ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

মুহাম্মদ সামাদ অনূদিত ন্যুয়েন ফান কোই মাই-এর কবিতা

প্রকাশিত: ০৬:২৪, ৫ আগস্ট ২০১৬

মুহাম্মদ সামাদ অনূদিত ন্যুয়েন ফান কোই মাই-এর কবিতা

ভিয়েতনামের যুদ্ধশিশু তারে উচ্চে তুলে ছুড়ে মারে আরেক জগতে অন্য দেশে, অন্য কোলে এই ছিলো হতভম্ব শিশুদের ভাগ্যে অপহরণের আগুনে তাদের ত্বক এখনও ধোঁয়া হয়ে ওড়ে। বাড়ি ফিরে আসে তারা, তারা স্বর্ণকেশী নয়, সাদা নয় তাদের চামড়া তাদের মুখের ভাষা ভিয়েতনামের নয়; খাবারের কোনো দুধ বা মাখন পঁয়ত্রিশ বছর বয়সী এই প্রশ্নের উত্তর দিতে পারে নাÑ আমি কে?! মা-বাবার আলিঙ্গন কোনো দত্তকগ্রহণকারী বাহুর বিকল্প নয় কোনো ডিএনএ টেস্টে তাদের উৎসের যোগসূত্র নেই ভিয়েতনামীদের বেলায় কালো চুল ভাবাই যায় না। যুদ্ধশিশু! বারো হাজার দিনের অশ্রুজল আর পঁয়ত্রিশ বছরের অধিককালের যাতনায় এখনও তাদের দু’চোখ ফেটে যায়। কবিতার শিরোনাম খুঁজে পাইনি এখনো আমার দু’হাত এক বাটি ভাত তুলে ধরে, যার ধান ফলেছিলো সেই মাঠেÑ যেখানে আমার দাদি চিরনিদ্রায় শায়িত। আমার অদেখা দাদির ঘুম পাড়ানি গানের মতোন প্রতিটি ধানের স্বাদ মিষ্টি। দাদিকে শুইয়ে দিয়েছে মাটির নিচে, তার জামাকাপড় ক্ষতবিক্ষত, চামড়া হাড়ের সঙ্গে লেগে গেছে দাদির নরম মুখ আমি কল্পনায় দেখি; উনিশ শ’ পঁয়তাল্লিশের মহাদুর্ভিক্ষে মৃতদেহ সমাহিত করতে আমার গ্রাম কবরের জন্যে খুব ক্ষুধার্ত হয়ে উঠেছিল। দাদির কবর কেউ খুঁজে পায়নি, আমার বাবা দীর্ঘ পঁয়ষট্টি বছর নিয়েছে ভাতের তেতো স্বাদ। আমি আর বাবা আমার দাদির কবরের সামনে দাঁড়াই, পঁয়ষট্টি বছর পরে এই প্রথম ‘মা’ ডাক শুনি আমার বাবার মুখে পেছনের ধানক্ষেত কেঁপে ওঠে। আমার মায়ের ভাত শৈশবের চোখে আমি মাকে দেখি- কাজ করে কাদা ও খড়ের তৈরি রান্নাঘরে। আমার মা ধোঁয়া ওঠা ভাতের হাঁড়িতে একজোড়া চপস্টিক আর আবর্তিত সূর্যালোক নাড়ে; ক্ষুধার্ত অগ্নিশিখাকে যখন সে খাইয়ে দেয় খড়- তার জীর্ণ জামা ভিজে যায় নতুন ধানের ঘ্রাণে; আমি গিয়ে তাকে সাহায্য করতে যেতে চাই, তখন আমার ভিতরের শিশু আমাকে অন্ধকারের এক কোণে টেনে নিয়ে যায় আমি সেখানে মায়ের মুখ দেখি সৌন্দর্যের দ্যুতি ছড়ানোর দীক্ষা পাই কষ্টের ভিতরে, গান গেয়ে গেয়ে ভাত রাঁধা শিখি তার রোদেপোড়া হাতে। সেই দিন কালিঝুলিমাখা ছিল আমাদের রান্নাঘর কড়াই ও হাঁড়িকুড়ির সুন্দর আয়োজন যাপরনেই কৃশকায় আমার মায়ের আনমিত পিঠ, আমার চিৎকার আর কান্নায় মা যেন মিলিয়ে যায়। আঁকশির তারকারা [হ্যানয়ের রাস্তার হকারদের জন্য] মেয়েরা আমার কাছে নিয়ে আসে মৌসুমের তাল আম ও পেয়ারা, কাঁধের ওপরে পদ্মফুল, কচি নতুন ধানের মিষ্টি ভাত, আলোকিত সূর্যোদয় আর নীল সূর্যাস্তে আমাকে নিয়ে, চপ্পলের দাগ ফেলে পথে পথে হেঁটে যায়। খুব অল্প দামে আমি পেয়ারা ও পদ্মফুল কিনি কাগজের পাতি নোটেরা নীরবে শুষে নেয় শিশির ও ঘাম। মেয়েদের পিছনে পিছনে গাঁয়ের মাঠের অনাথ হাওয়া একটানা আর্তনাদ করে। তারা আলিঙ্গনে মেলে ধরে : ঘুম পাড়ানিয়া গান, দুধের উছলে ওঠা ফেনা, অগণন কুমারী ঋতুর স্বাদ। হুন ইয়েন থেকে ছুটে আসে মধুর সুবাস পশ্চিম হ্রদের পদ্মফুল