ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

বঙ্গবন্ধুর মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়ার স্মৃতি আজও অম্লান

প্রকাশিত: ০৪:১৭, ২৭ আগস্ট ২০১৬

বঙ্গবন্ধুর মাথায় হাত  বুলিয়ে দেয়ার স্মৃতি আজও অম্লান

সেদিন ছিল শুক্রবার, হাফ স্কুল। ছুটির আগেই স্কুল পালিয়ে শিক্ষার্থীরা সার্কিট হাউসে এসেছে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে। রংপুর সরকারী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের ৭ম শ্রেণীর ছাত্রী জেনিফার বেগম এলিও এসেছে তার কয়েক বান্ধবীকে নিয়ে। এলি বলেন, বঙ্গবন্ধুকে কাছে থেকে এক নজর দেখব, তার কথা শুনব, এ আশায় স্কুল পালিয়ে ইউনিফর্ম পরা অবস্থায় বান্ধবীসহ সার্কিট হাউসে গেলাম। কিন্তু গেটে যেতেই বাধ সাধে পুলিশ। ভেতরে যেতে দিচ্ছে না। জেদ চেপে গেল, যে করেই হোক ভেতরে যেতেই হবে। পরে সার্কিট হাউসের পিছনে গিয়ে দেয়াল টপকে ভিতরে ঢুকতেই পুলিশ তাড়া করে। আমরা দৌড় দিয়ে সার্কিট হাউসের বারান্দায় উঠলাম। সাজেদা চৌধুরী তখন বারান্দায় পায়চারী করছিলেন। সঙ্গে আরও ২/৩ জন। আমাদের পিছনে ধাবমান পুলিশদের নিবৃত করে তিনি আমাদের পরিচয় জানতে চাইলেন। পরিচয় দিয়ে তাকে বলি, বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করব। সাজেদা চৌধুরী বললেন, তিনি তো খুব ব্যস্ত, ভিতরে অনেক লোকের ভিড়। পরে কি যেন ভেবে বললেন, আচ্ছা যাও, তিনি সামনের রুমেই আছেন। মহা আনন্দে আমরা ৪/৫ মেয়ে ওই রুমে ঢুকে পড়লাম। দেখলাম ঘর ভর্তি মানুষের মাঝে বিছানায় কোল বালিশে হেলান দিয়ে বসে আছেন সফেদ পায়জামা-পাঞ্জাবির সঙ্গে মুজিব কোট, চশমা পরা সৌম্যমূর্তি মহামানব। ঠোঁটে চিরচেনা সেই বিখ্যাত সিগারেটের পাইপ। ধরে নিলাম ইনিই বঙ্গবন্ধু। আমরা এক পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম। হঠাৎ তিনি আমাদের দিকে স¯েœহে তাকিয়ে হেসে বললেন, তোরা কাকে চাস? আমাদের মধ্যে একজন বলে, আমরা বঙ্গবন্ধুকে চাই। তিনি আবারও হাসলেন। তারপর জোরে হাক ছাড়লেন, তোফায়েল, দেখ্তো বঙ্গবন্ধু কোথায়? আমি বললাম, আপনিই তো বঙ্গবন্ধু। প্রশ্ন করলেন, তোরা বঙ্গবন্ধুকে চিনিস? বঙ্গবন্ধু মানে কি বলতো? বলে তিনি আমাদের কাছে টেনে নিয়ে আদর করলেন। কি যে ভাল লাগছিল তখন। কেবলই মনে হচ্ছিল আমি কি সত্যিই বঙ্গবন্ধুর সামনে দাঁড়িয়ে? এটি স্বপ্ন না বাস্তব? উপস্থিত বড় বড় নেতাকর্মীদের ভুলে কিছুক্ষণ তিনি আমাদের সঙ্গে হাসি-ঠাট্টায় মেতে উঠলেন, রসিকতা করলেন। তখন না বুঝলেও এখন বুঝতে পারি, শিশুদের প্রতি কতখানি মমত্ববোধ থাকলে এত বড় মানুষ বড় বড় নেতাকর্মীদের ভুলে এভাবে শিশুদের নিয়ে মেতে উঠতে পারেন। