ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

একটু দূরে খানিকটা নিরিবিলি

লম্বা ছুটিতে ॥ ঈদে বেড়ানো

প্রকাশিত: ০৭:০৮, ১৬ জুলাই ২০১৬

লম্বা ছুটিতে ॥ ঈদে বেড়ানো

প্রেম যমুনার ঘাট। যমুনার তীরে আছড়ে পড়ছে ঢেউ। তার ধারেই মধুময় মিলন মেলা। অচেনা জায়গা কত দিনের চেনা হয়ে যায়। ঈদের পরের সময়টায় যখন বেড়ানোর নতুন কোন স্থান খোঁজা হয় তখনই হাতছানি দেয় বগুড়ার সারিয়াকান্দির প্রকৃতির নিসর্গের উত্তাল ঢেউয়ের যমুনার তীর। শোনা যায় তরুণ তরুণী এমন কি মধ্যবয়সীদেরও সমবেত কিচির মিচির। কান পাতা দায়। উচ্ছ্বাস ও আবেগ সমান্তরাল। মন চাইছে ঢেউয়ের সঙ্গে মিশতে। কখনও দুরন্তপনায় মেঘের সঙ্গে বাজি ধরে উড়ন্ত বলাকা হতে। ঘাটে নৌকাও আছে। প্রকৃতিতে বাজছে রবীন্দ্রনাথের সুর ‘কে যাবি পাড়ে ওগো তোরা কে/আমি তরী নিয়ে বসে আছি নদী কিনারে...’। একটু দূরে খানিকটা নিরিবিলি। যেখানে মানব জীবনের চিরকালিন সত্তা রোমান্টিসিজমের কতই না ছন্দ। কোথাও বিচ্ছেদের ছন্দ লয়ে মিলন উঠেছে পূর্ণ হয়ে। মুখোমুখি বসা জুটি। গভীর প্রণয়ে কথা নেই, ভাবাবেগ। শুধু একটুখানি চাওয়া আর একটুখানি পাওয়া। যেখানে শেষ বিকালের লাজুক আলোয় ভোরের ফুল ফুটেছে। এরা সকলেই পরিপাটি বর্ণিল সাজে। এসেছে বগুড়া শহর দূরের কোন জায়গা থেকে। কেউ মোটরসাইকেলে। কেউ নিজেদের গাড়িতে। কেউ মাইক্রোবাসে। কেউ সিএনজিচালিত অটো রিকশায়। কেন তারা যায়! কি আছে যমুনার তীরে! শহরে কত চাকচিক্য ঝলমলে আলো। তারপরও সেখান থেকে কত জন ছুটে যায় যমুনা পাড়ে। কাঁধে কাপড়ের ব্যাগ। পরনে পাঞ্জাবি-জিনস। কেশ বিন্যাস করা। সুমন নামের তরুণ এসেছিল মুক্তির ব্যাকুলতায়। প্রাসাদ নগরীকে মনে হয়েছে বিলাসের রসিকতা। চিত্ত সুখ নেই। সঙ্গী যে হৃদয়ের মানুষ তা অবশ্য বলতে হয় না। চাহনি ও মনের ভাষা তা বলে দেয়। ঘাটের একটু দূরে এলোমেলো সিসি ব্লক। যার ওপর দিয়ে লাফিয়ে স্রোতে পা এলিয়ে দিলে ঢেউয়ের পরশ। ঢাকা থেকে আসা কয়েক তরুণ তরুণী বলল সাগর পাড়ের ঢেউয়ের অনুভূতি মেলে। যমুনা তীরের এই ঘাটের কথা শুনে তারা এসেছে। বলল ভালই লাগছে। পরের বার ফিঁয়াসেকে সঙ্গে নিয়ে আসবে। বগুড়া নগরী থেকে প্রায় ২৫ কিলোমিটার পূর্বে পাকা সড়ক