ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

তাপস মজুমদার

ধান-চালের কাহন

প্রকাশিত: ০৫:৩১, ১৪ জুন ২০১৬

ধান-চালের কাহন

ধান-চাল নিয়ে ইদানীং কথাবার্তা হচ্ছে খুব, বিভিন্ন পর্যায়ে, বিভিন্ন মহলে। একেবারে তৃণমূল থেকে মাথা উঁচু স্তরে। অবশ্য তা না হয়েও উপায় নেই। কেননা, কথায় আছে সেই আদিকাল থেকেই, ‘অন্নচিন্তা চমৎকারা’। বাজেট-উত্তর সাংবাদিক সম্মেলনে অর্থমন্ত্রীর পাশে বসে কৃষিমন্ত্রীও প্রধানমন্ত্রীর বরাত দিয়ে বলেছেন, ‘পেট ঠা-া তো জগৎ ঠা-া’। কথাটা সর্বাংশে সত্য। এই যে দেশের বর্তমান জঙ্গী সন্ত্রাস ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে এত আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে টিভি থেকে তৃণমূল পর্যন্ত, সাধারণ মানুষ তাতে ‘যারপরনাই’ উদ্বিগ্ন সন্দেহ নেই; কিন্তু ঘরের অন্ন-বস্ত্র নিয়ে তাদের আপাতত তেমন দুশ্চিন্তা নেই। বর্তমানে বাজারে বিভিন্ন পণ্যের দরদামে যে তেজি ভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে, তা মূলত রমজান ও ঈদকে উপলক্ষ করেই। প্রতি বছরই এমনটা পরিলক্ষিত হয়ে থাকে, সর্বস্তরের মানুষ তা জানে। অর্থাৎ মানুষ এতে অভ্যস্ত। এই যেমন প্রতি বছরের মতো এবারও সে হুড়ুমদুড়ুম করে বেশি টাকা দিয়ে ট্রেন-বাস-লঞ্চের টিকিট কিনবে এবং পরিবার-পরিজন-লটবহর নিয়ে গ্রামের বাড়িতে নিয়মমতো ঈদ উদযাপন করবে, জীবনের ঝুঁকি নিয়ে হলেও। ততদিনে নিশ্চয়ই দেশব্যাপী যৌথবাহিনীর সাঁড়াশি অভিযান তথা কম্বিং অপারেশনে জঙ্গী-সন্ত্রাসীদের উৎপাত-উপদ্রব-টার্গেট কিলিং কমে আসবে। তবে রাস্তাঘাটে যাতায়াতের ঝুঁকিটা থেকেই যাবে। যাক, যা বলছিলাম, অন্নচিন্তা। পদ্মা সেতু, অর্থনৈতিক উন্নয়ন, রূপপুর পারমাণবিক কেন্দ্র, বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট, বিদ্যুত সমস্যার আশাব্যঞ্জক অগ্রগতি ইত্যাদিসহ বর্তমান সরকারের অন্যান্য সাফল্য ও মাইলফলক যা-ই থাকুক না কেন, সবকিছুকে ছাপিয়ে গেছে খাদ্যপণ্যের মূল্য, বিশেষ করে ধান-চাল-আটার মূল্য সহনশীল রাখার কৃতিত্বে। শুধু বাংলাদেশ নয়, বরং প্রতিবেশী রাজ্য পশ্চিমবঙ্গসহ উপমহাদেশের রাজনীতিতে খাদ্যপণ্যের দাম সহনশীল রাখা সর্বদাই একটা বড় ফ্যাক্টর এবং সরকার পতনেরও অন্যতম একটি নিয়ামক। অনেক বছর আগে নিতান্তই সাধারণ এই কথাটা ঈশ্বরী পাটনি বুঝেছিলেন বলেই অন্নদামঙ্গলের কাছে এই বলে বর চেয়েছিলেন, ‘আমার সন্তান যেন থাকে দুধে-ভাতে’। বর্তমান সরকারের আমলে সর্বস্তরের মানুষ দুধ-ভাতে না হোক, অন্তত ডাল-ভাত অথবা শাক-ভাত খেয়ে বেঁচে আছে। সেদিন একটি এনজিও পরিবেশিত তথ্যে দেখলাম, দেশে দরিদ্র অন্তত দেড় কোটি মানুষ একবেলা খেতে পায় না। এই কথাটি মনে হয় না গ্রহণযোগ্য। ইদানীং গ্রাম-গঞ্জেও কমবেশি কাজ মেলে এবং