ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

তুরস্কের ব্যর্থ অভ্যুত্থান

প্রকাশিত: ০৪:১০, ১৯ জুলাই ২০১৬

তুরস্কের ব্যর্থ অভ্যুত্থান

ফ্রান্সের সমুদ্র সৈকত সংলগ্ন অবকাশযাপন কেন্দ্র নিস শহরে ভয়াবহ ও নৃশংস সন্ত্রাসী জঙ্গী হামলার ক্ষত না শুকাতেই তুরস্কে রক্তক্ষয়ী ব্যর্থ সামরিক অভ্যুত্থানের ঘটনা ঘটেছে। পিস অব হোম মুভমেন্টের সমর্থক বলে দাবিদার সেনাবাহিনীর একটি অংশ শুক্রবার গভীর রাতে উদ্যোগ নেয় অভ্যুত্থানের। তারা ট্যাঙ্ক ও সাঁজোয়া যান নিয়ে নেমে আসে রাস্তায়। রাতের আকাশে উড়তে দেখা যায় বিদ্রোহীদের বিমানবহরকে। তুরস্কের পার্লামেন্ট ভবন, প্রেসিডেন্ট প্রাসাদ, প্রধান বিমানবন্দর, বসফরাস সেতু, পুলিশ সদর দফতরসহ বিভিন্ন স্থানে হামলা চালানো হয়। বিদ্রোহী সেনারা তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোগান সরকারের ১৩ বছরের স্বৈরতান্ত্রিক শাসনের অবসান দাবি করে ঘোষণা প্রচার করতে থাকে রাষ্ট্রীয় বেতার ও টেলিভিশনে। তবে প্রেসিডেন্ট রিসেপ তায়েপ এরদোগান এ সময়ে আঙ্কারায় ছিলেন না। এ সময় তিনি অবস্থান করছিলেন রাজধানী থেকে ৬০০ কিলোমিটার দূরে উপকূলীয় অবকাশ কেন্দ্র মারমারিস শহরে। সেখানে বিদ্রোহীদের হামলা হলেও ভাগ্যক্রমে তিনি বেঁচে যান এবং অনতিপরেই স্মার্ট মোবাইল এ্যাপের সাহায্য নিয়ে সেনা অভ্যুত্থান প্রতিরোধে নিজ দল জাস্টিস ডেভেলেপমেন্ট পার্টি বা একে পার্টির সমর্থকদের রাস্তায় নেমে আসার আহ্বান জানান। দাবার ছক উল্টে যায় এতেই। এটা যে কতটা কার্যকর ও ফলপ্রসূ হয়েছে তা বোঝা গেছে অভ্যুত্থান ব্যর্থ হওয়ার পর। তবে এর জন্য চড়া মূল্য দিতে হয়েছে তুরস্কবাসীকে। কয়েক শ’ সামরিক-বেসামরিক ব্যক্তিকে হত্যা করা হয়েছে। বেশকিছু সংখ্যক জেনারেল ও কর্নেলসহ অনেককে চাকরিচ্যুত ও বন্দী করা হয়েছে। এর ফলে স্বভাবতই ব্যাহত হবে তুরস্কের অর্থনৈতিক অগ্রগতি ও উন্নয়ন। অভ্যুত্থান আপাত ব্যর্থ হলেও বিদ্রোহী সেনারা ই-মেইল বার্তায় লড়াই চালিয়ে যাওয়ার ইঙ্গিত দিয়েছেন। ন্যাটো দেশভুক্ত হওয়ার কারণে ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলো এ নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। মিত্র দেশ হিসেবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং যুক্তরাজ্যও এ ঘটনায় উৎকণ্ঠিত। সব মিলিয়ে প্রেসিডেন্ট এরদোগানের জন্য সামনে অপেক্ষা করছে কঠিন সময়। অবশ্য তুরস্কে সেনা অভ্যুত্থানের খবর নতুন নয়। ১৯৬০ সালের ২৭ মে