বিভাষ বাড়ৈ ॥ এমপিওভুক্ত স্কুল-কলেজের পরিচালনা পর্ষদে সংসদ সদস্যদের সভাপতি মনোনীত না করার বিষয়ে সুপ্রীমকোর্টের রায়কে স্বাগত জানিয়েছেন দেশের বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ, শিক্ষকসহ সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা। রায় কার্যকরে সরকারকে উদ্যোগ নেয়ার আহ্বান জানিয়ে তারা বলেছেন, এর ফলে একদিকে এমপিদের ‘নিয়োগ ও ভর্তি বাণিজ্যের অপবাদ’ সইতে হবে না অন্যদিকে শিক্ষার মান বিশেষত নিয়োগে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা সহজ হবে। শিক্ষাবিদরা একই সঙ্গে সভাপতি ও সদস্য পদে অশিক্ষিত-শিক্ষাবহির্ভূত অযোগ্যদের প্রবেশ বন্ধে শিক্ষাগত যোগ্যতা নির্ধারণ করে দেয়ার সুপারিশ করেছেন। এদিকে, রায় বাস্তবায়নে অন্তর্বর্তীকালীন এডহক কমিটি গঠনের নামে আমলাদের সভাপতি করা নিয়েও ঘোরতর আপত্তি তুলেছেন শিক্ষক নেতারা।
জানা গেছে, রায়ের পর এখন নিয়মিত লিভ পিটিশন দায়ের ও রিভিউ ছাড়া এডহক কমিটি গঠনের পরিকল্পনাও আছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং শিক্ষা বোর্ডের। তবে সবকিছুই হবে রায়ের বিস্তারিত দেখে এ্যাটর্নি জেনারেল, সংসদ সদস্যসহ সরকারের সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলোচনা করে। এ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম রবিবার রায়ের পরই বলেছেন, আপীল বিভাগ কোন আদেশ দেয়নি। হাইকোর্টের রায়সহ লিভ পিটিশন দায়ের করলে তখন বিষয়টি বিবেচনা করবেন বলে জানিয়েছেন। হাইকোর্টের রায়ের কপি পেলে আমরা স্কুলের পক্ষ থেকে নিয়মিত লিভ পিটিশন দায়ের করব বলে জানান এ্যাটর্নি জেনারেল। কখন থেকে এ কমিটি বাতিল বলে গণ্য হবে জানতে চাইলে মাহবুবে আলম বলেন, ‘হাইকোর্টের রায়টা যতক্ষণ পর্যন্ত স্কুল-কলেজ কর্তৃপক্ষের কাছে না কমিউনিকেট (পৌঁছবে) হবে সে পর্যন্ত তো তার দিকনির্দেশনাগুলো স্কুল-কলেজ কর্তৃপক্ষের কাছে অজানা রয়ে গেছে ধরতে হবে। রায়ের পর এখন পরবর্তী পদক্ষেপ সম্পর্কে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ জনকণ্ঠকে বলেছেন, সুপ্রীমকোর্টের নির্দেশ অনুযায়ী সংসদ সদস্য ও আইনজীবীদের সঙ্গে আলোচনা করে কার্যকর করা হবে। তিনি বলেন, এখন সহকর্মীদের সঙ্গে কথা বলব, আমাদের আর কিছু করার আছে কি-না। আইনজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলব, এমপিরা কিভাবে জিনিসটা নিচ্ছেন সেটাও দেখার দরকার আছে। যারা আমাদের স্ট্যান্ডিং কমিটিতে আছেন যদি মনে করেন আরও কিছু করার আছে তখন বিবেচনা করা হবে। সংসদ সদস্যদের শুধু চারটি প্রতিষ্ঠান নয়, এলাকার ১শ’-২শ’, ৩শ’-৪শ’ প্রতিষ্ঠান আছে, সেগুলোও দেখাশোনা করতে হয় বলেও মন্তব্য করেন শিক্ষামন্ত্রী। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমরা আপীল করেছিলাম, তার মানে আমরা চাইছি এটা থাকুক। সুপ্রীমকোর্টে টেকাতে পারিনি। আগে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি নিয়ে কোন নিয়ম-নীতি ছিল না জানিয়ে মন্ত্রী বলেন, আমরা একটা শৃঙ্খলার মধ্য নিয়ে আসি। সংসদ সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে ঠিক করলাম, তারা যে কোন চারটিতে ইচ্ছা প্রকাশ করে সভাপতি হতে পারবেন। এছাড়া যেগুলো আছে সেগুলো আইন অনুযায়ী নির্বাচিত হবেন। ওনারাও সন্তুষ্ট ছিলেন, আমরাও চাচ্ছিলাম চলুক।
