ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

ধরাছোঁয়ার বাইরে আমদানিকারক

নিষিদ্ধ পলিথিনে সয়লাব বরিশাল

প্রকাশিত: ০৪:০৬, ৬ আগস্ট ২০১৬

নিষিদ্ধ পলিথিনে সয়লাব বরিশাল

খোকন আহম্মেদ হীরা, বরিশাল ॥ নিষিদ্ধ পলিথিনে সয়লাব হয়ে গেছে নগরীসহ গোটা বরিশাল। পরিবেশ অধিদফতর থেকে মাঝে মধ্যে অভিযান পরিচালনা করেও থামানো যাচ্ছে না পলিথিনের ব্যবহার। অভিযোগ রয়েছে, নগরীতে পলিথিনের আমদানিকারক প্রভাবশালী এক ব্যক্তি বরাবরেই ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকায় কোনক্রমেই এ নিষিদ্ধ পলিথিন বিক্রি ও ব্যবহার বন্ধ করা যাচ্ছে না। পলিথিন নিয়ে বিশেষ এক অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে নানা চাঞ্চল্যকর তথ্য। নগরীর একাধিক খুচরা বিক্রেতাদের সঙ্গে আলাপকালে বেরিয়ে আসে পলিথিনের একমাত্র আমদানিকারক বাজার রোড এলাকার বরিশাল সেন্টারের মালিক রবীন সেলিমের নাম। নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক খুচরা বিক্রেতা জানান, তারা প্রতিকেজি পলিথিন ২২০ টাকা দরে বরিশাল সেন্টার থেকে ক্রয় করে আনেন। তারা আরও জানান, পরিবেশ অধিদফতর থেকে মাঝে মধ্যে পলিথিন বিরোধী অভিযান চালিয়ে তাদের (খুচরা বিক্রেতা) কাছ থেকে স্বল্প পরিমাণের পলিথিন জব্দসহ জরিমানা করলেও পলিথিনের একমাত্র আমদানিকারক (ডিলার) বরীন সেলিম বরাবরেই রয়ে যাচ্ছেন ধরাছোঁয়ার বাইরে। খুচরা ব্যবসায়ীদের দেয়া তথ্য অনুযায়ী দীর্ঘদিনের অনুসন্ধানে আরও জানা গেছে, নগরীর বিশিষ্টজনদের সঙ্গে গভীর সখ্যতা গড়ে তুলে ও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের অর্থের বিনিময়ে ম্যানেজ করেই রবীন সেলিম কৌশলে দীর্ঘদিন থেকে নিষিদ্ধ পলিথিনের রমরমা ব্যবসা করে আসছেন। এমনকি পরিবেশ অধিদফতরের সদ্য বিদায়ী বিভাগীয় কর্মকর্তা সুকুমার বিশ্বাসের সঙ্গেও তার দহরম মহরমের অভিযোগ রয়েছে। সূত্রমতে, নগরীর বাজার রোড এলাকার মঈন বাবুর কাচারী বাড়ির মধ্যে জনৈক রাজুর গোডাউনে বিপুল পরিমাণ নিষিদ্ধ পলিথিন মজুদ রেখে দীর্ঘদিন থেকে রমরমা বাণিজ্য করে আসছেন বরিশাল সেন্টারের মালিক ও নগরীতে পলিথিনের একমাত্র আমদানিকারক বরীন সেলিম। অভিযোগের ব্যাপারে রবীন সেলিমের সঙ্গে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, আমি আগে এ ব্যবসা করতাম, এখন আর এ ব্যবসার সঙ্গে জড়িত নেই। তিনি নগরীর বিশিষ্ট ব্যক্তিদের ঘনিষ্ঠলোক দাবি করে সংবাদ পরিবেশন না করার জন্য কয়েকজন মিডিয়া কর্মীর মাধ্যমেও এ প্রতিনিধিকে অনুরোধ করেন। এ ব্যাপারে পরিবেশ অধিদফতরের সদ্য বিদায়ী বিভাগীয় কর্মকর্তা সুকুমার বিশ্বাসের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, রবীন সেলিমকে আমি চিনি না এবং তার বিরুদ্ধে পলিথিন আমদানির বিষয়েও আমার জানা ছিল না। আগে জানলে অবশ্যই অভিযান পরিচালনার মাধ্যমে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হতো। পরিবেশ অধিদফতরের সদ্য যোগদান করা বিভাগীয় কর্মকর্তা মোঃ নজরুল ইসলাম বলেন, বিষয়টির খোঁজখবর নিয়ে দ্রুত