ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

এপিজি সম্মেলনে উপস্থাপন করা হবে

মানিলন্ডারিং বন্ধে কার্যকর এ্যাকশন প্ল্যান তৈরি

প্রকাশিত: ০৫:৫৬, ৭ সেপ্টেম্বর ২০১৬

মানিলন্ডারিং বন্ধে কার্যকর এ্যাকশন প্ল্যান তৈরি

এম শাহজাহান ॥ বাংলাদেশ থেকে অর্থ পাচার ও সন্ত্রাসে অর্থায়ন বন্ধে একটি কার্যকর এ্যাকশন প্ল্যান তৈরি করা হয়েছে। এ এ্যাকশন প্ল্যানের মূল প্রতিবেদনটি এবার এপিজি সম্মেলনে উপস্থাপন করা হবে। অর্থ পাচার ও সন্ত্রাসে অর্থায়নের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত ১১টি মানদ- রয়েছে। এ মানদ-ে এপিজি গ্রুপ সন্তুষ্ট হলে মানি লন্ডারিংয়ে ঝুঁকিপূর্ণ দেশের তালিকা থেকে বেরিয়ে আসবে বাংলাদেশ। অর্থপাচার-জঙ্গী অর্থায়ন প্রতিরোধে আন্তর্জাতিক সংস্থা এশিয়া প্যাসিফিক গ্রুপ অন মানি লন্ডারিংয়ের (এপিজি) ১৯তম বার্ষিক সম্মেলন সোমবার থেকে যুক্তরাষ্ট্রে শুরু হয়েছে। জঙ্গীদের নেটওয়ার্ক ভেঙ্গে দেয়াসহ তাদের অর্থায়নকারীরা সরকারের নজরদারিতে রয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অর্থপাচার ও সন্ত্রাসে অর্থায়ন বন্ধে এ পর্যন্ত নেয়া সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপে আন্তর্জাতিক গোষ্ঠী ইতিবাচক মনোভাব দেখিয়েছেন। চার দিনব্যাপী এ সম্মেলনের পর্দা নামবে আগামী ৮ সেপ্টেম্বর বৃহস্পতিবার। গত ২৩ জুলাই ঢাকায় এ বৈঠক হওয়ার কথা ছিল কিন্তু নিরাপত্তার কারণে এ বৈঠক স্থগিত করা হয়। জানা গেছে, যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ার সান দিয়াগোতে এপিজির সম্মেলন চলছে। সংস্থাটির এবারের সভায় ৪১টি সদস্য রাষ্ট্রের প্রতিনিধি, আটটি দেশ এবং ২৮টি আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রায় চার শ’ প্রতিনিধি অংশগ্রহণ করেছেন। এ সম্মেলন সফলভাবে সম্পন্ন করার জন্য বাংলাদেশের প্রস্তুতিও ছিল। এজন্য তৈরি করা হয়েছে এ্যাকশন প্ল্যান। সাম্প্রতিক গুলশান ও শোলাকিয়ায় দুই দফা জঙ্গী হামলার কারণে সম্মেলনের সময়সূচী পিছিয়ে দেয়া হয়েছে। এছাড়া ভেন্যুও পরিবর্তন করে বাংলাদেশ থেকে সরিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে করার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। এপিজি হচ্ছে ফিন্যান্সিয়াল এ্যাকশন টাস্কফোর্স (মানি লন্ডারিং) ও সন্ত্রাসে অর্থায়ন প্রতিরোধে নিয়োজিত আন্তর্জাতিক সংস্থার (এফএটিএফ) আঞ্চলিক সংস্থা। এর কাজ হচ্ছে, বিভিন্ন দেশে মানি লন্ডারিং ও সন্ত্রাসে অর্থায়ন প্রতিরোধ সংক্রান্ত আইনী দুর্বলতা ও ঝুঁকি মোকাবিলায় বিভিন্ন নির্দেশনা দেয়ার পাশাপাশি সেগুলো বাস্তবায়নে সহায়তা করা। গত ১৯৮৯ সালে ফিন্যান্সিয়াল এ্যাকশন টাস্কফোর্স (এফএটিএফ) প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকে সংস্থাটি মানি লন্ডারিং ও সন্ত্রাসে অর্থায়ন প্রতিরোধে কাজ করে আসছে। এবারের সম্মেলন বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এ সভাতেই অর্থ পাচার ও সন্ত্রাসে অর্থায়নে বাংলাদেশ ঝুঁকিপূর্ণ দেশের তালিকায় যাবে কিনা, তা নির্ধারিত হবে। অর্থ পাচার ও সন্ত্রাসে অর্থায়নের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত ১১টি মানদ- রয়েছে। এগুলোর মধ্যে যদি কোন দেশ ৯ বা এর অধিক মানদ-ে ‘নিম্ন ও মধ্যম মানে’ থাকে, তাহলে ঝুঁকিপূর্ণ দেশ হিসেবে ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন রিভিউ গ্রুপভুক্ত (আইসিআরজি) হবে। যদি কোন দেশ ৮ বা এর কম মানদ-ে ‘নিম্ন ও মধ্যম মানে’ থাকে, তাহলে সেক্ষেত্রে দেশটি বিশ্বজনীন আন্তঃসরকার সংস্থা ফিন্যান্সিয়াল এ্যাকশন টাস্কফোর্সের (এফএটিএফ) মানদ- পূর্ণভাবে বাস্তবায়নকারী দেশের তালিকায় চলে যায়। বাংলাদেশ ২০১৪ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি আইসিআরজি প্রক্রিয়া থেকে বের হয়ে এফএটিএফ পূর্ণভাবে বাস্তবায়নকারী দেশের তালিকাভুক্ত হয়। জঙ্গী অর্থায়ন নিয়ন্ত্রণ, অর্থ পাচার প্রতিরোধ এবং যেকোন সন্ত্রাসী কর্মকা-ে অর্থায়ন বন্ধে প্রতিবছর এপিজির বার্ষিক সভা করা হয়ে থাকে। এবারের এপিজির বার্ষিক সভায় গুলশান ট্র্যাজেডির জের ধরে জঙ্গী ও জঙ্গী অর্থায়নের বিষয়টি বাংলাদেশকে প্রশ্নের মুখে ফেলতে পারে বলে আশঙ্কা করছে সরকার। তাই জঙ্গী মোকাবিলায় সরকার যেসব পদক্ষেপ নিয়েছে তার একটি ফিরিস্তি তুলে ধরা হবে সম্মেলনে। শুধু তাই নয়, ফিরিস্তিতে মানি লন্ডারিং, সন্ত্রাস এবং সন্ত্রাসে অর্থায়নের ব্যাপারে সরকারের জিরো টলারেন্স মনোভাবের বিষয়টি উল্লেখ করা হয়েছে। পাশাপাশি মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ ও সন্ত্রাসে অর্থায়ন প্রতিরোধে ২০১৫ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত যে কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে তার বাস্তবায়ন অগ্রগতির একটি রূপরেখাও এপিজি বৈঠকে তুলে ধরা হবে। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে অর্থ মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মাহবুব আহমেদ জনকণ্ঠকে বলেন, অর্থপাচার, জঙ্গী ও সন্ত্রাসে অর্থায়ন বন্ধে বাংলাদেশ কঠোর অবস্থান নিয়েছে। এ ব্যাপারে আমাদের প্রস্তুতিও ভাল। আশা করা হচ্ছে, এপিজির বৈঠকে এর সঠিক মূল্যায়ন হবে। তিনি বলেন, গত অক্টোবরে এপিজির একটি দল বাংলাদেশ সফরে এসে অর্থ পাচার ও সন্ত্রাসে অর্থায়ন প্রতিরোধে নেয়া বিভিন্ন পদক্ষেপ ও বাস্তবায়ন খতিয়ে দেখে। এরপর থেকে যেসব জায়গায় সমস্যা ও ঘাটতি ছিল, তা দূর করতে সব ধরনের পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। জানা গেছে, মানি লন্ডারিং ও সন্ত্রাসে অর্থায়নে ঝুঁকিপূর্ণ দেশের তালিকায় চলে যাওয়ার আশঙ্কা দূর করতে দুর্বলতাগুলো কাটিয়ে উঠতে ইতোমধ্যে সংশ্লিষ্টদের নির্দেশনা দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতও। এশিয়া প্যাসিফিক গ্রুপ অন মানি লন্ডারিংয়ের (এপিজি) মিউচুয়াল ইভালুয়েশনের খসড়া প্রতিবেদনে গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি বিষয়ে বাংলাদেশকে ‘লো’ ক্যাটাগরি দেয়া হয়েছে। এ কারণে ঝুঁকি বেড়ে গেছে। মানি লন্ডারিং ও সন্ত্রাসে অর্থায়ন প্রতিরোধে বিভিন্ন দিক-নির্দেশনা এবং নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের লক্ষ্যে গঠিত জাতীয় সমন্বয় কমিটির বৈঠকে এ নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। সেই নির্দেশনা অনুযায়ী এ্যাকশন প্ল্যান তৈরি করা হয়েছে। দেশের মানি লন্ডারিং ও সন্ত্রাসে অর্থায়ন প্রতিরোধে কার্যক্রমের বর্তমান অবস্থা জানতে গত বছরের ১১-২২ অক্টোবর পর্যন্ত সরেজমিন পরিদর্শন করে এপিজি। পরিদর্শনের পর এপিজি একটি খসড়া মূল্যায়ন প্রতিবেদন তৈরি করেছিল। প্রতিবেদনটি আমেরিকায় অনুষ্ঠেয় এপিজির বার্ষিক সভায় অনুমোদনের জন্য উপস্থাপন করা হবে। ওই প্রতিবেদনটিতে ফিন্যান্সিয়াল এ্যাকশন টাস্কফোর্সের (এফএটিএফ) ৪০টি সুপারিশের বিপরীতে ১৪টিতে পার্শিয়ালি কমপ্লায়েন্ট (পিসি), ২০টিতে লার্জলি কমপ্লায়েন্ট (এলসি) এবং ৬টিতে কমপ্লায়েন্ট (সি) রেটিং দেয়া হয়েছে। এ রেটিংগুলো উন্নত দেশের সমতুল্য। কোন কোন ক্ষেত্রে তা উন্নত দেশগুলো থেকেও ভাল। কিন্তু সমস্যা বেধেছে ১১টি ইমিডিয়েট আউটকামের (আইও) ১টিতে সাবস্টেনশিয়াল, ৬টিতে মরডারেট এবং ৪টিতে ‘লো’ লোভেল রেটিং দেয়ায়। বিশেষত যে ৬টিতে মরডারেট রেটিং দেয়া হয়েছে তার মধ্যে অন্ততপক্ষে ২টি রেটিংয়ে উন্নতি করা না গেলে বাংলাদেশ আবার ঝুঁকিপূর্ণ দেশের তালিকাভুক্ত হতে পারে। পাশাপাশি ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন রিভিউ গ্রুপে (আইসিআরজি) হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। যেগুলোতে বাংলাদেশকে মরডারেট রেটিং দেয়া হয়েছে, সেগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো এ্যাটর্নি জেনারেলের অফিস এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মধ্যে পারস্পরিক সমন্বয়ের অভাব। এছাড়া বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) রিপোর্টের ওপর ভিত্তি করে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর কার্যক্রম গ্রহণের স্বল্পতা, মানি লন্ডারিং ও সন্ত্রাসে অর্থায়নের সঙ্গে সম্পর্কিত অপরাধ তদন্তে আর্থিক গোয়েন্দা তথ্য ব্যবহারের ঘাটতি রয়েছে বলে এপিজির খসড়া প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
×