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, বঙ্গবন্ধুর কাছে কি চাস তোরা? আমরা সমস্বরে বলে উঠলাম ‘সোনার বাংলা’। তিনি বললেন, শুনেছিস তোফায়েল এদেশের শিশুরাও সোনার বাংলা চায়, কথাটা মনে রাখিস। এলি বলেন, ‘শেষে আমি বললাম, আমরা আপনার অটোগ্রাফ নেব। তিনি মজা করেন। দুষ্টুমি করে বললেন, অটোগ্রাফ আবার কি জিনিস! আমি বললাম, আপনার সিগনেচার। তখন আমার হাতে খাতা-কলম ছিল না বলে এদিক ওদিক তাকাচ্ছিলাম। হঠাৎ তিনি আমার ডান হাত টেনে নিয়ে হাতের তালুতে লিখে দিলেন ‘শেখ মুজিব’। সেই লেখা মুছে যাবে বলে দু’দিন হাত দিয়ে ভাত খাইনি। ডান হাত ধুইনি। কিন্তু আফসোস! বঙ্গবন্ধুর সেই লেখা ধরে রাখতে পারিনি। বঙ্গবন্ধু আমাদের নিয়ে মজা করলেও পার্টির নেতারা বিরক্ত হচ্ছিলেন। তাঁরা বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে কথা বলবেন। ওখান থেকে কেউ একজন বললেন, ‘তোমরা বাইরে যাও।’ ঘর থেকে বের হয়ে বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছি। আবারও সাজেদা চৌধুরীর সঙ্গে দেখা। তিনি বললেন, তোমরা কি গান জানো? ওই যে ওই গানটি, ‘শোন একটি মুজিবুরের থেকে লক্ষ মুজিবুরের কণ্ঠ... গাইতে পার?’ আমরা বললাম হ্যাঁ পারি। এরপর তিনি আমাদের নিয়ে হাততালির সঙ্গে সঙ্গে গানটির কয়েক লাইন গাইলেন। তিনি শিখিয়ে দিলেন বঙ্গবন্ধু বাইরে এলে ওই গানটি গাইবে। এই বর্ণনা দিতে গিয়ে শৈশবে ফিরে গেলেন এলি। আবেগে আপ্লুত ধরা গলায় বলতে লাগলেন, বঙ্গবন্ধু সদলবলে ঘর থেকে বের হতেই আমরা ওই গান ধরলাম। তারপর আমি সেøাগান ধরলাম ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব, মেয়েরা বলল ‘জিন্দাবাদ জিন্দাবাদ’। ‘আমার নেতা, তোমার নেতা, শেখ মুজিব, শেখ মুজিব’ এরকম নানা সেøাগান দিয়ে পরিবেশ মুখরিত করে তুললাম। সেøাগানে লিড দিচ্ছিলাম আমি। বঙ্গবন্ধু বারান্দায় দাঁড়িয়ে সব দেখছিলেন। আমরা বারান্দার বাইরে। বঙ্গবন্ধুর হাতে ফুলের তোড়া ছিল। সেখান থেকে একটি লাল গোলাপ তিনি আমাকে ছুঁড়ে দিলেন। তাঁর দেয়া সেই ফুল পেয়ে আমি আনন্দে আত্মহারা হয়ে যাই। এরপর তিনি বারান্দা থেকে নিচু হয়ে স¯েœহে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করে বললেন, ‘ঘেমে গেছিস তো, এবার থাম, আমাকেও কিছু বলতে দে।’ এরপর শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্যে বললেন, ‘তোরা পড়াশোনা কর, তোরা সবাই মানুষ হ। আমি স্বাধীন বাংলা দিয়েছি, তোরা এটাকে সোনার বাংলা বানাবি। জয় বাংলা।’ Ñআব্দুর রউফ সরকার, রংপুর থেকে
×