এর আগে রবিবার এমপিওভুক্ত স্কুল-কলেজের পরিচালনা পর্ষদে সংসদ সদস্যদের সভাপতি পদে মনোনীত হওয়া নিয়ে হাইকোর্টের রায় বহাল রাখে আপীল বিভাগ। গবর্নিং বডির বিশেষ কমিটির বিধান অবৈধ বলে হাইকোর্টের দেয়া রায়ও বহাল রেখেছে আপীল বিভাগ। হাইকোর্টের রায় স্থগিত চেয়ে করা এক আবেদনের শুনানি শেষে প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বাধীন পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ এ আদেশ দেন। এর ফলে মনোনীত হয়ে সভাপতি পদে থাকতে পারবেন না সংসদ সদস্যরা। সভাপতি হতে হলে তাঁকে পরিচালনা পর্ষদের সদস্যদের ভোটে নির্বাচিত হয়ে আসতে হবে।
গত ১ জুন একটি রিট আবেদনের নিষ্পত্তি করে বিচারপতি জিনাত আরা ও বিচারপতি একেএম জহিরুল হকের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ ২০০৯ সালে প্রণীত মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক স্তরের বেসরকারী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের গবর্নিং বডি ও ম্যানেজিং কমিটি প্রবিধানমালার ৫(২) ও ৫০ বিধি অবৈধ ঘোষণা করে রায় দেন।
সর্বশেষ ২০০৯ সালের জুনে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক স্তরের বেসরকারী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের গবর্নিং বডি ও ম্যানেজিং কমিটি প্রবিধানমালা তৈরি হয়। ওই প্রবিধান অনুযায়ী, একজন সাংসদ সর্বোচ্চ চারটি বেসরকারী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সভাপতি হতে পেরেছেন। তবে ওই প্রবিধানের ৫(২) ধারা আদালত অবৈধ ঘোষণা করায় এখন সাংসদরা ইচ্ছা করলেই আর সর্বোচ্চ চারটি স্থানীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সভাপতি হতে পারবেন না। তবে ৫(১) বিধি অনুসারে সাংসদদের সর্বোচ্চ চারটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সভাপতি নির্বাচিত হতে কোন বাধা নেই। হাইকোর্টের ওই রায় স্থগিত চেয়ে (সিএমপি) ভিকারুননিসা নূন স্কুল কর্তৃপক্ষ আপীল বিভাগে আবেদন করেছিল। এ আবেদন শুনে প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা নেতৃত্বাধীন আপীল বিভাগের চার বিচারকের বেঞ্চ রবিবার ‘নো অর্ডার’ দেন।