আধুনিক তুরস্কের প্রতিষ্ঠাতা কামাল আতাতুর্কের ধর্মনিরপেক্ষ মতাদর্শের বিপরীতে প্রথম সেনা অভ্যুত্থান ঘটে। সেই থেকে দেশটির সঙ্কটের সূত্রপাত। উল্লেখ্য, তুরস্কের সেনাবাহিনী নিজেদের গণতন্ত্রের অভিভাবক ও দেশের ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শের রক্ষক বলে দাবি করে থাকে। তবে এরপর থেকে তুরস্কে যে বা যারাই সরকার গঠন করেছে, তারা ধর্মীয় রীতিনীতি ও অনুশাসন বাস্তবায়নে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। এদিক থেকে মিসরের সঙ্গে তুরস্কের রাজনীতির অনেকটা মিল লক্ষণীয়। বছর চৌদ্দ আগে সাধারণ নির্বাচনে জিতে ক্ষমতায় আসেন প্রেসিডেন্ট এরদোগান। এরপর থেকেই তিনি তুরস্ককে প্রধানত ইসলামমুখী করে তোলার প্রাণপণ চেষ্টা করে যাচ্ছেন। এ থেকেও শক্তিশালী সেনাবাহিনীর সঙ্গে সরকারের দূরত্বের সূচনা হতে পারে। অবশ্য এরদোগান অভ্যুত্থানের জন্য দায়ী করেছেন যুক্তরাষ্ট্রকে ও সে দেশে বসবাসরত নির্বাসিত বর্ষীয়ান নেতা ফেতুল্লা গুলেনকে। সুফিবাদ ও সব মানুষের সহাবস্থানের পক্ষে হিজমত নামে পরিচিত গুলেন সমর্থকদের আন্দোলন তুরস্কে বেশ জনপ্রিয়। তবে ফেতুল্লা গুলেন ব্যর্থ অভ্যুত্থানের নিন্দা জানানোর পাশাপাশি প্রেসিডেন্ট এরদোগানেরও তীব্র সমালোচনা করেছেন। ক্ষমতারোহণের পর থেকেই প্রেসিডেন্ট এরদোগানকে নানামুখী সমস্যা-সঙ্কট মোকাবেলা করতে হচ্ছে। ইরাক-সিরিয়ায় আইএসের বিরুদ্ধে তুরস্কের ভূখ- ব্যবহার করছে যুক্তরাষ্ট্রসহ মিত্রজোট। অন্যদিকে কট্টর ইসলামপন্থী সরকার আইএসের সঙ্গে সখ্য গড়ে তুলতেও আগ্রহী। তুরস্ক এমনকি আইএসের তেলের অন্যতম ক্রেতা, যে কারণে বিবাদে জড়িয়ে পড়েছে রাশিয়ার সঙ্গে। অন্যদিকে কুর্দি বিদ্রোহ দমনেও মরিয়া দেশটি। অতীতের আর্মেনীয় গণহত্যা অস্বীকারের বিষয়টি তো আছেই। কিছুদিন আগে আকস্মিক সন্ত্রাসী হামলা চালিয়ে কুর্দিরা প্রায় অচল করে দিয়েছিল ইস্তানবুল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর। ইউরোপীয় ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত হতেও আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছে দেশটি। সেক্ষেত্রে গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও মানবাধিকার রক্ষায়ও সচেষ্ট হতে হবে তাকে। ‘বোঝার উপর শাকের আঁটির’ মতো রয়েছে ২০ লাখ সিরীয় শরণার্থী সমস্যা। সর্বশেষ যুক্ত হলো আপাত ব্যর্থ রক্তক্ষয়ী সামরিক অভ্যুত্থান। সব মিলিয়ে দেশটির সামনে অপেক্ষা করছে এক অনিশ্চিত ভবিষ্যত।
×