ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১১ মে ২০২৪, ২৮ বৈশাখ ১৪৩১

বন্ধ হয়ে যেতে পারে সকল কার্যক্রম

সোনামসজিদ বন্দরে রাজস্ব ঘাটতি তিন শ’ কোটি টাকা

প্রকাশিত: ০৪:০৬, ২৩ আগস্ট ২০১৬

সোনামসজিদ বন্দরে রাজস্ব ঘাটতি তিন শ’ কোটি টাকা

ডি.এম তালেবুন নবী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ॥ দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম স্থলবন্দর সোনামসজিদ কি শেষ পর্যন্ত বন্ধ হয়ে যাবে? বন্ধ হওয়ার একেবারে শেষ সীমানায় দাঁড়িয়ে রয়েছে। ইতোমধ্যেই বন্দরের সকল কার্যক্রম একেবারে বন্ধ না হলেও স্থবির হয়ে পড়েছে। নেই কোন প্রাণচাঞ্চল্য। ব্যবসায়ীদের আনাগোনা শূন্যের কোটায় এসে দাঁড়িয়েছে। কাজ না থাকায় ৩১টি শ্রমিক সংগঠনের সহস্রাধিক শ্রমিক বসে বসে অলস দিন কাঠাচ্ছে। আমদানিকারকরা বন্দর ছেড়ে যাওয়ার কারণে আমদানিকৃত পণ্যবাহী গাড়ির সংখ্যা একেবারে কমে গেছে। সারাদিনে মাত্র কয়েকটি গাড়ি বা ট্রাক প্রবেশ করলেও তা কোন জরুরী পণ্য নয়। পাথরসহ কয়েকটি অপ্রয়োজনীয় পণ্য আমদানি হলেও তারা বাধ্য হয়ে এ বন্দর ব্যবহার করছে। পদ্মা সেতু ও রূপপুর পারমাণবিক কেন্দ্রের অর্ডার পাওয়া কিছু আমদানিকারক বাধ্য হয়ে সোনামসজিদ বন্দর ব্যবহার করছে। কারণ একটাই- এ উপমহাদেশের বৃহত্তম পাথর ভা-ার রয়েছে বিহারের পাকুড়ে। পাকুড় থেকে সোনামসজিদ বন্দর কাছে হওয়ার কারণে এসব আমদানিকারক পাকুড়ের পাথর নিয়ে সোনামসজিদে প্রবেশ করছে। তবে বড় বড় আমদানিকারক ব্যবহার করছে রহনপুর রেলবন্দর। এখান থেকেও পাকুড়ের দূরত্ব প্রায় সোনামসজিদের সমান। তাছাড়া মালামাল (পাথর) আসেও বেশি ও ভাড়া গুনতে হয় কম। বিধায় তারা রেলকে ব্যবহার করছে পাথর বহনের কাছে। আবার বহু আমদানিকারক ইতোমধ্যেই মিয়ানমার থেকে পাথর আমদানিকারকের তালিকায় আসার চেষ্টা করছে। ইতোমধ্যে পদ্মা সেতুর পাথরের চাহিদা পূরণে মিয়ানমারের সঙ্গে চুক্তি হওয়ার কারণে সোনামসজিদ ও রহনপুর রেলবন্দর ব্যবহারকারী পাথর আমদানিকারকরা মিয়ানমার থেকে পাথর আমদানিকারক সাজতে অধিক আগ্রহী হয়ে উঠেছে। এরা মিয়ানমার থেকে পাথর আমদানিতে চলে গেলে সোনামসজিদ বন্দর আরও খাঁ খাঁ করবে। আমদানিকারকদের অভিমত, বহুমুখী সঙ্কটের মধ্য দিয়ে চলছে সোনামসজিদ বন্দর। যেসব পণ্য প্রবেশ করলে অধিক রাজস্ব আসবে, সেসব পণ্য আসা একেবারে বন্ধ হয়ে গেছে। যেমন ফলের মতো পণ্য একেবারে আসছে না। আর এ কারণেই রাজস্ব আদায়ে বড় ধরনের ধস নেমেছে। গত অর্থবছরে (২০১৫-১৬) রাজস্ব ঘাটতির পরিমাণ ৩শ’ কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। আমদানি পণ্য কমে যাওয়ার কারণে রাজস্ব ঘাটতি প্রতি বছর বেড়ে চলেছে। বন্দরের একটি নির্ভরযোগ্য সূত্র নিশ্চিত করেছে কেন সোনামসজিদ বন্দর দিয়ে আমদানি-রফতানিতে ব্যবসায়ীরা আগ্রহ হারাচ্ছে। এখানে উল্লেখ্য, এ বন্দর দিয়ে রফতানি বাণিজ্য অনেক আগেই বন্ধ হয়ে গেছে। একটি সম্ভবনাময় বন্দরকে সুপরিকল্পিতভাবে বন্ধ করার ষড়যন্ত্রে আত্মনিয়োগ করেছে একটি মহল। এরা সিন্ডিকেট করে বন্দরটিতে অচলাবস্থার সৃষ্টি করেছে। এ বন্দরে অনেক আগে থেকেই সক্রিয় রয়েছে রাজস্ব বিভাগের মদদে একটি চাঁদাবাজি চক্র। পণ্যবাহী ট্রাক থেকে বিভিন্ন পয়েন্টে এরা চাঁদাবাজি করে। আমদানিকারকরা চাঁদাবাজিতে অতিষ্ঠ হয়ে বন্দর ছেড়ে চলে যাচ্ছে অন্যত্র। যখন রক্ষক ভক্ষক সেজে সবকিছু গ্রাস করার চেষ্টা করে তখন অস্তিত্ব বিলুপ্ত হতে থাকে ওই প্রতিষ্ঠানের। কাস্টমসের এক শ্রেণীর অসাধুু কর্মকর্তা আমদানি করা পণ্য আটকে রেখে অর্থ আদায় করছে। তাদের দাবিকৃত অর্থ পাই পাই করে পরিশোধ না করলে পণ্য ছাড় দেয়া হয় না। আমদানিকারকদের অভিযোগ, ‘মাইক ওয়ান’ নামের একটি পোস্টবক্স তৈরি করেছে বন্দরের রাজস্ব বিভাগের লোকজন। মাল ছাড়ের জন্য প্রয়োজনীয় কাগজপত্র নিয়ে যাওয়ামাত্র স্বাক্ষর না করে তাদের তৈরি ‘মাইক ওয়ান’ পোস্টবক্সের কাছে যেতে বলে। সেখানে চাহিদামাফিক অবৈধ পয়সা পরিশোধ করার পর গ্রীন সিগন্যাল দিয়ে থাকে কাগজ ছাড়ের। এ ছাড়াও কাস্টমস কর্মকর্তাদের রয়েছে অঘোষিত ক্যাশিয়ার। তিনি সর্বেসর্বা ও অবৈধ পয়সার প্রধান উৎস। তার কাছে যথাযথ চাহিদামাফিক পেমেন্ট না হলে দিনের পর দিন গাড়ি আটকা থাকে। বন্ধ থাকে লোড-আনলোড। এতে ব্যবসায়ীদের অযথা ‘ড্যামারেজ’ গুনতে হয়। এ নির্বিচার চাঁদাবাজিতে অতিষ্ঠ ব্যবসায়ীরা। এছাড়া শ্রমিক সংগঠনের ছড়াছড়ির কারণে ইয়ার্ডে পণ্যবাহী ট্রাক প্রবেশ করামাত্র হামলে পড়ে। মালামাল লোড-আনলোড করে ফিরে যাওয়া পর্যন্ত ধাপে ধাপে চাঁদাবাজি চলে বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠনের নামে। এছাড়া ট্রাক থেকে মালামাল চুরির ঘটনা সাধারণ নিয়মে পরিণত হয়েছে। এ নিয়ে আমদানিকারকরা অভিযোগ তুললে নানাভাবে নানামুখী লাঞ্ছনার শিকার হতে হয়। ফল ও মসলাজাতীয় পণ্য প্রবেশ করলে অনরূপভাবে সিএ্যান্ডএফ এজেন্ট সমিতির নামে চাঁদা ওঠানো হয় ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা। জনৈক প্রভাবশালীর এক ভাই এভাবে চাঁদা ওঠানোর কারণে ওই প্রভাবশালীর পদ-পদবী দুটিই চলে গেলেও বন্দরে চাঁদা ওঠানো বন্ধ হয়নি। এসব নিয়ে সিএ্যান্ডএফ এজেন্ট সমিতির দ্বন্দ্ব খুবই দৃশ্যমান। একই কারণে ভাগ-বাটোয়ারা নিয়ে দ্বন্দ্বের কারণে অতীতে প্রাণ গেছে বা খুন হয়েছেন এক সিএ্যান্ডএফ নেতা। এর পর রয়েছে বন্দরে অবকাঠামোগত দুর্বলতা। বন্দরকে সচল ও প্রাণবন্ত করতে ২০০৫ সালের অক্টোবরে সোনামসজিদ স্থলবন্দরের আমদানি-রফতানি পরিচালনার জন্য বেসরকারী প্রতিষ্ঠান পানামা পোর্ট লিংক লিমিটেডকে চুক্তির মধ্যে এনে কাজ শুরুর নির্দেশ দিলে তারাই এখন ঘাড় মটকাচ্ছে আমদানিকারকদের। সরকারের চুক্তি নীতিমালার অধীন পাঁচ বছরের মধ্যে বন্দরের পরিপূর্ণ অবকাঠামো নির্মাণ করবে। ১৫ বছরেও তা সম্পন্ন হয়নি। অথচ প্রাপ্ত রাজস্বের ৫১ ভাগই তারা নিয়ে যাচ্ছে। খবর নিয়ে জানা গেছে, বন্দরের নিম্নমানের অবকাঠামোর কারণেই ব্যবসা-বাণিজ্যে কোন গতি নেই। ১৯.১৩ একর জমির ওপর বন্দরের কর্মকা- চলছে। এর বাইরেও পানামা আরও ২০ একর জমির প্রয়োজন বলে মনে করে সরকারের কাছে বায়না দিয়ে রেখেছে। তবে বন্দরের বিপুল পরিমাণ জমি এক শ্রেণীর প্রভাবশালীরা দখল করে রাখলেও তাদের উচ্ছেদে ভূমি রাজস্ব বিভাগ ততটা সক্রিয় নয়। সরেজমিন অনুসন্ধানে দেখা গেছে, সোনামসজিদ বন্দরে আমদানি পণ্যের বেপরোয়া চাঁদাবাজির অভিযোগ পানামার বিরুদ্ধেও রয়েছে। ট্রাকপ্রতি ১৫০ টাকা চাঁদাবাজির ভাগ-বাটোয়ারাতে রয়েছে মোট দুটি পক্ষ। এর বাইরেও দ্রুত ট্রাক খালাস বা আনলোড করতে দিতে হয় ২৫০ টাকা। কারা এ টাকা নিয়ে থাকে তা বন্দরের সবার মুখে মুখে। এদিকে ২০১৫ সালের ২৬ মে বন্দর সমন্বয় কমিটির বৈঠকে নৌপরিবহনমন্ত্রীর উপস্থিতিতে আমদানিকারকরা অভিযোগ করেন, বন্দরের অভ্যন্তরভাগের চাঁদার সঙ্গে সঙ্গে বন্দরবহির্ভূতরা বিভিন্ন সংগঠনের নামে ট্রাকপ্রতি বিশাল অঙ্কের টাকা অবৈধভাবে চাঁদার নামে তুলে নিয়ে যাচ্ছে। এসব কারণে বন্দরে আমদানি-রফতানি কমছে। তাৎক্ষণিক অভিযোগের প্রেক্ষিতে জেলা প্রশাসককে প্রধান করে একটি কমিটি গঠনের প্রস্তাব গৃহীত হয়। অজ্ঞাত কারণে তার কোন কার্যকারিতা না থাকায় চাঁদা তোলা বন্ধ হয়নি। এসব চাঁদাবাজির কবলে পড়ছে ভারতীয় ও বাংলাদেশী ট্রাক, যার কারণে আমদানি করা পণ্য নিয়ে কোন ভারতীয় ট্রাক সোনামসজিদে প্রবেশ করতে চাচ্ছে না। সোনামসজিদ বন্দরে সবকিছু উপচে বর্তমানে বড় সমস্যা হয়ে দেখা দিয়েছে কাস্টমস। তারা পরিকল্পিতভাবে ট্রাক থেকে টাকা আদায় করছে যার নাম বিলম্ব চার্জ, যা তাদের পকেটে যাচ্ছে। এছাড়া পণ্যের ওজন কম দেখানোর কারসাজিতে রয়েছে কাস্টমস ও পানামা। তারা যৌথভাবে সুপরিকল্পিতভাবে বন্দরটি ধ্বংস করতে চাচ্ছে।
×