হয়ে ওঠে রক্তলাল কচি নতুন ধানের ফলনে উতলা হয় ভং গ্রাম। তাদের গাঁয়ের নির্মল বাতাস বয়ে এনে তারা আমাকে উপঢৌকন দেয় যেখানে প্রতীক্ষা করে আছে তাদের মা, স্বামী ও সন্তান যেখানে স্বপ্ন ও সংগ্রাম পিপাসার্ত। আমি সেখানে অস্পষ্ট সঙ্গীত শুনি : [বিপদের দিনে আঁকশি আমার কাঁধ জোরে ঠেসে ধরে আমি মাকে খাওয়ানোর পথ খুঁজে পাই বিদ্রুপ উপেক্ষা করে]* আমার তারকা তারা আমার দু’চোখে আলোড়িত কৈফিয়ত টের পেয়ে কাঁধে করে বয়ে নিয়ে যায় তাদের দুর্ভাগ্য অজানা জীবনে। *ভিয়েতনামের লোক কবিতা বাংলাদেশের পোশাককর্মী নিহত বায়ান্ন জন! এক শ’! আড়াই শ’! তিন শ’ সত্তর! ছয় শ’ পেরিয়ে হাজারের বেশি! পাতা উল্টালেই প্রতিদিন খবরের কাগজে বাংলার নারীদের সুন্দর মুখ দুমড়ে-মুচড়ে স্থির হয়ে যায় আমার দু’চোখে। বছর কয়েক আগে, আমি তখন অতিথি ছিলাম ওদের শহরে, ঢাকায়, খুব ভোরে আমার বাড়িতে আলো পড়বার আগে ওরা হেঁটে যেত জনাকীর্ণ পথে পদচিহ্ন রেখে। পর্দার ওপারের ভিন্ন পৃথিবীতে ওদের ভেবেছি আমি তবে, ওরা দায়ভার তুলে নিয়েছিল চোখের গভীরে যখন ওদের সালোয়ার-কামিজের ওপরের ওড়নারা মৃদুমন্দ হাওয়ায় উড়তে থাকত তখন ওদের বাদামি চিবুকে আমি দেখেছিলাম আশার আলো এখনও দেখি আমিÑপশ্চিমের মানুষদের হাতের ময়লায় কেনা জামা-কাপড়ের মধ্যে ধৈর্য স্থিরতা কঠোর শ্রমের সুঁই দিয়ে ওরা কীভাবে সেলাই করে জীবনের তালি-তাপ্পি; যেহেতু লোভের ভার নষ্ট করে বোধশক্তি, ধুলো-ময়লায় গাদাগাদি হয়ে ওদের হাতেরা এখনো সেলাই করে; শিশুর কান্না থামানোর ঘুম পাড়ানিয়া গান ওদের হৃদয়ে জুড়ে নীরব সঙ্গীত হয়ে বয়ে যায়। এ সবে বিশ্বের কিছু আসে যায় না অথবা শোনেও না, যেহেতু আমরা কাজে যাই গর্বভরে; আমাদের কাপড়-চোপড় বাংলার নারীদের রুগ্ণ আঙ্গুলে সেলাই করা আর অদৃশ্য রক্তে ভেজা। রাজকীয় দুর্গের মালী [ভিয়েতনামরে প্রাচীন দুর্গের হোই জনগোষ্ঠীর জন্য] বজ্রপাতে গাছের কা-রা যায় বেঁকে। প্রতিটি ঘাসের বীজ বুনতে মালী নিজেকে আচ্ছন্ন রাখে। প্রচ- ঝড় জলমগ্ন করে সমস্ত শহর। প্রতিটি ঘাসের বীজ বুনতে মালী নিজেকে আচ্ছন্ন রাখে। তার সাদা চুলের চতুর্দিকে শুভ্র গন্ধরাজ। তার বিবর্ণ জামার পাশাপাশি টকটকে রঙিন অশোক। তার কর্কশ হাতের নিচে লাল পদ্মফুল। রাজকীয় সভাসদবর্গের পতন ঘটে। প্রতিটি ঘাসের বীজ বুনতে নিজেকে আচ্ছন্ন রাখে মালী। রাজবংশসমূহ পতনের মুখে। ওদের চিতাভস্ম থেকে উঠে আসে মানুষের ঘাম। দুই সত্য হ্যানয়ের মেট্রোপোল হোটেলে দুজন লোক নরওয়ের স্যামন খায়, অস্ট্রেলিয়ার তাজা জিনুক আর গোমাংশ; ফ্রান্সের জল, জার্মানির সস; প্লেট গ্লাস আর জানালায় সে সবের প্রতিবিম্ব পড়ে, পরিচারিকারা ঐতিহ্যবাহী পোশাকে জোড় হাতে অভ্যর্থনা করে। কাঁচের ওপারে, জীবিকার জন্য একজন সাইকেলের টায়ার সাঁটে; গ্রীষ্মের ভরদুপুরে তার আশা ধুঁকধুঁক করে। একজন নারী তার আঁকশিতে বয়ে নিয়ে যায় সাদামাটা নুডলস যা সে টফু আর চিংড়ির গুঁড়ো দিয়ে রান্না করে বেচে। এরা সকলেই এক সময় কৃষক ছিল, এবং এখন তারা দুই সত্যের কা-ারী, পুরো কাঁচের আড়াল ব্যতীত তাদের মাঝখানে আর কিছু নেই- ব্যতিব্যস্ত মানুষের স্র্রোত হামাগুড়ি দিয়ে সামনে এগিয়ে যায়।
×