ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১১ মে ২০২৪, ২৭ বৈশাখ ১৪৩১

বিএসসির করুণ হাল

প্রকাশিত: ০৭:০৬, ৮ জুন ২০১৬

বিএসসির করুণ হাল

মোয়াজ্জেমুল হক, চট্টগ্রাম অফিস ॥ রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা বাংলাদেশ শিপিং কর্পোরেশনের (বিএসসি) এ যেন করুণ হাল। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর দিনে দিনে সংস্থার বহরে যোগ হয়েছিল সর্বোচ্চ ৩৬টি বিভিন্ন শ্রেণীর জাহাজ। কিন্তু অযোগ্যতা, অদক্ষতা আর দুর্নীতির রাহুগ্রাসে এই বহর আর নেই। সেই ৩৬ জাহাজ থেকে কমতে কমতে এখন সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৩। আবার এ তিনটির মধ্যে একটি সহসা স্ক্র্যাপ ঘোষণার অপেক্ষায় রয়েছে। অথচ, তিন মাস আগেও বিএসসির পক্ষ থেকে হাঁকডাক এমন ছিল যে, সংস্থার বহরে ২১ সালের মধ্যে নতুন ২১টি জাহাজ যোগ হবে। গত চার বছর ধরে ‘বিএসসি’র বহরে নতুন জাহাজ’ যোগ হচ্ছে, তেল পরিবহনের জন্য একটি মাদার ট্যাঙ্কারও কেনা হবে। বিএসসি ও মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে এ বক্তব্য শুনতে শুনতে তা এখন বিশ্বাসযোগ্যতা হারিয়েছে। বাস্তবতা হচ্ছে, রাষ্ট্রীয় এ সংস্থাটি যে করুণ অবস্থার অতল গহ্বরে নিপতিত হয়েছে তা থেকে সোজা হয়ে দাঁড়ানোর লক্ষণ দৃশ্যমান নয়। আশ্চর্য হওয়ার কিছুই থাকবে না সব জাহাজ স্ক্র্যাপ ঘোষিত হওয়ার পর বিএসসি নামক সংস্থাটিকেও যদি স্ক্র্যাপ ঘোষণা করে দেয়া হয়। অনুসন্ধানে দেখা যায়, ধ্বংসের একেবারে শেষ প্রান্তে চলে এসেছে বিএসসি। মেয়াদোত্তীর্ণ জাহাজ, কর্মকর্তা ও জাহাজী অফিসারদের অনিয়ম, অদক্ষতা আর প্রতিটি ক্ষেত্রে দুর্নীতি এর মূল কারণ। এটি এখন ধুঁকছে। বহির্বিশ্বে চলাচলের উপযুক্ততা হারিয়েছে বহু আগে। সর্বশেষ গত বছরের মাঝামাঝি সময়ে বাংলার শিখা নামের জাহাজটি শ্রীলংকার কলম্বো বন্দরে গিয়েছিল। যেটি বর্তমান তিনটি জাহাজের একটি। এটির দুটি ইঞ্জিনই এখন বিকল হয়েছে। গেল রোয়ানু যখন চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙ্গর এলাকা দিয়ে আঘাত শুরু করে তখন এটি নোঙ্গর ছিড়ে সন্দ্বীপ চ্যানেল উপকূলে আছড়ে পড়ে। এটিকে এখন যে কোন মুহূর্তে স্ক্র্যাপ ঘোষণা করে দেয়া হতে পারে। অবশিষ্ট দুটি জাহাজ হচ্ছে বাংলার জ্যোতি ও বাংলার সৌরভ। এ দুটি জাহাজ লাইটার ট্যাঙ্কার। বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন বিদেশ থেকে যে জ্বালানি তেল আমদানি করে আনে তা আসে মাদার ট্যাঙ্কারের মাধ্যমে। এসব মাদার ট্যাঙ্কার বন্দরের বহির্নোঙ্গরে অর্থাৎ কুতুবদিয়ার কাছাকাছি নোঙ্গর করে অবস্থান নিতে হয়। বন্দর চ্যানেলে প্রবেশ করতে পারে না প্রয়োজনীয় গভীরতা না থাকার কারণে। ফলে এসব জ্বালানি তেল লাইটারিংয়ের মাধ্যমে রাষ্ট্রায়ত্ত জ্বালানি তেলের তিন কোম্পানি পদ্মা, মেঘনা ও যমুনার পতেঙ্গার গুপ্তখালের অয়েল ট্যাঙ্কে নিয়ে আসা হয়। এ মূল কাজটি করানো হয় বিএসসির মাধ্যমে। এখন প্রশ্ন উঠেছে,্ এ দুটি ট্যাঙ্কারও মেয়াদোত্তীর্ণ হয়েছে বহু আগে। বাংলার শিখার মতো এ দুটি জাহাজেরই যদি ভাগ্য বিপর্যয় ঘটে তাহলে দেশে জ্বালানি পরিবহনের ক্ষেত্রে বড় ধরনের বিপর্যয় নেমে আসার আশঙ্কা রয়েছে। বর্তমানে বাংলার জ্যোতি ও বাংলার সৌরভ চলাচল করছে আন্তর্জাতিক বহু নিয়মাবলী উপেক্ষা করে। এ দুই জাহাজের বহির্বিশ্বে যাওয়ার অনুমোদন নেই। পাশাপাশি দেশের অভ্যন্তরেও এ দুটি জাহাজের