অনেক ক্ষেত্রে যেমন, কৃষি কাজেÑ ধান কাটা অথবা পাটের আঁশ আহরণের লোক পাওয়া যায় না অতিরিক্ত মজুরি দিয়েও। পার্বত্য চট্টগ্রামের দুর্গম অঞ্চল থানচিতে সম্প্রতি যে খাদ্য সঙ্কট দেখা দিয়েছে তা স্থানীয় প্রশাসনের অবহেলা ও অদক্ষতা। অনেক ক্ষেত্রে বরং কিছুটা উল্টোচিত্রই দেখা যায়, যা আমাদের বরং চিন্তিত করে তোলে। এরকম একটি সংবাদ মিলেছে বগুড়া থেকে। সমুদ্র হক লিখেছেন শিবগঞ্জ সোনাতলা ধুনট এলাকায় গমের ভুসি বিক্রি হচ্ছে প্রতি কেজি ২৬ থেকে ২৮ টাকা দরে। অন্যদিকে চালের খুদ প্রতি কেজি ২০-২২ টাকা আর মোটা চাল ১৯-২০ টাকা। ফলে অনেক কৃষক পড়তা পড়ে বিধায় অর্ধেক ভুসি ও অর্ধেক খুদ মিশিয়ে জাউভাত খাওয়াচ্ছেন গবাদিপশুকে। উল্লেখ্য, এর আগে সবজির দাম কম হলে কৃষককে মুলা, কপি, বেগুন ইত্যাদি গরুকে খাওয়ানোর খবর মিলেছে। এখন মিলছে জাউভাত খাওয়ানোর খবর। এ দৃশ্য দেখে কৃষক মন্তেজার বলেন, ‘কলি, ঘোর কলি। কলিকালে কত কী যে দেখা লাগবি!’ অনুরূপ আক্ষেপ ধ্বনিত হতে দেখা গেছে চ্যানেল আইয়ে বহুল প্রচারিত ও জনপ্রিয় হৃদয়ে মাটি ও মানুষ অনুষ্ঠানে। চ্যানেলটি প্রতি বছর প্রাক-বাজেট আলোচনার অংশ হিসেবে ‘কৃষি বাজেট, কৃষকদের বাজেট’ শীর্ষক উন্মুক্ত আলোচনার আয়োজন করে থাকে দেশের বিভিন্ন স্থানে, প্রধানত কৃষকদের সক্রিয় অংশগ্রহণের মাধ্যমে। এরকম একটি অনুষ্ঠানে অর্থমন্ত্রীর উপস্থিতিতে কৃষি উন্নয়ন ও গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব শাইখ সিরাজ বলেন, ধান-চালের দরদাম নিয়ে তিনি ৬টি জেলার ৫০ হাজার কৃষকের সঙ্গে আলোচনা করেছেন। ৯০ শতাংশ কৃষকই বলেছেন, তারা ধান-চালের ন্যায্যমূল্য পান না। এই অনুষ্ঠানে অর্থমন্ত্রী ভিন্ন একটি প্রসঙ্গ টেনে বলেন, তিনি দেশ থেকে আখের চাষ উঠিয়ে দিতে চান। কেননা আখ চাষে সময় লাগে ৮ মাস। এ সময় দেশীয় চিনিকলগুলো বন্ধ থাকে এবং বসে বসে লোকসান গোনে। দেশের বাজারে চিনির কেজি ৪৫ টাকা। অন্যদিকে আমদানিকৃত চিনি ২০ থেকে ২৫ টাকা কেজি। সরকারী ১৫টি চিনিকলের কারণে সমূহ ক্ষতি হচ্ছে। প্রতিবছর ক্ষতির পরিমাণ কয়েকশ’ কোটি টাকা। বর্তমানে অবশ্য চিনির দাম কিছুটা বেড়েছে ব্যবসায়ীদের কারসাজিতে। তবে তা ভিন্ন প্রসঙ্গ। এবার একটু মাঠ পর্যায়ের খবরাখবর নেয়া যেতে পারে। কৃষি মন্ত্রণালয়ের অন্তর্ভুক্ত কৃষি বিপণন অধিদফতর ৩ মে দেশের ৮টি জেলার ধানের দর প্রকাশ করেছে। তাতে দেখা যায় ময়মনসিংহের নান্দাইল বাজারে বোরো মৌসুমের মোটা ধান প্রতিমণ বিক্রি হচ্ছে ৪০০-৪৫০ টাকায়। আর অন্যান্য জেলায় ৫০০ থেকে ৫৮০ টাকা। অন্যদিকে সরকারের চারটি মন্ত্রণালয়ের হিসাবে চলতি বছর ১ মণ বা ৪০ কেজি ধানের উৎপাদন খরচ পড়েছে ৮২৮ টাকা। সেই হিসেবে কৃষকরা প্রতিমণ ধান বিক্রি করে লোকসান দিচ্ছেন ২৫০ থেকে ৪০০ টাকা। উৎসাহী