এক সময় আমাদের সমাজে হঠাৎ করে কোন পরিবারের কোন সদস্যের খোঁজ না পাওয়া গেলে প্রতিবেশীরা সহমর্মী হতো, মানুষটিকে খুঁজে বের করার জন্য সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিত। থানা, হাসপাতাল ইত্যাদি সম্ভাব্য স্থানে সন্ধান করত। প্রয়োজনে মাইকে প্রচারের ব্যবস্থা নিত। এখনও মফস্বল শহরে মাইকে ঘোষণা শোনা যায়- একটি নিখোঁজ সংবাদ...। অল্প বয়সী কেউ নিখোঁজ হলে তার স্বজনরা আশঙ্কা করতেন ছেলেধরার হাতে পড়ল কিনা তাদের আদরের ধন! রাগ-অভিমানবশত কেউ স্বেচ্ছায় বাড়ি ছেড়ে চলে গেলে তার খোঁজেও ব্যতিব্যস্ত হয়ে নানা ব্যবস্থা নিতে দেখা যেত। কালে কালে ‘নিখোঁজ’ শব্দের সমার্থক হয়ে উঠল ‘গুম’ শব্দটি। মুক্তিপণ আদায়ের জন্য দুর্বৃত্তরা মানুষ ‘গুম’ করত। সাদা পোশাকধারী সরকারী লোক কিংবা র্যাবের মাধ্যমে গুম হওয়ার ঘটনাও ঘটতে শুরু করল দেশে। এখন পরিস্থিতি বদলেছে। তরুণ বয়সী কেউ নিখোঁজ হলে পরিবার বিষয়টি গোপন রাখার চেষ্টা করেন। ১ জুলাই গুলশানে জঙ্গী হামলার পর পরিস্থিতি আমূল বদলে গেছে। গুলশান আক্রমণের হোতারা পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন ছিলেন। অন্য অর্থে তারা ‘নিখোঁজ’ ছিলেন। নিখোঁজ বুকের ধনেরা রাতারাতি দৃশ্যমান হলেন। বলা যায় তারা আত্মপ্রকাশ করলেন। এই আত্মপ্রকাশ অত্যন্ত ভয়ঙ্কর। নিখোঁজ হলে তবু খুঁজে পাওয়ার বা প্রত্যাবর্তনের একটা সম্ভাবনা থাকে। কিন্তু ফিরে না আসার দেশে পাঠিয়ে দিলে তাকে তো আর ফিরে পাওয়ার আশা থাকে না। ‘নিখোঁজ’ তরুণরা হাজির হলেন অন্যদের সত্যিকারের ‘নিখোঁজ’ করে দেয়ার মিশনে। এখন আমাদের সমাজে ‘নিখোঁজ’ তরুণদের নিয়ে রীতিমতো ভীতি কাজ করছে। শতভাগ না হলেও এসব নিখোঁজ তরুণের বড় একটি অংশই যে জঙ্গী তৎপরতায় আত্মনিয়োগ করেছে, সে বিষয়ে আর সন্দেহ জাগছে না।
আদালত থেকে জামিনপ্রাপ্তদের অনেকেই এখন নিখোঁজের তালিকায়। শনিবারে প্রকাশিত জনকণ্ঠ প্রতিবেদন থেকে জানা যাচ্ছেÑ দেশী দুর্ধর্ষ জঙ্গীদের দিয়েই বাংলাদেশে আইএস শেকড় গাড়ার চেষ্টা করছে। এমন তৎপরতা চলছে তিন বছর ধরে। তারই অংশ হিসেবে অনেক দুর্ধর্ষ জঙ্গীকে বেনামে জামিনে ছাড়িয়ে নেয়া হয়েছে। জামিনপ্রাপ্তরা নিখোঁজ। এদের সঙ্গে যোগ দিয়েছে পাকিস্তান ও আফগানিস্তান থেকে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত জঙ্গীরা, যাদের অধিকাংশ দেশেই আত্মগোপনে রয়েছে।
গত এক মাস যাবত নিয়মিত বিরতি দিয়ে মিডিয়ায় নিখোঁজ তরুণ-তরুণীদের সংবাদ আসছে। আগে থানায় জানাননি এমন অভিভাবকরাও এখন তাদের নিখোঁজ সন্তানদের ব্যাপারে তথ্য দিয়ে থানায় ডায়েরি করছেন। পুলিশও এ ব্যাপারে সক্রিয় হয়েছে, তারাও নিজ উদ্যোগে নিখোঁজদের তালিকা করছে। নিখোঁজ ব্যক্তিদের তত্ত্বতালাশ করতে গিয়ে মিলছে সন্দেহজনক নানা তথ্য। এ যেন কেঁচো খুঁড়তে গিয়ে সাপের দেখা পাওয়ার মতো। একটি পরিবারের একজন সদস্যই শুধু নয়, গোটা পরিবারই চলে গেছে সিরিয়ায় ঘৃণিত আইএসে যোগ দিতে- এমন সংবাদও মিডিয়ায় আসছে। ভাগ্যিস আসছে এবং সমাজ নড়েচড়ে বসছে। ফলে আশা করা যায় নিখোঁজ ব্যক্তিদের ভেতর যারা জঙ্গী মিশনে জড়িয়ে পড়েছে তাদের খুঁজে বের করা খুব কঠিন হবে না। নিখোঁজ ব্যক্তিদের সবাই জঙ্গীবাদে দীক্ষিত এমনটা অনুমান করাও সমীচীন নয়। তবে কাউকেই সন্দেহের বাইরে রাখাও এ মুহূর্তে ঠিক হবে না। অত্যন্ত বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে নিখোঁজ ব্যক্তিদের খুঁজে বের করার চেষ্টা চালাতে হবে। এ লক্ষ্যে সম্ভাব্য সকল উপায়ই অবলম্বন করা চাই। এখনও যারা নিজ সন্তানের নিখোঁজ হওয়ার বিষয়টি আড়াল করে রেখেছেন তাদের শুভবুদ্ধির উদয় হোক এটাই কাম্য। সেইসঙ্গে গোয়েন্দা বাহিনীর সদিচ্ছা, সতর্কতা ও সক্রিয়তা জরুরী, যাতে দেশবাসী আশ্বস্তবোধ করে।
শীর্ষ সংবাদ: