ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১১ মে ২০২৪, ২৮ বৈশাখ ১৪৩১

তীব্র গ্যাস সঙ্কটের নেতিবাচক প্রভাব

চট্টগ্রামে বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান কমছে

প্রকাশিত: ০৩:৫৮, ২৭ এপ্রিল ২০১৬

চট্টগ্রামে বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান কমছে

আহমেদ হুমায়ুন, চট্টগ্রাম অফিস ॥ চট্টগ্রামে তীব্র গ্যাস সঙ্কটে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে বিনিয়োগ ও শিল্পক্ষেত্রে। বন্দরসহ নানা সুবিধার কারণে চট্টগ্রাম বিনিয়োগের জন্য অত্যন্ত আকর্ষণীয় স্থান হলেও আগ্রহী উদ্যোক্তারা অনেকটাই নিরুপায়। অনেকেই কারখানা স্থাপন করতে পারছেন না গ্যাস না থাকায়। আবার অনেক নতুন কারখানা যেতে পারছে না উৎপাদনে। এ সকল প্রতিষ্ঠানকে গুনতে হচ্ছে ব্যাংক ঋণের সুদ। চট্টগ্রামে বিনিয়োগ আকর্ষণ করতে গ্যাস, বিদ্যুতসহ অবকাঠামোগত উন্নয়ন ত্বরান্বিত করার দাবি জানিয়ে আসছেন বিনিয়োগকারী, শিল্পোদ্যোক্তা ও বিভিন্ন ট্রেড বডির প্রতিনিধিরা। তাদের অভিমত, পর্যাপ্ত অবকাঠামোগত সুযোগ-সুবিধা না থাকায় বিনিয়োগকারীরা এই অঞ্চল থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন। পরিসংখ্যানে দেখা যায়, চট্টগ্রামে বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান দুটোই কমছে। ২০১০ সালে যেখানে ২৯৮টি নতুন প্রতিষ্ঠানের বিপরীতে চট্টগ্রামে বিনিয়োগ হয়েছে ৩ হাজার ১০৬ কোটি ৪ লাখ টাকা। সেখানে ২০১৫ সালে বিনিয়োগ নেমে এসেছে অর্ধেকেরও নিচে। এই বছর ১২১টি প্রতিষ্ঠানের বিপরীতে বিনিয়োগ হয় ১ হাজার ৩৩৪ কোটি ১৬ লাখ টাকা। বিনিয়োগের পাশাপাশি এখানে দিন দিন কর্মসংস্থানও কমেছে। ৫ বছর আগে ২০১০ সালে কর্মসংস্থান হয়েছিল ৩০ হাজার ৬৪৯ জনের। সর্বশেষ ২০১৫ সালে এখানে কর্মসংস্থান হয়েছে মাত্র ৯ হাজার ৩৪২ জনের। প্রধানত গ্যাস সঙ্কটের কারণেই চট্টগ্রামে এ ধরনের পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে চট্টগ্রাম বিনিয়োগের জন্য সবচেয়ে আকর্ষণীয় স্থান হিসেবে বিবেচিত। কেবল দেশী বিনিয়োগকারীই নয়, সমুদ্রবন্দর থাকায় এখানে চীন, জাপান, ভিয়েতনাম, হংকং, কোরিয়াসহ বিশ্বের নানা দেশের বহু প্রতিষ্ঠান বিনিয়োগ করতে আগ্রহী। কিন্তু গ্যাস এবং জ্বালানি সঙ্কট এই সুযোগকে প্রতিবন্ধকতায় পর্যবসিত করছে। বিনিয়োগ উর্বর ক্ষেত্রকে ভয়াবহ রকমের খরায় পরিণত করছে। জানা গেছে, ২০১০ সালে চট্টগ্রামের আনোয়ারায় প্রায় ১০০ একর জমিতে ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্ক স্থাপনের কার্যক্রম শুরু করে ‘সাদ মুসা গ্রুপ।’ ২০টি শিল্প প্রতিষ্ঠানে প্রায় ২ হাজার ৪০০ কোটি টাকা বিনিয়োগের পরিকল্পনা হাতে নেয় তারা। পরবর্তী বছর পাঁচটি শিল্প কারখানা স্থাপনও করে তারা। কিন্তু গ্যাসের অভাবে কারখানাগুলো এখনও চালু করতে পারেনি তারা। অন্যদিকে জ্বালানির অভাবে অন্য কারখানাগুলো স্থাপন করতেও আগ্রহী হচ্ছে না তারা। শুধু তার নন, কারখানা স্থাপন করেও গ্যাসের অভাবে উৎপাদনে যেতে পারছে না চট্টগ্রামের একাধিক শিল্প গ্রুপ। এতে মূলধনী যন্ত্রপাতি নষ্ট হওয়া ছাড়াও ব্যাংক ঋণের সুদ পরিশোধে নাভিশ্বাস অবস্থা উদ্যোক্তাদের। আবার গ্যাসের নিশ্চয়তা না পাওয়ায় আগ্রহ থাকলেও নতুন শিল্প স্থাপনের সাহস করছেন না অনেকে। সব মিলিয়ে গ্যাস সংকটে থমকে আছে বন্দরনগরীর শিল্পায়ন। বিজিএমইএর সাবেক প্রথম সহসভাপতি নাছির উদ্দিন চৌধুরী জানান, ‘চট্টগ্রামে বিনিয়োগের অনেক সম্ভাবনা থাকলেও কিছু সঙ্কট তা