পাঠকের হয়ত এ খবরও নিশ্চয়ই চোখে পড়েছে যে, এক মণ ধান বিক্রি করে কোথাওবা এক কেজি গরুর মাংস কেনাই দায় হয়ে পড়েছে; ইলিশ মাছ তো দূরের কথা। অন্যদিকে হাটবাজারে গিয়ে ধানের দাম না পেয়ে হতাশ হয়ে কৃষকদের রাস্তায় ধান ফেলে দিয়ে প্রতিবাদ করার সচিত্র খবরও মিলেছে। অনুরূপ দৃশ্য দেখা গেছে দুধের ক্ষেত্রেÑ পাবনার তাড়াশ ও সিরাজগঞ্জে। মিল্কভিটা, প্রাণ, আড়ং ইত্যাদি বড় কোম্পানিগুলো হঠাৎ করে খামারিদের কাছ থেকে দুধ কেনা বন্ধ করে দিলে নিতান্তই হতাশা থেকে তারা এটি প্রায়ই করে থাকে। শাকসবজি, তরিতরকারির ক্ষেত্রেও প্রায়ই এমনটা লক্ষ্য করা যায়। মোটকথা, আমাদের কৃষিজাত ও খামারজাত পণ্য আহরণ, সংগ্রহ ও বিপণন ব্যবস্থাটা আদৌ ভাল নয়। আধুনিক তো নয়ই, মোবাইলসহ তথ্যপ্রযুক্তির সুবিধা থাকা সত্ত্বেও। বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ব্রি) দেশের ১১টি জেলায় বোরো ধান চাষ নিয়ে একটি জরিপ চালিয়েছে সম্প্রতি। ‘খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতার ওপর ধানের জমি হ্রাসের কারণ বিশ্লেষণ’ শীর্ষক এই জরিপ প্রতিবেদনে সরকারী ধান সংগ্রহ অভিযানের বিভিন্ন অনিয়ম ও অভিযোগ সম্পর্কে বলা হয়েছে। ব্রির প্রতিবেদনে দেখা যায়, গত বছর দেশে ৪৮ দশমিক ৪৬ লাখ হেক্টর জমিতে বোরো চাষ হয়েছে। আর উৎপাদন হয়েছে ১ কোটি ৯৩ লাখ ৪৩ হাজার মেট্রিক টন চাল। এ বছর বোরো চাষ হয়েছে ৪৬ দশমিক ৬১ লাখ হেক্টর জমিতে। এবার গত বছরের তুলনায় ৭ লাখ ১ হাজার টন ধান কম উৎপাদন হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। ব্রির মতে, আস্তে-ধীরে হলেও বোরো চাষ কমে যাচ্ছে, যা ভবিষ্যতে প্রভাব ফেলতে পারে খাদ্য নিরাপত্তায়। ব্রির জরিপ প্রতিবেদনে কৃষক কেন ধান চাষে নিরুৎসাহিত হচ্ছেন এবং কেনইবা ধান-চালের ন্যায্যমূল্য পাচ্ছেন না, তার কিছু বিশ্লেষণ উঠে এসেছে। প্রধান কারণ তো অবশ্যই ধানের দাম কম পাওয়া। অন্যদিকে চাষবাসে ব্যয় বৃদ্ধি। তদুপরি আমন ও আউশ মৌসুমের তুলনায় বোরো মৌসুমে বাজারে ধানের যোগান থাকে বেশি। ফলে বাজার নিয়ন্ত্রণ করা কষ্টকর হয়ে পড়ে। এর পাশাপাশি আছে ফড়িয়া দালাল ও মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য। ফলে স্বভাবতই কৃষকরা সরকার নির্ধারিত ধানের ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হয়ে থাকেন। অতঃপর ব্রি বলছে, প্রান্তিক ও ক্ষুদ্র কৃষকদের কাছ থেকে ধান-চাল সংগ্রহ করতে হলে সরকারী সংগ্রহ অভিযানকে আগাগোড়া ঢেলে সাজাতে হবে। মধ্যস্বত্বভোগী, প্রভাবশালী ও ফড়িয়া-দালালদের এড়িয়ে যেতে হবে কৃষকের দোরগোড়ায়। সরাসরি কৃষি খামার থেকে সংগ্রহ করতে হবে ধান-চাল। কৃষিমন্ত্রীও বিষয়টি তথা কৃষকদের সমস্যা সম্পর্কে অবহিত। কৃষক যাতে ন্যায্যমূল্য পান সেজন্য সরকার এবার চালের চেয়ে ধান কেনা ও সংগ্রহ করার ওপর গুরুত্ব দিয়েছে। তবে অর্থমন্ত্রী এ পদ্ধতির সঙ্গে একমত নন। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর থেকে সরবরাহকৃত তালিকা অনুযায়ী প্রকৃত কৃষকদের কাছ থেকে ধান-চাল সংগ্রহ করা হবে এবার। তদুপরি চাষীরা যাতে সরাসরি খাদ্য বিভাগের গুদামে ধান নিয়ে যেতে পারেন, সেজন্যও সরকার থেকে নাকি উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। গণমাধ্যমসহ বেসরকারী সংস্থাগুলোও এক্ষেত্রে ইতিবাচক অবদান রাখতে পারে। প্রতি জেলায় ধান-চাল সংগ্রহ করা নিয়ে মাইকিংও করা হচ্ছে। ব্রির কৃষি অর্থনীতি বিভাগের জরিপ প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০১০ সালের পর থেকে ধানের উৎপাদন খরচ বাড়ছে ক্রমাগত। আর ধান বিক্রি করে কৃষকরা ন্যায্যমূল্য পাচ্ছেন না। গত বছর এক কেজি মোটা বোরো ধান বিক্রি করে কৃষক পেয়েছেন ১৬ টাকা ৮৮ পয়সা। মাঝারি মানের ধানের দাম পেয়েছেন গড়ে ১৮ টাকা ৪৮ পয়সা। অন্যদিকে, সরকারী হিসেবেই গত মৌসুমে বোরো ধানের উৎপাদন খরচ ছিল কেজি প্রতি ২০ টাকা। সরকার এবার ছয় লাখ টন ধান সরাসরি কৃষকদের কাছ থেকে কেনার উদ্যোগ নিয়েছে। নিঃসন্দেহে এটা সরকারের একটা সদিচ্ছা। তবে মাঠ পর্যায়ে বাস্তবায়ন দুরূহ বৈকি। তবে চাহিদা ও যোগানের অল্পবিস্তর পার্থক্য, বিশেষ করে ভরা মৌসুমে ধান-চালের কমবেশি দাম এবং কৃষকদের ন্যায্যমূল্য না পাওয়ার জন্য এককভাবে দায়ী, তাও নয়। একশ্রেণীর পাইকারি ও খুচরা ব্যবসায়ী, চাতাল মালিক, জোতদার, মহাজন, ধানচালের বেপারীসহ আরও নানা কারণ কাজ করে থাকে ধান-চালের দাম বাড়া-কমার নেপথ্যে। তদুপরি নানা উদ্যোগ সত্ত্বেও দেশের কৃষি ব্যবস্থা এখনও পর্যন্ত অনাধুনিক, নরনারী নির্বিশেষে মনুষ্য ও গবাদিপশুর শ্রমনির্ভর। আদিকালের ঐতিহ্যসম্মত কৃষি কাজের বদৌলতে দেশে ধান-চালসহ বিবিধ কৃষিপণ্যের উৎপাদন খরচ বেশি। সরকার তথা কৃষি মন্ত্রণালয় থেকে সার, বীজ, কীটনাশক, সেচ, ডিজেল ইত্যাদিতে কমবেশি ভর্তুকি দেয়া হলেও অনেক ক্ষেত্রেই কৃষককে এসব নগদ টাকায় কিনতে হয়। সমস্যা হলো, ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকদের হাতে প্রায়ই নগদ টাকা থাকে না। একজন কৃষককে তো শুধু চাষবাস করলেই চলে না, পরিবার-পরিজনের ভরণপোষণ, ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া, স্বাস্থ্য, দৈনন্দিন হাটবাজারসহ তার তো অন্যবিধ খরচও আছে। ব্যাংক থেকে কৃষি ঋণের কথা বলা হলেও তা পেতে, অন্তত সময়মতো, থাকে নানা জট ও জটিলতা। সুতরাং চড়া সুদে সমাজ ও রাষ্ট্রের বিভিন্ন স্তর থেকে তাকে ধারকর্জ করতেই হয়। তদুপরি দেশের কৃষি ব্যবস্থা এখনও পর্যন্ত প্রধানত প্রকৃতি ও আবহাওয়ানির্ভর। যেমন, এবার সিলেটের হাওড় অঞ্চলে বরাবরের মতোই বাম্পার