ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

ঘোড়া আর গাধার দৌড় ছিল মূল আকর্ষণ

প্রকাশিত: ০৭:২৮, ১৬ এপ্রিল ২০১৬

ঘোড়া আর গাধার দৌড় ছিল মূল আকর্ষণ

ঋতু বৈচিত্র্যে পরিপূর্ণ বরিশাল অঞ্চলে বৈশাখী মেলার ইতিহাস বেশ প্রাচীন। কৃষিভিত্তিক জীবনধারা এ মেলাকে আরও সমৃদ্ধ করেছে। বিশেষ করে ব্যাপক সংখ্যক নদী-নালা-সাগরের কারণে এ অঞ্চলে এক সময়ে যোগাযোগ ব্যবস্থায় ছিল চরম বন্ধ্যত্ব। মানুষ একত্র হওয়ার সুযোগ পেত কম। বৈশাখে মাঠঘাট শুকিয়ে একাকার হয়ে যেত। তখন মানুষ বিনোদনের জন্য ছুটে যেত বৈশাখী মেলায়। ফলে বৈশাখী মেলা জমজমাট মিলনকেন্দ্রে পরিণত হতো। পণ্য বেচাকেনার পাশাপাশি মানুষ মেলাভিত্তিক নানা বিনোদনে মেতে উঠত। বৃহত্তর বরিশাল অঞ্চলে কত জায়গায় বৈশাখী মেলা হতো, তার সঠিক কোন পরিসংখ্যান নেই। তবে কয়েকজন ঐতিহাসিক ব্রিটিশ আমলের শুরুতে অর্ধ শতাধিক মেলার কথা বিভিন্ন গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন। ব্রিটিশ কর্মকর্তা চেসএ বেন্টলি তার এক গ্রন্থে ৪০টি মেলার কথা উল্লেখ করেছেন। এর অধিকাংশ ছিল বৈশাখী মেলা। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যেতে পারে, এগুলো বৈশাখী মেলা হলেও বেশিরভাগ মেলা শুরু বা আয়োজন হতো চৈত্রসংক্রান্তির দিনে। যা চলত পহেলা বৈশাখ থেকে শুরু করে এক-দেড় সপ্তাহ ধরে। এগুলো অনেক জায়গায় চৈত্রসংক্রান্তির মেলা হিসেবে পরিচিত ছিল। এসব মেলার কোন কোনটির বয়স তখনই দু/তিনশ’ বছর ছাড়িয়ে গিয়েছিল। ফলে খুব সহজে ধারণা করা যায়, প্রাচীনত্বের দিক থেকে মেলাগুলো যথেষ্ট গুরুত্ববহ ছিল। যদিও কালের বিবর্তনে বহু মেলা বিলুপ্ত হয়ে গেছে। বিশেষ করে পৃষ্ঠপোষকতার অভাবেই অধিকাংশ মেলার বিলুপ্তি ঘটেছে। এছাড়া একাত্তরে পাকিস্তানী সেনাদের কারণেও কয়েকটি মেলা বন্ধ হয়ে গেছে। পরবর্তীতে আর সেগুলো চালু করার উদ্যোগ নেয়া হয়নি। প্রাচীনত্বের দিক থেকে বরিশালের হাটখোলা চৈত্রসংক্রান্তির মেলা অন্যতম। এটির বয়স তিন শ’ বছর। নবাবী আমলে শুরু এ মেলায় প্রতিদিন অন্তত পাঁচ হাজার মানুষের সমাগম হতো। মেলাটি চলত এক সপ্তাহ ধরে। বরিশালের জলাবাড়ির মেলার নাম ছিল ‘কাল বৈশাখী’ মেলা। এ মেলায় প্রতিদিন দেড় হাজার মানুষের মিলন হতো। জমজমাট বৈশাখী মেলা হতো ধামুরা ও ভা-ার গ্রামে। সাতদিন