ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

সিরাজুল এহসান

দুর্যোগের শব্দসাক্ষ্য

প্রকাশিত: ০৪:৪২, ১১ মার্চ ২০১৬

দুর্যোগের শব্দসাক্ষ্য

রাষ্ট্র যদি নিরাপত্তার বদলে নির্যাতক-পীড়কের ভূমিকা গ্রহণ করে সেটা দুর্যোগের পর্যায়ে পড়ে বললে অত্যুক্তি হবে না। নাগরিকের প্রতি বৈষম্য দেখালে রাষ্ট্রের ভূমিকা হয় প্রশ্নবিদ্ধ। রাষ্ট্রনায়কের সঙ্গে রাজনীতিও পাঁকে পড়ে। এমন বাস্তবতা আমরা পেরিয়ে এসেছি ক্ষত শরীর নিয়ে। স্বাধীনতা প্রাপ্তির প্রথম দশকের মধ্যভাগে এমন দুঃসহ সময়ের মুখোমুখি হয়েছিলাম আমরা। বিশেষত ’৭৫-এ জাতির মহানায়ক বঙ্গবন্ধুর সপরিবারে বিয়োগান্ত পরিণতির পর পরই। ইতিহাসের এ জাজ্বল্যমাণ সত্যের পরশ পাবেন পাঠক মো. আনোয়ার হোসেনের গল্পগ্রন্থ ‘চক্রবর্তীর ঘরে ফেরা’য়। ‘চক্রবর্তীর ঘরে ফেরা’ গল্পটি গ্রন্থের নামগল্প। এই একটি গল্পেই চিহ্নিত করা যায় ওই দুর্বৃত্ত সময়ের রাষ্ট্রের খলচরিত্রদের। শুধু ধর্মীয় পরিচয়ে স্বগোত্রীয় না হওয়া ও সংখ্যায় কম বলেই কি সে সময়ের রাষ্ট্রযন্ত্র পিষ্ট করেছিল তাদের? উত্তমপুরুষে লেখা এ গল্পটিতে লেখক জানাচ্ছেন সময়ের কথা এভাবে- ‘এই সেফ হাউসটি নতুন। যেসব বন্দীকে দিয়ে এটি উদ্বোধন করা হয়েছিল, তাদের মধ্যে আমিও ছিলাম। আমাকে যখন ধরে নিয়ে এসেছিল, তখন যেখানে ছিলাম, তা ছিল টিনের ছাউনির বারান্দা ঘেরা একতলা পুরনো বাড়ি। তারিখটি মনে আছে। ’৭৬-এর ১৫ মার্চ।’... এ সময়ে কারা কীভাবে ক্ষমতায় এসেছিল ও আঁকড়ে ধরে ছিল তা সবাই জানেন। ইতিহাস সাক্ষ্য দিচ্ছে এবং অদূর ভবিষ্যতে তারা আঁস্তাকুড়ে নিক্ষিপ্ত হবে তা ক্রমশ স্পষ্ট হচ্ছে। ‘চক্রবর্তীর ঘরে ফেরা’ গল্পের অন্যতম মুখ্য চরিত্র অরুণ। ওই সময় রাষ্ট্র ও সরকারের দৃষ্টিতে সাহা, কু-ু, আচার্য, বন্দ্যোপাধ্যায়, চট্টোপাধ্যায়, রায় নামের শেষে এমন সব পদবিধারী মানেই ভারতের চর। এই সম্প্রদায়ের ওপর যে বিভীষিকাময় নির্যাতন নেমে এসেছিল তা ইতিহাসের কলঙ্কজনক অধ্যায়। ’৭১-এর পরাজিত শক্তি, অগণতান্ত্রিক পন্থায় ক্ষমতারোহনকারী একাট্টা হয়ে এই সম্প্রদায়ের নারী ধর্ষণ, স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ লুণ্ঠন-দখলে মত্ত হয়; জীবন হয় বিপন্ন। শেষে অনেকে দেশ ছাড়তেও বাধ্য হয়। গল্পটিতে রাষ্ট্রযন্ত্রের নিপীড়ন দৃশ্য আমরা পাই এভাবেÑ ...“অরুণ চক্রবর্তী। পুরনো এলিফ্যান্ট রোডে এক ফার্মেসিতে কাজ করত। রামপুরা ব্রিজের ওপারের বস্তিতে ভাড়া ঘরে থাকত। গত সন্ধ্যায় ফার্মেসি থেকে উঠিয়ে নিয়ে এসেছে। সারা রাত ঘরে বেদম পিটিয়েছে। ‘আমি বোধ হয় আর বাঁচুম না স্যার।’ ‘কি জানতে চায় তোমার কাছে?’ এবারে সে দ্বিধান্বিত। কতক্ষণ কথা বলে না। সময় নিয়ে আবারও শুধাই। কী ভেবে এবারে উত্তর দেয়। ‘আমি নাকি স্যার ইন্ডিয়ার চর। কার কার সাথে আমার যোগাযোগ আছে তা জানতে চায়।”... ইন্টারগেশন সেলে জিজ্ঞাসাবাদের নামে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের মানুষ, কথিত সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতনের যে কৌশল প্রয়োগ করেছিল রাষ্ট্রের একটি সংস্থা তা নাৎসিদেরকেও হার মানায়। ফার্স্ট ডিগ্রী, সেকেন্ড ডিগ্রী, থার্ড ডিগ্রী শেষে ফোর্থ ডিগ্রী। থার্ড ডিগ্রীতে যে কোন মানুষ মুমূর্ষু হয়ে যায়। ফোর্থ ডিগ্রী পর্যন্ত অনেকে যেতেও পারেন না। পৃথিবী থেকে বিদায় নিতে হয়। ফোর্থ ডিগ্রীর নির্যাতন সয়েও অরুণ চক্রবর্তী বিশেষ সংস্থার কৌশলের ফাঁদে পা দেননি; করেননি স্বীকার। তারপর? তারপর অরুণ চক্রবর্তী ঘরে ফিরতে পেরেছিল কিনা জানতে হলে পাঠ করতে হবে ‘চক্রবর্তীর ঘরে ফেরা।’ মো. আনোয়ার হোসেনের এ গল্প গ্রন্থের আরেকটি গল্প মন ছুঁয়ে যায়। অন্তত সমাজ ও দেশের প্রতি দায়বদ্ধ পাঠকের কাছে এর মূল্যায়ন অন্যরকম। গল্পটির নাম ‘রুপালি মল।’ দুই দেহজীবী নারী চম্পা ও কলি শাহবাগ এলাকায় রমনা পার্ক ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের আশপাশে শরীর বিক্রি করলেও মনে দাগ কাটে গণজাগরণ মঞ্চের সেøাগান। তারাও দূর থেকে বলে ওঠে অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে ‘জয় বাংলা!’ একদিন ‘পাক পবিত্র’ হয়ে গণজাগরণ মঞ্চের কাছে যায়। সেøাগান-কন্যাদের সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়ে বলে, ‘রাজাকারের ফাঁসি চাই।’ ঘটনা এখানেই শেষ নয়। রমনার লেকে যে লাশটি ভেসে উঠেছিল সেটির আত্মা খাঁচা ছাড়া করার নেপথ্যে কারা ছিল? লাশটিইবা কার? লাশটি দেখে কলি ও চম্পা কেন নির্বিকার বা মুখে বিজয়ের হাসি? এ রহস্য জানতে দ্বারস্থ হতে হবে গ্রন্থটির। ‘চক্রবর্তীর ঘরে ফেরা’ গ্রন্থে রয়েছে মোট ১১টি গল্প। প্রায় প্রতিটি গল্পে রয়েছে সমাজের নিম্নবর্গীয় ও প্রান্তিক মানুষের কথা। যা গল্পকারের একটি দর্শনের প্রতি অনুগত হওয়ার বহিঃপ্রকাশ। গ্রন্থটির প্রচ্ছদ এঁকেছেন চারু পিন্টু। মো. আনোয়ার হোসেনের লেখক সত্তার সঙ্গে পাঠক পরিচিত। নতুন করে গল্পকার হিসেবে তার পরিচয় পাবেন এ গ্রন্থটির মাধ্যমে। গল্পগ্রন্থটি সুধী ও পাঠক মহলে দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হবে বলে বিশ্বাস করি।
×