ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

লেখার কিছু না থাকলে ডায়েরি লিখবে...

প্রকাশিত: ০৬:০৮, ১২ আগস্ট ২০১৬

লেখার কিছু না থাকলে ডায়েরি লিখবে...

সূত্রাপুরের লোহার পুলের উপর দিয়ে দ্রুত হেঁটে যাচ্ছি, হঠাৎ পেছন থেকে কে যেন ডাকলো। পেছন ফিরে দেখি, কালোফ্রেমের পুরো চশমা, কাঁধে ব্যাগ, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস ভাই দাঁড়িয়ে আছেন একটি ওষুধের দোকানের শেষ সিঁড়িতে। পরে জেনেছি, ওই দোকানটা গল্পকার শাকের চৌধুরীদের। আমার হাতে তেমন তাড়া ছিল না, একটা ডিগ্রী মহিলা কলেজে মাত্র ক্লাস শেষ করে ফিরে যাচ্ছি, সেই সময় ইলিয়াস ভাইয়ের আহ্বান। সময়টা ১৯৭৬ সালের এপ্রিল মাস। অনার্স শেষ করে রেজাল্টের অপেক্ষায় আছি, এই ফাঁকা সময়টা পুরনো ঢাকার গে-ারিয়ার একটি ডিগ্রী মহিলা কলেজে ইংরেজী পড়াচ্ছি, হাতে দুটো পয়সা পাই, হাত খরচ চলে যায়। শাকেরদের দোকানে আড্ডা জমে উঠলো, চা এলো, ডালপুরি এলো। তখনও ইলিয়াস ভাই তার ‘চিলেকোঠার সেপাই’ কিংবা ‘খোয়াবনামা’ উপন্যাস লেখেননি। মাত্র একটি গল্পগ্রন্থ ‘অন্যঘরে অন্যস্বর’ প্রকাশিত হয়েছে। তিনি অনেকদিন কিছু লিখছেন না। হঠাৎ লেখালেখির প্রসঙ্গ উঠতেই ইলিয়াস ভাই বললেন, ‘প্রতিদিন কিছু না কিছু লিখতে হয়।’ ‘যদি লেখা না আসে, লেখার বিষয় যদি খুঁজে না পাই, তা’হলে? আমি অগ্রজ লেখকের কাছে অপার আগ্রহে জানতে চাইলাম। তিনি বললেন, লেখার কিছু না থাকলেও, ডায়েরি লিখবে, প্রতিদিনের ঘটনা লিখে রাখবে। আর তা’ না হলে জং পড়ে যাবে, আর লিখতে পারবে না। কথাটা আজও আমার কানে বাজে। তিনি চলে গেছেন, কিন্তু তার তাৎপর্যময় কথাগুলো ধ্রুবসত্য হয়ে আজও আমাকে অনুপ্রাণিত করে। ইলিয়াস ভাই দীর্ঘ বিরতির পর আবার একদিন লেখা শুরু করেন। আমরা পেলাম ‘চিলেকোঠার সিপাই’ এবং খোয়াবনামার মতো কালজয়ী উপন্যাস, দুধেভাতে উৎপাত-এর মতো গল্পগ্রন্থ, সংস্কৃতির ভাঙা সেতু’র মতো প্রবন্ধগ্রন্থ। প্রতিদিন কিছু না কিছু লিখতে হয়, যারা দেশ ও জাতিকে সৃজনশীল কিছু দিয়েছেন, তারা প্রতিদিন রুটিন করে নিয়মিত লিখতেন। তবে এটাও ঠিক জীবন জীবিকার প্রয়োজনে চাকরি করে সবসময় প্রতিদিন লেখালেখি চালিয়ে যাওয়া যায় না। একজন মানুষের জীবনে সামাজিকতা রক্ষা করতে হয়, বাজার ও ঘর সংসারের কাজ থাকে, তার ভেতর থেকে দু’এক ঘণ্টা বের করে আনতে সবাই পারে না, কেউ কেউ পারেন। যারা পূর্ণসময়ের লেখক আমাদের দেশে, কিংবা বিদেশে তাদের তো না লিখে উপায় নেই। কিন্তু যারা খ-কালীন, যারা সখের লেখক, যারা মৌসুমী লেখক তাদেরকে সময় বের করে লেখালেখির কাজ করা বেশ কষ্টকর। তবুও অনেকেই এই কষ্টকর কাজটি অত্যন্ত নিপুণভাবে অত্যন্ত সফলতার সাথে করেন। লেখালেখির সাথে পড়াশোনার বিষয়টি যে জড়িয়ে আছে, সেকথাও ইলিয়াস ভাই সেদিন ’৭৬-এর এপ্রিলের সেই শুভ্রসুন্দর সকালে বলেছিলেন। তিনি দেশী-বিদেশী সাহিত্য খুব পড়তেন। ট্রম্যান কপোট-এর হাংগার ছিল তার প্রিয় উপন্যাস। সেসব নিয়ে তুমুল আলোচনা হতো তর্ক বিতর্ক হতো আমার সাথে। আমি তখন ইংরেজী সাহিত্য নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছি।
×