ধরে বৈশাখী মেলা হতো বগুড়া মৌজায়। এটি ‘গোপাল ঘোষ মেলা’ নামে পরিচিত ছিল। এ মেলায় প্রতিদিন দু’ হাজার মানুষের উপস্থিতি ছিল। ঝালকাঠি বৈশাখী মেলা একদিনের হলেও এর ঐতিহ্য ছিল ভিন্নমাত্রার। ব্রিটিশ আমলের এ মেলায় প্রতিদিন পাঁচ হাজারের বেশি মানুষের উপস্থিতি ছিল। মোরাকাটি গ্রামের দু’ দিনের চৈত্রসংক্রান্তি মেলাও যথেষ্ট ঐতিহ্যম-িত। উজিরপুরে বর্ষবরণের দিন থেকে তিনদিন ধরে অনুষ্ঠিত হতো ‘গলাইয়া-ওয়াজিপুর’ মেলা। মেলাটির ঐতিহ্য মুঘল আমলের। এ মেলায় প্রতিদিন পাঁচ শ’ মানুষ আসত। বরিশালের ব্যাসকাঠি ও বাটনতলার মেলা খুবই প্রাচীন। বর্তমান বরগুনা জেলার বেতাগী উপজেলার কবিরাজবাড়ির মেলা ও বুড়া মজুমদার কাছারি বাড়ির মেলা বৈশাখী মেলা হিসেবে যথেষ্ট খ্যাত ছিল। মেলা দু’টিতে অন্তত লাখ মানুষের মিলন হতো। বামনা উপজেলার ডৌয়াতলা বৈশাখী মেলার বয়সও এক শ’ বছর ছাড়িয়ে গেছে। ইতিহাস ঘেঁটে দেখা গেছে, এসব মেলায় ছিল নির্মল বিনোদনের ছড়াছড়ি। ঘোড়দৌড় ও গাধার দৌড় হতো প্রতিদিন। ব্রিটিশ আমলে ঘোড়া ও গাধার দৌড়ের বিজয়ীদের দেয়া হতো পিতলের কলস। মেলায় ঘোড়া ও গাধা আসত দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে। কোন্ মেলায় কতটি ঘোড়া ও গাধা এসেছে, কারা বিজয়ী হয়েছে, তা নিয়ে মাসের পর মাস হতো সরস গপ্পো। এলাকার অবস্থাপন্নরাও দৌড়ের জন্য ঘোড়া ও গাধা পুষতেন। আয়োজন হতো নৌকা বাইচের। হা-ডু-ডু এবং কুস্তি প্রতিযোগিতা ছিল মেলার নিয়মিত আয়োজন। রাতভর হতো যাত্রা-সার্কাস। কলকাতা থেকে আসত যাত্রার দল। বাচ্চাদের জন্য নানা আয়াজন থাকত মেলায়। প্রতিটি মেলায় সাংসারিক জিনিসপত্রের বেচাকেনা হতো সবচেয়ে বেশি। বরিশালের ঐতিহ্যবাহী এসব প্রাচীন বৈশাখী মেলার অধিকাংশই এখন বিলুপ্ত হয়ে গেছে। গত দু’/তিন দশকে নতুন রূপে এসেছে বৈশাখী মেলা। যার অধিকাংশের পৃষ্ঠপোষক স্থানীয় প্রশাসন, রাজনীতিক, সমাজকর্মীসহ স্থানীয়রা। জেলা-উপজেলায় অনুষ্ঠিত এসব মেলাতেও মানুষের ঢল নামছে। মেলায় আসছে নানা ধরনের কুটির শিল্পজাত সামগ্রী। বিশেষ করে মৃৎশিল্পীরা এসব মেলার কারণে প্রাণ ফিরে পেয়েছে। মেলার বড় আকর্ষণ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। বৈশাখী মেলা ঘিরে মানুষ ফিরে পায় প্রাণচাঞ্চল্য। Ñশংকর লাল দাশ গলাচিপা থেকে
×