বাধাগ্রস্ত করছে। ভূমি ও গ্যাস সংকটের কারণে অনেক নতুন উদ্যোক্তা এ অঞ্চলে আগ্রহ হারিয়ে অন্যত্র চলে যাচ্ছে। বিনিয়োগ বোর্ড সূত্র জানায়, ২০১০ সালে চট্টগ্রামের ইপিজেডসহ বিভিন্ন স্থানে ২৯৮টি শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠে। দেশী, বিদেশী এবং দেশী-বিদেশী যৌথ বিনিয়োগে প্রতিষ্ঠিত এ প্রতিষ্ঠানগুলোতে তিন হাজার ১০৬ কোটি চার লাখ ৩৬ হাজার টাকা বিনিয়োগ হয়। প্রতিষ্ঠানগুলোতে ৩০ হাজার ৬৪৯ জন মানুষের কর্মসংস্থান হয়। ২০১১ সালে চট্টগ্রাম তিন ক্যাটাগরিতে মোট ২৫১টি শিল্প প্রতিষ্ঠানের রেজিস্ট্রেশন করা হয়েছে। যেখানে ২ হাজার ৮৯৪ কোটি ২১ লাখ ৪৫ হাজার টাকার বিনিয়োগ হয়েছে। নয়া কর্মসংস্থান হয়েছে ২৯ হাজার ৯২১ জনের। পরের বছর ২০১২ সালে সেটি আরও কমে দাঁড়ায় ২২৮টি প্রতিষ্ঠানে। ওই বছর নয়া ২২৮টি প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগ হয় ২ হাজার ২৫৮ কোটি ৭৫ লাখ ২৯ হাজার টাকা। কর্মসংস্থান হয় আরও ৩৩ হাজার ৩৫০ জনের। ২০১৩ সালে চট্টগ্রামে ১৫৬ নতুন শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠে। বিনিয়োগ করা হয় ২ হাজার ৩৪৪ কোটি ১৪ লাখ ৩২ হাজার টাকা। এসব শিল্প কারখানায় নতুন কর্মসংস্থান হয় ১৬ হাজার ২৪ জনের। ২০১৪ সালে আরও কমে যায়। এ বছর ১৪৮টি শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠে। যেখানে বিনিয়োগ হয় ১ হাজার ৩০৪ কোটি ১৯ লাখ ৭৪ হাজার টাকা। কর্মসংস্থান হয় ১১ হাজার ৬২৯ জনের। সর্বশেষ ২০১৫ সালে দেশী, বিদেশী এবং যৌথ বিনিয়োগে চট্টগ্রামে গড়ে উঠা ১২১টি শিল্প প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগ হয়েছে ১ হাজার ৩৩৪ কোটি ১৬ লাখ ৬ হাজার টাকা এবং নয়া কর্মসংস্থান হয় ৯ হাজার ৩৪২ জনের। ফলে দেখা যাচ্ছে ৫ বছরের ব্যবধানে বিনিয়োগের পরিমাণ বহুগুণ বৃদ্ধি পাওয়ার কথা থাকলেও কমেছে ১ হাজার ৭৭২ কোটি ২৭ লাখ টাকার। একই সঙ্গে কর্মসংস্থান কমেছে ২১ হাজার ৩০৭ জনের। শুধু জ্বালানি সঙ্কটের কারণে এখানে বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান দুটোই কমছে। এদিকে গ্যাসের সঙ্কট বিনিয়োগে প্রভাব ফেললেও শীঘ্রই এ অঞ্চলে গ্যাস সঙ্কট কমে আসার সম্ভাবনা নেই বলে জানিয়েছেন কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির (কেজিডিসিএল) কর্মকর্তারা। কেজিডিসিএলের কর্মকর্তারা জানান, সাঙ্গু গ্যাসক্ষেত্র বন্ধ হয়ে যাওয়ায় জাতীয় গ্রিডের উপরই পুরোপুরি নির্ভর করতে হচ্ছে। ২০১২ সালে খাগড়াছড়ির সেমুতাং গ্যাসক্ষেত্র উৎপাদনে এলে সরবরাহ কিছুটা বাড়ে। বর্তমানে সেটিও নিঃশেষ হওয়ার পথে। এ কারণে এখানে দিন দিন গ্যাসের সঙ্কট ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে। তারা বলেন, তবে এ সঙ্কট বেশি দিন থাকছে না। সঙ্কট মোকাবেলায় সরকার এলএনজি (লিকুইড ন্যাচারাল গ্যাস) আমদানির উদ্যোগ নিয়েছে। ওই গ্যাস আমদানি শুরু হলে গ্যাস সঙ্কট থাকবে না। তবে তা পেতে আরও কয়েক বছর অপেক্ষা করতে হবে বলে জানান তারা। উল্লেখ্য, কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির (কেজিডিসিএল) হিসাব অনুযায়ী চট্টগ্রামে গ্যাসের চাহিদা ৪৮০ মিলিয়ন ঘনফুট। তবে স্বাভাবিক সময়ে এখানে গড়ে সরবরাহ পাওয়া যায় ২৫০ থেকে ২৮০ মিলিয়ন ঘনফুট। নিয়মিত সরবরাহ পাওয়া এই পরিমাণ গ্যাস তারা রেশনিং করে চট্টগ্রামের বিভিন্ন কারখানায় ১৬৩টি ক্যাপটিভ পাওয়ার প্ল্যান্ট, ৬২টি সিএনজি ফিলিং স্টেশন ও ৩ লাখ ৬৯ হাজার ৭০৩ আবাসিক গ্রাহককে সরবরাহ করে।
×