ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

মুক্তিযুদ্ধে বিদেশী বন্ধু

প্রকাশিত: ০৩:৩৯, ১৪ জুলাই ২০১৬

মুক্তিযুদ্ধে বিদেশী বন্ধু

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে একান্তভাবে জড়িয়ে পড়েছিলেন তিনি। বয়স তখন তার মাত্র সাঁইত্রিশ বছর। সাড়ে সাতকোটি বাঙালীকে দাবিয়ে রাখতে পাকিস্তানী দখলদার হানাদার বাহিনীর নৃশংসতা, বর্বরতা, নির্মমতা সর্বোপরি গণহত্যার ছিলেন তিনি প্রত্যক্ষদর্শী। আর সেই দৃশ্যগুলো তিনি বিশ্বমানবের কাছে তুলে ধরেছিলেন লেখনীর মাধ্যমে। তার সেই সব ভাষ্য বিশ্ববাসীকে শুধু নাড়া দেয়নি, মুক্তিকামী বাঙালীর প্রতি সহমর্মিতা জাগিয়ে তুলেছিল। হানাদারদের রক্তচক্ষু ও বুলেট বেয়নেটকে উপেক্ষা করে সাহস ও নির্ভীকতার সঙ্গে তিনি তুলে ধরেছিলেন বাস্তব চিত্র। বাঙালীর সশস্ত্র লড়াইয়ে ছিলেন তিনি সহযোগী, সহমর্মী। বাংলার মাটি, বাংলার জল যখন রক্ত গঙ্গায় ভাসছিল, তিনি সেই রক্তাক্ত দৃশ্যাবলী বিশ্ববিবেকের দরবারে তুলে ধরেছিলেন সত্যনিষ্ঠ ভাষ্যে। বিশ্ববিবেক সক্রিয় হয়েছিল গণহত্যার বিরুদ্ধে, বাঙালীর স্বাধীনতা যুদ্ধের পক্ষে তার প্রতিবেদন পাঠ করে। সর্বার্থে তিনি হয়ে উঠেছিলেন মুক্তিযুদ্ধের অন্য রণাঙ্গনের সৈনিক। অস্ত্র নয়, কলম হাতে তিনি লড়াই করেছেন। তার সেইসব সংবাদভাষ্য, প্রতিবেদন হয়ে আছে ইতিহাসের দলিল। বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের ইতিহাসে তিনি তাই অনন্য, চিরস্মরণীয়। তিনি সিডনি শেনবার্গ, ১৯৭১ সালের মার্চে অসহযোগ আন্দোলন চলাকালে এসেছিলেন ঢাকায় সংবাদ সংগ্রহে। মার্কিন যুবকটি তখন নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকার দিল্লী ব্যুরোতে কর্মরত বৈদেশিক সংবাদদাতার দায়িত্বে। পঁচিশে মার্চ কালরাত অবলোকন করেছিলেন স্বচক্ষে। পাকিস্তানী দখলদার বাহিনীর অপারেশন সার্চ লাইট নামক গণহত্যার সেই অভিযান তার ভেতরে আলোড়ন তুলেছিল। হত্যাযজ্ঞের সূচনা যখন, তখন তিনি আরও পঁয়ত্রিশ জন বিদেশী সংবাদদাতার সঙ্গে ঢাকায় অবস্থান করছিলেন। সে রাতে হোটেলের ছাদ ও জানালা থেকে প্রত্যক্ষ করেছিলেন নৃশংসতার দৃশ্যপট। হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে আটকে রেখে পরদিন বিমানে সব বিদেশী সাংবাদিককে পাঠিয়ে দেয়া হয় দেশের বাইরে। শেনবার্গও তাদের একজন ছিলেন। অভিশপ্ত সেই রাতের ভয়াবহতা ও নৃশংসতা তিনি দ্রুত উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। দিল্লী পৌঁছেই তিনি প্রতিবেদন পাঠান নিউইয়র্ক টাইমসে। রাতভর ঘণ্টায় ঘণ্টায় কি ঘটেছে, সেই ধারাবর্ণনা তিনি তুলে ধরেছেন। শেনবার্গ বুঝেছিলেন হানাদারদের মানসিকতা ও নৃশংসতার স্বরূপ। দিল্লী থেকে একাদিক্রমে রিপোর্ট পাঠিয়েছেন নানা সূত্র থেকে তথ্য নিয়ে। ‘যে ধর্মের আঠা দিয়ে পাকিস্তানের দুই অংশ একত্রে ছিল; তা যে আর অটুট থাকছে না, তা উল্লেখ করে চার এপ্রিল পাঠানো প্রতিবেদনে লিখেছিলেন, হয়ত এ জন্য দীর্ঘ সময় লাগতে পারে, কিন্তু বাঙালী জাতীয়তাবাদের সাম্প্রতিক উত্থান ও পাকিস্তান বাহিনীর আক্রমণের বর্বরতার যারা সাক্ষী, তারা কেউ এ বিষয়ে আর সন্দেহ পোষণ করেন না। ঢাকা থেকে বহিষ্কৃৃত হলেও যুদ্ধক্ষেত্র থেকে সরে যাননি। বার বার ফিরে আসেন সীমান্ত এলাকায়। কখনও মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে ঢুকে পড়েন মুক্তাঞ্চলে, প্রত্যক্ষ করেন যুদ্ধ অপারেশন, ঘুরে দেখেন শরণার্থী শিবিরগুলো। জুন মাসে আবার ঢাকায় আসেন। কিন্তু তার পাঠানো প্রতিবেদনে ক্ষুব্ধ হয়ে হানাদাররা আবার তাকে বের করে দেন। ১৬ ডিসেম্বর মুক্তিবাহিনী ও মিত্র বাহিনীর সঙ্গে তিনি যশোর সীমান্ত হয়ে ঢাকায় প্রবেশ করেন। বাঙালীর বিজয়ের সাক্ষী ছিলেন তিনি। যুদ্ধের পর সারাদেশ ঘুরে তিনি তখন সংগ্রহ করে লিখেছিলেন শহীদের সংখ্যা ত্রিশ লাখের বেশি হবে। তার পঁয়ত্রিশটি রিপোর্ট নিয়ে ১৯৯৫ সালে প্রকাশিত হয় গ্রন্থ ‘ডেটলাইন বাংলাদেশ : নাইনটিন সেভেনটি ওয়ান।’ বাংলাদেশ সরকার ‘মুক্তিযুদ্ধের বিদেশী বন্ধু’ হিসেবে তাকে সম্মানিত করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু অসুস্থতার কারণে বিমানযাত্রা বারণ থাকায় সেই সম্মাননা আর গ্রহণ করা হয়নি। তথাপি ছিলেন তিনি বাংলাদেশের বন্ধু। ভিয়েতনাম ও কম্বোডিয়া যুদ্ধ পরিস্থিতি নিয়ে ১৯৭৫ সালে তিনি প্রচুর প্রতিবেদন লিখেছেন, সে জন্য পুলিৎজার পুরস্কার পেয়েছেন। মানবতাবাদী শেনবার্গ চলে গেলেন বিরাশি বছর বয়সে গত দশ এপ্রিল। মৃত্যু তাকে কেড়ে নিলেও তিনি বেঁচে থাকবেন বাংলাদেশের সঙ্গে, ইতিহাসের খেরো খাতায়। বাংলাদেশ তার আত্মার প্রশান্তি কামনা করে। শেন বার্গের প্রতি টুপিখোলা স্যালুট।
×