রায়ের পর এখন আইনী পদক্ষেপের বাইরে অন্তর্বর্তীকালীন এডহক কমিটি গঠনের চিন্তাভাবনাও চলছে শিক্ষা বোর্ডগুলোতে। কর্মকর্তারা এ নিয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে আলোচনা করছেন। এডহক কমিটির প্রধান থাকবেন জেলা প্রশাসক অথবা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা। এমন হলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো ফের আমলাদের কাছেই যাচ্ছে, যা তারা এতদিন ধরে চেয়ে আসছিলেন। ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মাহবুবুর রহমান আদালতের রায়ের পর করণীয় সম্পর্কে বলছিলেন, এ্যাটর্নি জেনারেলের সঙ্গে তারা কথা বলবেন। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পরামর্শ নিয়ে আইনী কোন পদক্ষেপ নেয়া যায় কি-না তা আগে দেখা হবে। এর পর যদি না হয় সেক্ষেত্রে এমপিরা যেসব কমিটিতে আছেন, যেখানে বছরের পর বছর ধরে বিশেষ কমিটি আছে সেগুলো ভেঙ্গে দিয়ে বিধান অনুসারে এডহক কমিটি করা হবে ছয় মাসের জন্য। এ সময়ের মধ্যে নির্বাচনের ব্যবস্থা করা হবে।
কিন্তু এডহক কমিটি করা হলে তো আবার আমলারা চলে আসবেন, যা নিয়ে শিক্ষক সংগঠনগুলোর ব্যাপক আপত্তি আছে। এ বিষয়ে চেয়ারম্যান বলেন, হ্যাঁ। এডহক কমিটি হলে তো আমলারা আসবেন। ডিসি, টিএনও। দেখা যাক। করলেও দীর্ঘ সময়ের জন্য হবে না। নির্বাচন করে নিয়মিত কমিটি করে দিয়ে যাবেন। তবে সরকারের পরবর্তী পদক্ষেপ যাই হোক না কেন, আদালতের রায়কে স্বাগত জানিয়েছেন শিক্ষাবিদরা। স্বস্তি প্রকাশ করেছেন শিক্ষক নেতা ও শিক্ষা সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরাও।
বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. মোঃ আখতারুজ্জামান বলছিলেন, রায় স্বস্তির। তবে সংসদ সদস্যদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সভাপতি করার উদ্দেশ্য কিন্তু মহৎ ছিল। তারা এলাকার জনপ্রতিনিধি, প্রতিষ্ঠানের কাজের ভাল-মন্দ তারা দেখতে পারেন। কিন্তু যেভাবেই হোক তাদের মনোনীত ব্যক্তি তা অনেকের বিষয়ে নানা অনিয়মের প্রশ্ন সামনে চলে এসেছে। এতে সাংসদদের নিয়ে আসার উদ্দেশ্য ব্যাহত হয়েছে। তবে এখন সাংসদরা না থাকলেই ভাল হয়ে যাবে তা কিন্তু নয়। এলাকার সত্যিকারের বিদ্যোৎসাহী ভাল মনের মানুষকে খুঁজে বের করতে হবে। তাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যুক্ত করতে হবে। আর একটা কথা, সভাপতি ও সদস্য পদে আসার জন্য শিক্ষাগত যোগ্যতা নির্ধারণ করে দিতে হবে। অন্যথায় অযোগ্য শিক্ষাবহির্ভূত ব্যক্তি বা যে কেউ সেখানে চলে আসতে পারে। এ বিষয়টি ভেবে দেখা জরুরী।
শিক্ষক নেতা জাতীয় শিক্ষক-কর্মচারী ফ্রন্টের প্রধান সমন্বয়কারী অধ্যক্ষ কাজী ফারুক আহমেদ রায়কে স্বাগত জানিয়ে বলেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিচালনায় বাইরের ব্যক্তিরা কেন থাকবে? স্কুলের পরিচালনা প্রধান হবেন প্রধান শিক্ষক ও কলেজের অবশ্যই অধ্যক্ষ। শিক্ষানীতি প্রণয়ন কমিটির সদস্য সচিব অধ্যাপক শেখ ইকরামুল কবির সুপ্রীমকোর্টের রায়কে স্বাগত জানিয়ে বলেছেন, রায় কার্যকরে সরকারকে এখন উদ্যোগ নিতে হবে। রায়ে শিক্ষার মান বিশেষত নিয়োগে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা সম্ভব হবে। তিনি একই সঙ্গে সভাপতি ও সদস্য পদে অশিক্ষিত শিক্ষাবহির্ভূত অযোগ্যদের প্রবেশ বন্ধে শিক্ষাগত যোগ্যতা নির্ধারণ করে দেয়ার সুপারিশ করেন।