জন্য আন্তর্জাতিক ক্লাসও কিভাবে বৈধতা দিচ্ছে তা নিয়েও নানা প্রশ্ন রয়েছে। সূত্র জানায়, মূলত বিএসসি নতুন জাহাজ কেনার সক্ষমতা হারিয়েছে বহু আগে। তবে কিছুদিন পর পর সংস্থাটির পক্ষ থেকে তাদের বহরে মাদার ট্যাঙ্কারসহ কন্টেনার জাহাজ যুক্ত হচ্ছে-এমন একটি বক্তব্য রীতিমতো স্লোগানে পরিণত হয়েছে। জাহাজ কেনার নামে মন্ত্রণালয় ও সংস্থার কর্মকর্তাদের বিদেশ ভ্রমণ নিয়মিত কাজে পরিণত হয়েছে। ভারতীয় মালিকানার একটি মাদার ট্যাঙ্কার দেখতে সংস্থার এমডি ও ইডির বন্দরের বহির্নোঙ্গর এলাকায় যাওয়ার ঘটনাও রয়েছে। অভিযোগ উঠেছে, নতুন করে তেলবাহী জাহাজ কেনার নতুন একটি পাঁয়তারা মাথাছাড়া দিয়ে ওঠায় কর্মকর্তাদের বিদেশ ভ্রমণ বেড়েছে। মন্ত্রণালয়ের একশ্রেণীর দুর্নীতিবাজদের কারণে সংস্থার কর্মকর্তারা জাহাজ কেনার নতুন নতুন প্রজেক্ট বানিয়ে রীতিমতো ফায়দা লুটছে। সংস্থার ফাইন্যান্স শাখার এক কর্মকর্তা বুধবার জনকণ্ঠকে জানান, বিএসসির মালিকানায় এখন যে তিনটি জাহাজ রয়েছে এটাকে আর বহর বলা যায় না। আর এ সংস্থায় নতুন কোন জাহাজ যোগ হওয়ার সম্ভাবনা একেবারেই ক্ষীণ। এর কারণ হিসেবে তিনি জানান, জাহাজ ব্যবসায় বাণিজ্যিক ও প্রযুক্তিগত কাজে যারা জড়িত আছেন তাদের সকলের জ্ঞানের মেয়াদ বহু আগেই ফুরিয়ে গেছে। ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার সনদ দেখিয়ে সংস্থায় কারও চাকরির মেয়াদ বেড়েছে। একজন উর্ধতন কর্মকর্তা অলস সময় পার করছেন সংস্থার ব্যবসা না থাকার কারণে। তবে এ সংস্থার বিভিন্ন শাখায় কর্মরত ২২০ কর্মকর্তা-কর্মচারীর ভবিষ্যত বেতন-ভাতা ঢাকা ও চট্টগ্রামে অবস্থিত ভবন ভাড়া থেকে মেটানো যাবে বলে মনে করেন সংস্থার অনেক কর্মকর্তা। সূত্র জানায়, বর্তমানে ভাসমান যে তিনটি জাহাজ রয়েছে এর অফিসারদের অধিকাংশের বিদেশী জাহাজে চাকরির দক্ষতা না থাকায় এসব জাহাজেই থাকছেন। একটি তেলবাহী জাহাজের প্রধান প্রকৌশলী দীর্ঘ এগারো বছর যাবত এক জাহাজে নাম লিখিয়ে মাসের ২০ দিনই থাকেন ঢাকায়। যার জন্য সংস্থাকে মাসিক বেতন গুনতে হয় চার হাজার ডলারেরও বেশি। এছাড়া বাড়তি এ সুবিধার জন্য প্রযুক্তি বিভাগে নানাবিধ খরচ দিতে হয়। বিএসসির জাহাজ সংখ্যা একেবারেই হ্রাস পাওয়ায় এ সেক্টরে দেশীয় অফিসার ও নাবিকদের চাকরির পদ সঙ্কুচিত হয়ে গেছে। আরেকটি বিষয় হচ্ছে, বিএসসির এ তিন জাহাজ দেশের বাইরে না গেলেও মেরামত কার্যক্রমের নামে অর্থ লোপাটের বিষয়টি থেমে নেই। সূত্র জানায়, বিএসসির বহরে নতুন ১৬টি জাহাজ যুক্ত হবে এমন ঘোষণাও রয়েছে। প্রথম পর্যায়ে ৬টি জাহাজ চীন থেকে আনা হবে আগামী ২০১৮ সালের মধ্যে -এমন কথাও চাউর করা হয়েছে। বিএসসির বোর্ড সভায় কর্মকর্তারা এ নিয়ে নানা সিদ্ধান্তও গ্রহণ করেছেন, যে বোর্ড সভায় মন্ত্রী থেকে সচিব পর্যন্ত উপস্থিত থাকেন। বুধবারও বিএসসি সূত্রে দাবি করা হয়েছে নতুন ৬টি জাহাজ কেনার বিষয়টি পাইপ লাইনে রয়েছে। এ ব্যাপারে সংস্থার একাধিক সূত্র বলেছে, এসব তথ্য সঠিক নয়। দিনে দিনে বা রাতারাতি জাহাজ কেনা সম্ভব নয়। সঙ্গতভাবে বিএসসির পক্ষ থেকে জাহাজ কেনার যে ঘোষণা এর কোন প্রক্রিয়া দৃশ্যমান নয়। কর্মকর্তাদের ঘোষণা ঘোষণাতেই থেকে যাচ্ছে। আর রাষ্ট্রীয় মালিকানার এ সংস্থাটিকে ঘুরে দাঁড় করানোর চেষ্টার নানা বাণী শুনিয়ে লুটপাটের প্রক্রিয়া সমাপ্ত করে এটির কফিনে শেষ পেরেক মারার অপেক্ষায় রয়েছে বলে জোরালো অভিযোগ রয়েছে।
×