প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। অনুসন্ধানে আরও জানা গেছে, মিয়ানমার থেকে চোরাই পথে বাংলাদেশে আসা পলিথিনের কারণে দেশীয় শিল্প প্রতিষ্ঠানের উৎপাদিত পাটজাত পণ্যের ব্যবহার বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। প্রশাসনের পক্ষ থেকে মাঝে মধ্যে ভ্রাম্যমাণ আদালত গঠন করে পরিবেশবিরোধী নিষিদ্ধ পলিথিনের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা না নেয়ায় সচেতন মহলের মধ্যে সৃষ্টি হয়েছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া। সরেজমিনে নগরীর বিভিন্ন বাজার ঘুরে দেখা গেছে, প্রতিটি খুচরা পণ্যে বিক্রেতারা বিভিন্ন সাইজের পলিথিন ব্যবহার করছেন। বিশেষ করে তরি তরকারি, মাছ, মাংস ও নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রী বিক্রেতারা নিষিদ্ধ পলিথিন নির্ভর হয়ে বেচা বিক্রি করছেন। জানতে চাইলে নতুন বাজারের মাছ বিক্রেতারা জানান, পলিথিনে মাছ না দিলে বিক্রি হচ্ছে না বিধায় বাধ্য হয়ে পলিথিন রাখতে হচ্ছে। এসব পলিথিন কোথা থেকে সংগ্রহ করেন জানতে চাইলে মাছ বিক্রেতারা জানান, কতিপয় ব্যক্তি বাজারে এসে পলিথিনের প্যাকেট সরবরাহ করছেন। কয়েকদিন ওৎ পেতে থেকে দেখা মেলে কতিপয় ব্যক্তিদের একজন পলিথিন বিক্রেতার সঙ্গে। কৌশলে তার কাছ থেকে নগরীতে পলিথিন আমদানির নানা অজানা তথ্য বেরিয়ে আসে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি বলেন, এসব পলিথিন চোরাকারবারিদের হাত ঘুরে নগরীর বাজার রোড এলাকার বরিশাল সেন্টারে আসে। সেখান থেকে তারা বিভিন্ন কৌশলে নিয়মিত পাইকারি দামে পলিথিন ক্রয় করে এনে খুচরা মূল্যে বিভিন্ন স্থানে সরবরাহ করছেন। পরিবেশবাদীদের মতে, যত্রতত্র পলিথিন ব্যবহারের ফলে এসব পলিথিন ময়লা আবর্জনার সঙ্গে নালা নর্দমায় আটকে গিয়ে পরিবেশ দূষণ করছে। পাশাপাশি বর্ষার সময় পলিথিনের বর্জ্য নগরীর বিভিন্ন ড্রেনে আটকা পড়ে পানি নিষ্কাসনে বাধা সৃষ্টি হয়ে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হচ্ছে। এছাড়াও কৃষি জমিতে পলিথিন পড়ে অক্ষয় অবস্থায় থাকছে। ফলে অর্থকরি ফসল কৃষিজাত পণ্য উৎপাদন আশানুরূপ হচ্ছে না। পরিবেশবীদদের তথ্যমতে, পলিথিনের যাবতীয় বর্জ্য বর্ষাকালে খাল ও নদী হয়ে সরাসরি সমুদ্রে গিয়ে পড়ছে। পরে এসব পলিথিনের বর্জ্য লবণাক্ত পানির সঙ্গে মিশে একাকার হয়ে যাচ্ছে। আবার লবণ চাষীরা সমুদ্রের লবণাক্ত পানি দিয়ে তৈরি করছে রান্নাবান্নার অন্যতম উপাদান লবণ। যা খাবারের সঙ্গে মিশে এসব পলিথিন মিশ্রিত লবণ মানবদেহে প্রবেশ করছে। এতে বিভিন্ন রোগব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে অকালে মানুষ মৃত্যুবরণ করলেও পলিথিন ব্যবহারে কেউ সতর্ক হচ্ছে না। পলিথিন বিক্রি ও ব্যবহারে জেল জরিমানাসহ উভয় শাস্তি বিধিবিধান থাকলেও সংশ্লিষ্ট কতিপয় অসাধু কর্মকর্তাদের অর্থলোভের কারণে রবীন সেলিমের ন্যায় এদেশের অসংখ্য নিষিদ্ধ পলিথিন বিক্রেতারা দীর্ঘদিন থেকে অধিক মুনাফার লোভে এ নিষিদ্ধ পলিথিনের ব্যবসা করে যাচ্ছেন।
×