ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

মূল : গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস;###;অনুবাদ : খুররম মমতাজ

আমি শুধু টেলিফোনটা ব্যবহার করতে এসেছিলাম

প্রকাশিত: ০৭:১৯, ৩ জুন ২০১৬

আমি শুধু টেলিফোনটা ব্যবহার করতে এসেছিলাম

(পূর্ব প্রকাশের পর) সেদিন বিকেলেই মারিয়াকে পাগলা গারদে ভর্তি করা হলো। তাকে একটা সিরিয়াল নম্বর দেয়া হলো। তার রহস্যজনক আগমন আর পরিচয় নিয়ে কিছু অবান্তর মন্তব্যসহ একটা ফাইল খোলা হলো তার নামে। মার্জিনে ডিরেক্টর সাহেবের স্বহস্তে লেখা মন্তব্য : উত্তেজিত। যেমনটা মারিয়া ভেবেছিল ঠিক সেভাবেই তার স্বামী সেদিন প্রোগ্রাম তিনটা করার লক্ষ্যে তাদের হর্টা এলাকার অ্যাপার্টমেন্ট থেকে আধঘণ্টা দেরিতে বেরিয়েছিল। গত দুই বছর ধরে তারা খুবই শান্তিপূর্ণভাবে একসঙ্গে বসবাস করে আসছে। এই প্রথম মারিয়ার দেরি হলো। দেরি দেখে ওর স্বামী ভাবলা প্রবল বৃষ্টিপাতের কারণেই মারিয়া সময়মতো আসতে পারেনি। এই উইকএন্ডে সারা প্রদেশ জুড়েই বৃষ্টিপাত হয়েছে। অ্যাপার্টমেন্ট থেকে বেরোবার আগে সে দরজায় একটা চিরকুট সেঁটে দিল, চিরকুটে লিখে রেখে গেল ওই রাতে কখন কোথায় থাকবে। প্রথম যে পার্টিটা ছিল সেখানে বাচ্চারা সবাই ক্যাঙ্গারুর পোশাক পরে এসেছে। জাদুকর তার সবচেয়ে ভাল খেলাটাই দেখাতে পারল না। খেলাটা ছিল মাছ অদৃশ্য করার একটা খেলা। সহকারীর সাহায্য ছাড়া খেলাটা দেখানো সম্ভব নয়। দ্বিতীয় পার্টিটা ছিল তিরানব্বই বছর বয়সী এক বুড়ির বাড়িতে। হুইল চেয়ারে বসা বুড়ি জাঁক করে সব সময় বলে- গত তিরিশ বছরে সে তিরিশটা জন্মদিন উদযাপন করেছে ভিন্ন ভিন্ন তিরিশজন জাদুকরের জাদু দেখে। মারিয়া আসতে পারেনি দেখে তার মন এতই খারাপ হলোÑ কোন জাদুই তার ভাল লাগল না। তৃতীয় প্রোগ্রামটা জাদুকর প্রতি রাতেই করে রাম্বলাস রোডের একটা কাফেতে। সেদিন একদল ফরাসী ট্যুরিস্ট ছিল তার দর্শক। শোটা খুব বাজে হলো। দর্শকরাও এমন, তারা ম্যাজিকেই বিশ্বাস করে না, কাজেই যা দেখল সেটাও তারা বিশ্বাস করল না। প্রত্যেকটা শোর শেষে ম্যাজিশিয়ান তার বাড়িতে ফোন করল, অপেক্ষা করল উদ্বিগ্নভাবে মারিয়ার উত্তরের জন্য। শেষবার ফোন করার পর তার মনে হলো মারিয়ার নিশ্চয়ই কিছু হয়েছে। ভ্যান চালিয়ে বাড়ি ফিরল জাদুকর। ভ্যানটাকে এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে যেন ওটার ওপর খোলা আকাশের নিচে জাদু দেখানো যায়। পাসেও দা গ্রাসিয়া রোড ধরে বাড়ি ফেরার পথে বসন্তের বাতাসে দোল খাওয়া পাম গাছের সারির অপরূপ সৌন্দর্য দেখতে দেখতে হঠাৎ তার অন্তরাত্মা কেঁপে উঠল ভয়ে- মারিয়া যদি হারিয়ে যায়! তাহলে এই অপরূপ সৌন্দর্যও তো হারিয়ে যাবে এ শহর থেকে! দরজায় চিরকুটটা দেখে তার শেষ আশা-ভরসাটুকুও যেন শেষ হয়ে গেল। এতটাই হতাশ আর হতোদ্যম হয়ে পড়ল জাদুকর যে তার বেড়ালটাকে খাবার দিতেও সে ভুলে গেল। ওর কথা লিখতে গিয়ে এখন আমার মনে হচ্ছে জাদুকরের পুরো নামটাও তো আমি জানি না। বার্সেলোনায় ওকে আমরা স্যাটুর্নো দি ম্যাজিশিয়ান নামেই জানতাম। অদ্ভুুত স্বভাব ছিল লোকটার, মানুষজনের সঙ্গে সহজভাবে মেলামেশা করতে পারত না, কিন্তু মারিয়া সবকিছু সামলে নিত, আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব ছিল মারিয়ার। সে-ই তাকে হাত ধরে এগিয়ে নিয়ে গেছে রহস্যময় জটিল এই সমাজের ভেতর দিয়ে, যেখানে কোন স্বামী মধ্যরাতের পরে তার স্ত্রীর খোঁজ নিতে সাহস পায় না। স্যাটুর্নোর সেই সাহস ছিল, সারাগোসায় সে ফোন করল, ঘুম জড়ানো গলায় দিদিমা তাকে জানাল মারিয়া লাঞ্চের পর বিদায় নিয়েছে, দিদিমার গলায় বিন্দুমাত্র উৎকণ্ঠার আভাস নেই। ভোররাতের দিকে জাদুকর মাত্র ঘণ্টাখানেকের মতো ঘুমোতে পারল। ঘুমের মধ্যে ও দুঃস্বপ্ন দেখলÑ রক্তমাখা ছেঁড়া একটা বিয়ের পোশাক পরে আছে মারিয়া, ঘুম ভেঙ্গে ভীতসন্ত্রস্ত জাদুকরের মনে হলো মারিয়া নির্ঘাত তাকে এবার ছেড়ে গেছে চিরতরে, এই বিপুল বিশাল পৃথিবীতে এখন সে একা। গত পাঁচ বছরে মারিয়া তিনজন পুরুষকে ছেড়েছে, তার মধ্যে জাদুকর নিজেও একজন। পরিচয় হওয়ার ছয় মাসের মাথায় মেক্সিকো সিটিতে ওরা তখন এক পরিচারিকার ঘরে ভালবাসায় ভরা উন্মাতাল সময় কাটাচ্ছিল। এক রাতে প্রবল ভালোবাসাবাসির পর সকালে উঠে জাদুকর দেখে মারিয়া চলে গেছে। নিজের যা কিছু ছিল সব সে রেখে গেছে, এমনকি আগের বিয়ের আংটিটা পর্যন্ত। একটা চিঠিও লিখে রেখে গেছে, তাতে লেখা ছিল এ রকম প্রমত্ত ভালবাসার ভার সে আর বইতে পারছে না। স্যাটুর্নো ভেবেছিল মারিয়া তার প্রথম স্বামীর কাছে ফিরে গেছে, প্রথম স্বামী ছিল মারিয়ার সহপাঠি, তাকে ও সাবালিকা হওয়ার আগেই গোপনে বিয়ে করেছিল, তারপর প্রেমহীন দুটি বছর সেই সহপাঠীর সঙ্গে কাটানোর পর অন্য আরেকজনের কারণে তাকে ছেড়ে যায়। কিন্তু না, মারিয়া গিয়েছিল ওর বাবা-মায়ের কাছে, ওকে ফিরিয়ে আনার জন্য স্যাটুর্নোও পিছে পিছে গিয়ে হাজির হয়েছিল। ওর সানুনয় অনুরোধ ছিল নিঃশর্ত। এমন অনেক প্রতিশ্রুতি জাদুকর দিয়েছিল যেগুলো রক্ষা করার সামর্থ্যও ওর ছিল না। কিন্তু অদৃশ্য এক দেয়ালে যেন আটকে গেল ওর সব প্রতিশ্রুতি। মারিয়া ওকে বলল, ‘ভালবাসা আছে দুই রকমÑ দীর্ঘ ভালবাসা আর সংক্ষিপ্ত ভালবাসা।’ তারপর নিষ্ঠুর সেই সত্যটা উচ্চারণ করল সে, ‘এটা ছিল সংক্ষিপ্ত ভালবাস।’ ওর জেদের কাছে হার মানল স্যাটুর্নো। এরপর প্রায় একটি বছর জোর করে ওকে ভুলে থাকার পর অল সেইন্টস ডের গভীর রাতে শূন্য ঘরে ফিরে এসে স্যাটুর্নো দেখল ড্রইংরুমের সোফায় ঘুমিয়ে আছে মারিয়া, ওর মাথায় ফুলের মুকুট আর গায়ে বিয়ের কনের দীর্ঘ সাদা পোশাক। সত্যি কথাই বলল তাকে মারিয়া। তার নতুন প্রেমিক, যে কিনা একজন সন্তানহীন বিপতœীক, সে চেয়েছিল ক্যাথলিক চার্চে ওদের বিয়ে হবে, কনের সাজে সেজেগুজে অপেক্ষা করেছে মারিয়া বিয়ের বেদির কাছে, কিন্তু সে আসেনি। তবু মারিয়ার বাবা-মা বিয়ের অনুষ্ঠান চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। মারিয়াও রাজি হয়। আমন্ত্রিত বন্ধুদের সঙ্গে নেচে গেয়ে মাতাল হয়ে একসময় সে অনুতাপে দগ্ধ হয়ে মাঝরাতে বেরিয়ে পড়েছে স্যাটুর্নোর খোঁজে। স্যাটুর্নো তখন বাড়িতে ছিল না, দরজার বাইরে ফুলের টবে যেখানে ওরা চাবি রাখত, সেখানেই চাবিটা পেয়েছে মারিয়া। এবারে মারিয়াই নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ করল। ‘এবার কতদিনের জন্য?’ প্রশ্ন করেছিল স্যাটুর্নো। জবাবে ভিনিসিয়াস ডি মোর্সেসের কবিতার লাইন আউড়েছিল মারিয়া, ‘ভালবাসা ততদিনই চিরন্তন যতদিন বেঁচে থাকে।’ দু’বছর বাদে আজও তার ভালবাসা বেঁচে আছে। আগের চেয়ে অনেক পরিণতও হয়েছে মারিয়া। অভিনেত্রী হওয়ার বাসনা ছেড়ে ঘরের দিকে মন দিয়েছে, স্বামীর কাজের সঙ্গেও নিজেকে জড়িয়ে নিয়েছে। গত বছরের শেষ দিকে পেরপিগনানে অনুষ্ঠিত ম্যাজিশিয়ানদের একটা কনভেনশনে যোগ দিয়েছিল ওরা। সেখান থেকে ফেরার পথে বার্সেলোনায় এসেছিল প্রথমবারের মতো। জায়গাটা ওদের এত ভাল লেগে যায় যে এখানেই ওরা আছে গত আট মাস ধরে। একটা এ্যাপার্টমেন্টও কিনে নিয়েছে কাতালোনিয়ার পাশেই হর্টা এলাকায়। পরিবেশটা অবশ্য নিরিবিলি নয়, বিল্ডিংয়ের গেটে পোর্টারও নাই, কিন্তু এ্যাপার্টমেন্টটা বেশ বড়, পাঁচটা ছেলেমেয়ের জন্য যথেষ্ট। সুখে-শান্তিতেই দিন কাটছিল ওদের। শান্তি ভঙ্গ হলো উইকএন্ডে মারিয়া রেন্ট-এ-কার থেকে গাড়ি ভাড়া করে সারাগোসায় আত্মীয়দের বাড়িতে বেড়াতে যাওয়ার পর। সোমবার সন্ধ্যা সাতটার মধ্যে ওর ফিরে আসার কথা। কিন্তু আজ বৃহস্পতিবার সকালেও তার দেখা নেই। পরের সপ্তাহের সোমবারে রেন্ট-এ-কারের ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি থেকে টেলিফোন এলো, মারিয়াকে খুঁজছে তারা। ‘আমি কিছু জানি না,’ তাদের বলল স্যাটুর্নো, ‘আপনারা সারাগোসায় খোঁজ করুন।’ বলে লাইন কেটে দিল স্যাটুর্নো। এক সপ্তাহ পরে একজন পুলিশ অফিসার এলো। তার কাছে জানা গেল গাড়িটা পাওয়া গেছে, মারিয়া যেখানে গাড়ি রেখে গেছে সেখান থেকে নয়শ’ কিলোমিটার দূরে কাডিসের পথে এক নির্জন রাস্তায়, পার্টস সব খুলে নিয়েছে চোরের দল। এই চুরির ব্যাপারে মারিয়া কোন তথ্য দিতে পারে কিনা জানতে এসেছিল অফিসার। বিড়ালকে খাওয়াচ্ছিল স্যাটুর্নো। সেদিক থেকে চোখ না ফিরিয়েই সে অফিসারকে সোজা জানিয়ে দিল তারা শুধু শুধু সময় নষ্ট করছে, মারিয়া তাকে ছেড়ে গেছে, কার সঙ্গে গেছে কোথায় গেছে এসব সে কিছুই জানে না। ওর কথা শুনে অস্বস্তিতে পড়ে গেল অফিসার। ক্ষমা চেয়ে বিদায় নিল। মারিয়া যে তাকে আবার ছেড়ে যেতে পারে সেই সন্দেহ স্যাটুর্নোর মনে প্রথম উঁকি দিয়েছিল ঈস্টারের সময় কাদাকেসে বেড়াতে গিয়ে। রোসা রেগাস তাদের সেখানে সেইলিং করার আমন্ত্রণ জানিয়েছিল। মারিতিম নামের জনাকীর্ণ বারে আমরা প্রায় কুড়িজনের একটা দল একসঙ্গে চাপাচাপি করে বসেছিলাম ছয়জন বসতে পারে এ রকম একটা টেবিলে। সেদিনের দ্বিতীয় প্যাকেট সিগারেট যখন প্রায় শেষ, ম্যাচের কাঠি ফুরিয়ে গেল মারিয়ার। হই-হট্টগোলের ভেতর দিয়ে ব্রোঞ্জের ব্রেসলেট পরা শীর্ণ কোমল একটা হাত এগিয়ে এসে ওর সিগারেট ধরিয়ে দিল। ওর দিকে না তাকিয়েই ওকে ধন্যবাদ জানাল মারিয়া, কিন্তু জাদুকর স্যাটুর্নো ছেলেটাকে লক্ষ্য করেছিলÑ ছিপছিপে এক তরুণ, মৃতের মতো ফর্সা, কোমর পর্যন্ত লম্বা কুচকুচে কালো তার পনিটেল। জানালার কাঁচের ভেতর দিয়ে ঠা-া বাতাস আসছে, অথচ ছেলেটার গায়ে ছিল সুতির পায়জামা আর একজোড়া শস্তা স্যান্ডেল। শরতের শেষে আবার তার সঙ্গে ওদের দেখা হলো লা বারসেলোনেতার সি-ফুড বারে। পরনে আগের মতোই সুতির কাপড়, তবে মাথায় এবার তার পনিটেলের বদলে লম্বা বেণী। যেন কতকালের পুরনো বন্ধু এভাবে এগিয়ে এসে সে ওদের শুভেচ্ছা জানাল। যেভাবে ছেলেটা মারিয়াকে চুমু খেল এবং মারিয়া যেভাবে তাকে পাল্টা চুমু খেল, তা দেখে স্যাটুর্নোর মনে সন্দেহটা আরও গাঢ় হলো, তার মনে হলো ওরা দুজনে গোপনে দেখা-সাক্ষাত করছে। কিছুকাল পরে ফোনবুকে নতুন একটা নাম আর নম্বর দেখতে পেল স্যাটুর্নো। ওর ঈর্ষাকাতর মন বুঝে নিল কার নম্বর ওটা। তার নাম-ধাম আর পরিচয় জানার পর আরও নিশ্চিত হলো স্যাটুর্নোÑ ধনী পরিবারের একমাত্র সন্তান সে, বাইশ বছর বয়স, পেশায় ফ্যাশন শপের ডেকোরেটর, বাইসেক্সুয়াল বলে ওর দুর্নাম আছে, আরও দুর্নাম আছে বিবাহিতা মেয়েদের ভাড়াটে সান্ত¡নাদানকারী হিসেবে। স্যাটুর্নো নিজেকে সংযত রেখেছিল। কিন্তু যে রাতে মারিয়া