক্ষেত্রে সত্য নয়, সরকারের যে কোন সুবিধা বণ্টনের ক্ষেত্রেই তা সত্য। বিধবার তালিকা তৈরি, স্বামী পরিত্যক্তার তালিকা তৈরি, দুস্থ মহিলার তালিকা তৈরি থেকে শুরু করে যে কোন ভাতা প্রদানের জন্য প্রাপকের তালিকা তৈরির ক্ষেত্রেই গ্রামাঞ্চলে একটা ঝামেলা বাধে। এতে সরকারের সদিচ্ছা নষ্ট হয়, টাকার অপচয় হয়। গ্রামাঞ্চলে তৈরি হয়ে যায় একটি সুবিধাভোগী শ্রেণী। এসব সরকারের জানা সমস্যা। বহু গবেষণায়, জরিপে এসব সমস্যা চিহ্নিত। কিন্তু এর সমাধানের কথা কারও জানা নেই। অথচ যদি ৯০ শতাংশ নিখুঁত তালিকার মাধ্যমে ১০ টাকা কেজি দরে চাল দেয়া যেত তাহলে এর চেয়ে ‘ফরজের’ কাজ আর দ্বিতীয়টি হয় না। আমি সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কে বলব এই তালিকাটি মনিটর করতে। প্রতিনিয়ত এর যাচাই-বাছাই দরকার। তদারকি দরকার হবে ডিলারদের ওপর। এরা পরিমাণমতো চাল সুবিধাভোগী কার্ড হোল্ডারদের দিচ্ছে কি-না তাও গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করা দরকার হবে। কার্ড সংগ্রহের জন্য যদি টাকা খরচ করতে হয় আর ৩০ কেজির জায়গায় যদি ২৫ কেজি চাল পাওয়া যায় তাহলে সরকারের সদিচ্ছার কোন মূল্যই দেয়া হবে না। আশা করি সংশ্লিষ্ট বিভাগ হতদরিদ্রদের চাল নিয়ে কাউকে খেলতে দেবে না। আরেকটি বিষয় এই প্রসঙ্গে বলা দরকার। দরিদ্র, হতদরিদ্র, গরিব-দুঃখী মানুষ কিন্তু সমাজে শেষ হয়ে যাবে না। বাজার অর্থনীতিরই ফসল এরা। উন্নয়নের পাশাপাশিই এদের জন্ম হচ্ছে। সহায়-সম্পদ-ধন কুক্ষিগত হচ্ছে সমাজের এক শতাংশ লোকের হাতে। নিরানব্বই শতাংশই ‘সিস্টেমের’ শিকার। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি শিকার হচ্ছে দরিদ্র ও হতদরিদ্ররা। লোকে বলে ভর্তুকি, সাহায্য ইত্যাদি। এসব দিয়েই এদের বাঁচানো হচ্ছে। আমি মনে করি এটা বাজার অর্থনীতির ‘কাফফারা।’ অন্যায় ও অবিচারের কারণে, বৈষম্যের কারণে সমাজে যাতে বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি না হয় তার জন্য ধনবাদী সমাজকে ‘কাফফারা’ দিতে হয়। আমাদেরও তাই দিতে হবে। তবে শুধু দুই বেলা ভাত দিলেই হবে না। প্রধানমন্ত্রী কুড়িগ্রামে অঙ্গীকার করে এসেছেন সবার বাসস্থানের ব্যবস্থা করা হবে। এর থেকেই বোঝা যায় সংবিধানে প্রদত্ত জনগণের অধিকারগুলো সম্পর্কে তিনি সম্পূর্ণ সচেতন। এমতাবস্থায় নীতিনির্ধারকদের কাজ হবে সর্বাগ্রে ‘দরিদ্র,’ ‘হতদরিদ্র’ ইত্যাদির সংজ্ঞা নিরূপণ করা। আগে বলা হতো দরিদ্রদের ক্রয়ক্ষমতা দিতে পারলেই দারিদ্র্য নির্মূল হবে। কয়েকদিন আগে একটি সেমিনারের আলোচনা পড়লাম। এখন দারিদ্র্য নিয়ে যারা কাজ করেন তারা বলছেন শুধু ক্রয়ক্ষমতা এবং ভাত দিলেই দারিদ্র্য সমস্যার সমাধান হবে না। দরিদ্রদের ভাত নয় শুধু, তার পুষ্টিরও দরকার। মাছ-মাংস, শাক-সবজি, ডিম-দুধ, ফলমূল এসবও তাদের দরকার। যে কুড়িগ্রামে আলোচ্য অনুষ্ঠানটির উদ্বোধন হয়েছে সেখানকার শিশুদের ওজন তুলনামূলকভাবে কম, তারা খর্বকায়। এসব সমস্যার সমাধানও দরকার। যে ভাত সবার আগে দরকার তার ব্যবস্থা হচ্ছে। এর জন্য সরকার ধন্যবাদ পাবে। পাশাপাশি পুষ্টির জন্য দীর্ঘমেয়াদী ব্যবস্থা দরকার। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বাসস্থান ও সাংস্কৃতিক সেবাও গরিব-দুঃখীদের দিতে হবে। বোঝা যায় সরকার এখন এসব দিকেও নজর দিচ্ছে। তবে এক্ষেত্রে বৈষম্য কমিয়ে সেই টাকা দরিদ্রদের সেবায় লাগাতে হবে। তাহলেই উন্নয়ন হবে টেকসই। লেখক : সাবেক শিক্ষক, ঢাবি
×