ফলন হয়েছে। তবে প্রাক-বর্ষা মৌসুমে হঠাৎ করে প্রবল বৃষ্টিপাত এবং পাহাড়ী ঢলে ফ্ল্যাশ ফ্লাড হওয়ায় কৃষকের মাথায় হাত পড়েছে। অসময়ের এই প্রবল বৃষ্টি ও অকালবন্যায় অনেকের সুপক্ব ধান তলিয়ে গেছে পানিতে। এ সময়ে দেশের অন্যান্য অঞ্চল থেকে আগত খ-কালীন শ্রমিকও পাওয়া যায়নি। অনুরূপ অবস্থা পরিলক্ষিত হয়েছে রাজশাহীর বরেন্দ্র অঞ্চলেও। দেশে গত কয়েক বছর ধরে কৃষি শ্রমিকের সমূহ সঙ্কট দেখা দিয়েছে। সবাই নিশ্চয়ই একবাক্যে স্বীকার করবেন যে, কৃষিকাজ একটি অত্যন্ত কষ্টকর পেশা। ভোর রাত থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত কাঠফাটা রোদে পুড়ে, মুষলধারা বৃষ্টিতে ভিজে পরিশ্রম করে পেটে-ভাতে মেলে বড়জোর ৩০০ টাকা। অথচ শহরে কিংবা শহরতলীতে একবেলা স্কুটার চালালে, রাজমিস্ত্রি বা অন্যবিধ কাজ করলে এর চেয়ে অনেক বেশি অর্থ মেলে। তদুপরি স্বাধীন ও স্বশাসিত পেশা। সুতরাং কৃষি শ্রমিকরা পেশা পরিবর্তন করেছেন ও করছেন। বরেন্দ্র অঞ্চলে এক বিঘা জমির ধান কাটতে চাওয়া হচ্ছে সাড়ে তিন থেকে চার হাজার টাকা। এই পরিমাণ টাকা দিতে হলে কৃষককে ৭-৮ মণ ধান বেচতে হয়। সেক্ষেত্রে নগদ টাকায় মজুরি পরিশোধ করে কৃষকের হাতে থাকে কেবল খড়কুটো। কৃষি শ্রমিকের সঙ্কট নিরসনে কৃষি যান্ত্রিকীকরণের কথা বলা হচ্ছে জোরেশোরে। তবে এখানেও নানা প্রতিবন্ধকতা ও জটিলতা। খ- খ- জমি, শত্রু-মিত্র নির্বিশেষে নানা মালিকানায় বিভক্ত। বাঙালীরা কোন একটি বিষয়ে ভাইয়ে ভাইয়ে কিংবা বাপে-পুতে পর্যন্ত মিলমিশ হয় না। সেক্ষেত্রে কৃষি কাজে হবে এমন আশা করা বাতুলতা। বাঙালীর নিষ্ঠুরতা ও নৃশংসতার সামান্য একটু পরিচয় দেই। নিছক শত্রুতাবশত সে প্রতিবেশীর ভরভরন্ত কলাগাছের বাগান অথবা পেঁপে কিংবা পটলের ক্ষেত কেটে সাফ করে ফেলে রাতারাতি। পুকুরে বিষ ঢেলে নির্বংশ করে দেয় লাখ টাকার পোনা মাছ। কারওবা গোয়ালঘরে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে মারে জ্যান্ত পবাদিপশু অথবা খামারের মুরগি। এসব খবর প্রায়ই মেলে বিভিন্ন গণমাধ্যমে। সে অবস্থায় কৃষির যান্ত্রিকীকরণ বহুত দূর অস্ত। ধান কাটার জন্য শ্রমিকের বিকল্প হিসেবে পাওয়া যায় কম্বাইন্ড হারভেস্টার, যা দিয়ে মাঠে ধান কেটে বস্তাবন্দী করা যায়। তবে দাম বেশি। ৩০ শতাংশ ছাড়েও কিনতে আগ্রহী হচ্ছেন না কৃষক। অথচ সমবায় প্রথা সফল হলে অথবা বৃহৎ আকারের কৃষি খামার গড়ে উঠলে এ সমস্যার সহজ সমাধান হতো। অর্থমন্ত্রী বলেছেন, চলতি বাজেটে কৃষি খাতে ভর্তুকি বাড়বে না কমবে তা নির্ভর করছে পরিস্থিতির ওপর। আগামী দু’বছর পর তিনি কৃষি খাতে এবং কৃষকের ওপর কর আরোপের কথাও বলেছেন। ভাল কথা। তবে তার আগে ৯০ শতাংশ বঞ্চিত কৃষকের কথা মাথায় রেখে কৃষি খাতে আমূল সংস্কারের বিষয়টি ভাবতে হবে সরকারকে।
×