ফিরল না, তারপর থেকে প্রতিদিন সে ওই যুুবককে টেলিফোন করতে লাগল। প্রথম প্রথম সকাল ছয়টা থেকে পরদিন ভোর হওয়া পর্যন্ত দু’তিন ঘন্টা পর পর টেলিফোন করত, তারপর এমন হলো হাতের কাছে টেলিফোন পেলেই ফোন করে স্যাটুর্নো। কেউ জবাব দিত না, এটাই ওকে আরও অস্থির করে তুলল। চতুর্থ দিন ঘরদোর ঝাড়ামোছা করে যে আন্দালুসিয়ান মহিলা, সে টেলিফোন তুলল। ‘বাড়ির মালিক চলে গেছেন,’ বলল সে। এ রকম ধোঁয়াটে কথায় স্যাটুর্নো যেন পাগল হয়ে গেল, জিজ্ঞেস না করে পারল না সিনোর মারিয়া ওখানে গিয়েছিল কিনা। ‘মারিয়া নামে এখানে কেউ থাকে না,’ মহিলা বলল, ‘ভদ্রলোক ব্যাচেলর।’ ‘মারিয়া ওখানে থাকে না, সেটা আমি জানি।’ স্যাটুর্নো বলল, ‘কিন্তু মাঝে মাঝে যায় তো?’ মহিলা বেজায় বিরক্ত হলো। ‘আপনার নামটা কি শুনি?’ স্যাটুর্নো ফোন রেখে দিল। মহিলার কথাবার্তা শুনে ওর মনে আর কোন সন্দেহ রইল না। নিজের ওপর সে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলল। পরের কয়েকটা দিন ফোনবুক ধরে ধরে পরিচিত সবাইকে টেলিফোন করল স্যাটুর্নো। কেউ কোন খোঁজ দিতে পারল না, শুধু শুধু প্রত্যেকটা ফোনকল ওর যন্ত্রণা আরও বাড়িয়ে দিল। কেননা গুজবপ্রিয় বন্ধুরা ঈর্ষাকাতর স্যাটুর্নোকে নিয়ে তামাশার খোরাক পেয়ে গেল, ইচ্ছে করেই তারা এমনভাবে ওর প্রশ্নের জবাব দিতে লাগল যেন ওদের কথায় বেচারা জাদুকর জ্বলে-পুড়ে খাক হয়ে যায়। অবশেষে স্যাটুর্নো বুঝতে পারল এই অপরূপ সুন্দর উন্মাতাল শহরে কি ভীষণ একা সে, কি দারুণ নিঃসঙ্গ আর অসুখী। এখানে সে সুখের নাগাল কোন দিনও পাবে না। সকালে বিড়ালকে খাওয়ালো স্যাটুর্নো, তারপর মনটাকে শক্ত করল- তাকে বাঁচতে হবে, ভুলে যেতে হবে মারিয়াকে। দুই মাস হয়ে গেল, এখনও মারিয়া স্যানাটোরিয়ামের জীবনের সঙ্গে নিজেকে ভালভাবে খাপ খাইয়ে নিতে পারেনি। লম্বা কাঠের টেবিলের ওপর চেইনে বাঁধা পাত্রের মধ্যে হাসপাতালের খাবার দেয়া হয়, সেখান থেকে সামান্য কিছু খাবার নিয়ে সেগুলো খেয়ে সে কোন রকমে বেঁচে আছে। অপরিচ্ছন্ন ডাইনিংরুমের দেয়ালে টাঙানো জেনারেল ফ্রান্সিসকো ফ্রাঙ্কোর বিরাট লিথোগ্রাফের দিকে সারাক্ষণ অন্যমনস্কভাবে তাকিয়ে থাকে মারিয়া। প্রথম প্রথম সে চার্চের গৎ বাঁধা প্রভাত-সঙ্গীত, স্তবগান, সন্ধ্যা-সঙ্গীত এসবে অংশ নিত না। খেলার মাঠে বল খেলতেও যেত না। অথবা ওয়ার্কশপে কৃত্রিম ফুল বানানোর কাজেও অংশ নিত না। কিন্তু সপ্তাহ তিনেক পর থেকে একটু একটু করে সে এসবে অংশ নিতে শুরু করে। ডাক্তাররা সব সময়ই বলে থাকেন- প্রথম প্রথম সবারই এ রকম হয়, পরে সব ঠিক হয়ে যায়। (চলবে)
×