ধরে গেলে সারিয়াকান্দি। অল্প দূরে হার্ড পয়েন্ট। সেখান থেকে চার কিলোমিটার দূরে দেবডাঙ্গা রিভেটমেন্ট। বিশ্ব ব্যাংকের অর্থায়নে পানি উন্নয়ন বোর্ড বহু কোটি টাকা ব্যয়ে এইসব শক্ত কাঠামো নির্মাণ করেছে। সিঁড়ি দিয়ে যমুনার স্রোতের হাঁটু পানিতে নামা যায়। তবে সাবধানে। রিভেটমেন্টের ওপরে দাঁড়িয়ে দূরে দৃষ্টিতে আসে নদীর ভিতরে সবুজের বন্ধনহীন গ্রন্থী। স্রোতের শব্দ আর নির্মল শান্ত বাতাস নিসর্গের রাগরাগিনীর সুর তোলে। নদী তীরের এমন পরশ পেতে প্রথমে আশপাশের দশ গাঁওয়ের মানুষের যাওয়া-আসা শুরু। দিনে দিনে শহরের মানুষ ও দূরের মানুষ খুঁজে পেয়েছে চিত্তসুখের বিনোদনের এই জায়গা। শহরের উচ্চ শব্দের হুঙ্কার নেই। দূষণ নেই। আছে প্রকৃতির সঙ্গে মিশে যাওয়ার পরশ। দিনে দিনে এক দুই করে হাজারো চোখের ও মনের ভাষার মুখ জড়ো হয়। ক’বছর ধরে যমুনার স্রোতের মতোই তরুণ তরুণীসহ নানা পেশা নানা বয়সীদের ঢল নেমেছে। পরিণত হয়েছে মিলনক্ষেত্রে। এর মধ্যেই প্রণয় মধুর সম্পর্কের তরুণ তরণীরা খুঁজে নিয়েছে এই ঘাট। কেউ কাউকে বিরক্ত করে না। যে যার মতো। সকলেরই এক সুর ‘হৃদয়ের কথা বলিতে ব্যাকুল...’। এই ঘাটের অল্প দূরে গ্রামের টুকরো টুকরো ঘর গেরস্থালি। পথে উলুঝুলো কাপড় পরা লোকজন। ঘুরছে এদিক সেদিক। ওদের সামনেই যে মিলন মেলা বসেছে তার খেয়াল নেই। জমির আইল ধরে হেঁটে যাচ্ছিলেন কাঁধে গামছা ও লুঙ্গি পরা বয়স্ক লোক। সেভ করেননি কয়েকদিন, খোঁচা দাড়ি। বললেন আগে এত লোক আসেনি। এখন আসছে। দেখতে ভালই লাগে। তীর সুন্দর হয়ে ওঠে। ছুটির দিনে ভিড় বাড়ে। মানুষের ভিড় দেখে ছুটে আসে বাদামওয়ালা চানাচুর চকলেট লজেন্সওয়ালা। নদী তীরে বিক্রিবাটা ভালই হয়। ক্ষুদে বাদামওয়ালা মজনু বলে, ‘আপাদের দেখলে আগ্যে (এগিয়ে) যাই। বেশি কেনে। পার্টনারকে দেয়। অনেকক্ষণ বসে গল্প করে।’ ঠোঁটের কোণে মিষ্টি হাসি ঝুলিয়ে বলে ‘খুউব ভাব’। এই ভাবের অর্থ বুঝেছে সে। ঠিকই তো মন্দ কি! ওরও তো ইচ্ছা করে। কিশোর প্রণয় বলে কথা। লিখেছিলাম- প্রেম যমুনার ঘাট। সকলেই এখন যমুনার তীরকে এই নামেই ডাকে-চেনে। যা সুন্দর যমুনার তীরে তা সুরের মধুময়তায় ‘মোর ভাবনারে কি হাওয়ায় মাতালো...’। -সমুদ্র হক, বগুড়া থেকে
×