ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

বরিশালে যক্ষ্মা নিরাময়ে নীরব বিপ্লব

প্রকাশিত: ০৩:২৮, ৫ মার্চ ২০১৬

বরিশালে যক্ষ্মা নিরাময়ে নীরব বিপ্লব

খোকন আহম্মেদ হীরা, বরিশাল ॥ চরাঞ্চল ও অনগ্রসর বরিশালের দশটি উপজেলার দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মধ্যে স্বাস্থ্য সেবার মান ক্রমেই পাল্টে যেতে শুরু করেছে। ফলশ্রুতিতে অন্যান্য চিকিৎসার পাশপাশি বরিশালে যক্ষ্মা রোগ নিরাময়ে নীরব বিপ্লব ঘটেছে। এ রোগ নিরাময়ে জাতীয়ভাবে শতকরা ৮৫% লক্ষ্যমাত্রা থাকলেও বরিশালে ২০১৫ সালে চিকিৎসায় সাফল্যের হার ৯৪% দাঁড়িয়েছে। বেসরকারী এনজিও ব্র্যাকের যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচীর জেলা ব্যবস্থাপক মোঃ মানজিয়ারুল ইসলাম মন্জু জানান, জাতীয় যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচীর (এনটিপি) রিপোর্ট অনুযায়ী বরিশাল নগরীসহ জেলার ১০ উপজেলায় ২০১৫ সালে ৩৫ হাজার ৬৩৬ জনের কফ পরীক্ষা করে ৩ হাজার ৮ যক্ষ্মা রোগী চিহ্নিত করা হয়েছে। এরমধ্যে কফে জীবাণুযুক্ত রোগী পাওয়া গেছে ১ হাজার ৮৭, পুনঃআক্রান্ত রোগী ৮৬, নেগেটিভ রোগী ৫১৮, ফুসফুসের বাইরের রোগী ৪৪২, অন্যান্য রোগী ২৬জন। এদের সরাসরি পর্যবেক্ষণে রেখে ওষুধ সেবনের (ডট্স) মাধ্যমে বিনামূল্যে চিকিৎসা সেবা দিয়ে সম্পূর্ণ সুস্থ করা হয়েছে। তিনি আরও জানান, ২০১৪ সালে ২ হাজার ৯৭৩ চিহ্নিত রোগীকে সরকারীভাবে চিকিৎসা দেয়ার পর সম্পূর্ণ ভাল হয়েছেন ২ হাজার ৭৭৩জন, চিকিৎসা চলাকালীন বার্ধক্য, ক্যান্সার ও দুর্ঘটনা জনিত কারণে মারা গেছেন ১১২জন, ফেইলুর হয়েছে চারজন, চিকিৎসা চলাকালীন অন্যত্র চলে গেছেন ৪৫জন, স্থানান্তরিত হয়ে অন্যস্থান থেকে ওষুধ খেয়েছেন ১৪জন ও নির্ধারিত সময়ে চিকিৎসা সম্পূর্ণ করতে পারেননি ২৫ রোগী। ব্র্যাকের যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচীর জেলা ব্যবস্থাপক আরও জানান, বাতাসের মাধ্যমে যক্ষ্মা রোগের জীবাণু ছড়ায়। যক্ষ্মায় আক্রান্ত ব্যক্তির হাঁচি বা কাশির মাধ্যমে রোগের জীবাণু বাতাসে মিশে রোগের সংক্রমণ ঘটায়। যক্ষ্মায় আক্রান্ত হলে তিন সপ্তাহ বা এর অধিক সময় ধরে কাশি, কাশির সাথে রক্ত যাওয়া, বুকে ব্যথা অথবা শ্বাস নেয়ার সময় ও কাশির সময় ব্যথা হয়। অস্বাভাবিকভাবে ওজন হ্রাস, অবসাদ অনুভব করা, জ্বর, রাতে ঘাম হওয়া, কাঁপুনি ও ক্ষুধামন্দা দেখা দেয়। তবে যক্ষ্মা হলে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। রোগীকে পরিবার-পরিজন থেকে আলাদা করারও দরকার নেই। বিশেষ কোন খাবারের দরকার নেই। নিয়মিত, পরিমিত এবং পূর্ণমাত্রায় ও পূর্ণমেয়াদে ওষুধ সেবন করলেই যক্ষ্মা সম্পূর্ণ ভাল হয়ে যায়। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ভৌগোলিক কারণে নদী বেষ্টিত এ জেলায় চরাঞ্চলে অসংখ্য মানুষের বসবাস। তাই চরাঞ্চলের অনগ্রসর এলাকাগুলোতে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মধ্যে যক্ষ্মা আক্রান্তের সংখ্যা বেশি। এদের অধিকাংশই কোন না কোন তামাক জাতীয় নেশার সঙ্গে জড়িত। তাই ব্র্যাকের উদ্যোগে ঘরে ঘরে এ রোগী শনাক্তের প্রক্রিয়া শুরু করে চিকিৎসা করানো হয়। যে কারণে যক্ষ্মা রোগ নিরাময়ে মাত্র কয়েক বছরের ব্যবধানে বরিশাল জেলায় এখন নীরব বিপ্লব ঘটেছে। সর্বত্রই কেটে গেছে যক্ষ্মা আতঙ্ক। ‘যক্ষ্মা হলে রক্ষা নেই’ এই প্রবাদ এখন ঠাঁই নিয়েছে জাদুঘরে। এখন প্রবাদ চলছে ‘বিনামূল্যে যক্ষ্মা চিকিৎসা ঘরে ঘরে, সুস্থ হচ্ছে জনে জনে।’ সরেজমিন ঘুরে এবং অনুসন্ধানে দেখা গেছে, চরাঞ্চল ও অনগ্রসর এলাকাগুলোতে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মধ্যে যক্ষ্মা আক্রান্তের সংখ্যা বেশি। আক্রান্তদের অধিকাংশই ধূমপায়ী। চারদিকে নদী ঘেরা জেলার একমাত্র দ্বীপ উপজেলা মেহেন্দীগঞ্জ উপজেলা ব্র্যাকের যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচীর উপজেলা ব্যবস্থাপক সুশান্ত রায় জানান, তার অধীনস্থ চাঁনপুর, পানবাড়িয়া, নয়নপুর, কৈলসুরী, চরখাগকাটা, চাষীপুর এলাকার দারিদ্র্য প্রপীড়িত চরাঞ্চলের বাসিন্দারা গত কয়েক বছর পূর্বেও যক্ষ্মারোগে আক্রান্ত হয়েছেন বেশি। বর্তমানে ব্র্যাকের ডট্স প্রোগ্রামের মাধ্যমে এর সংখ্যা অনেকাংশে কমিয়ে আনা হয়েছে। ওইসব এলাকায় বর্তমানে যক্ষ্মা রোগে আক্রান্তদের ওষুধ খাওয়াচ্ছেন ব্র্যাকের সেবিকা সাহিদা বেগম। চরখাগকাটা গ্রামের মৃত বাবুল রাঢ়ীর স্ত্রী সাহিদা বেগম জানান, তিনি গত ১৫বছর ধরে এ পেশায় নিয়োজিত রয়েছেন। এরমধ্যে যক্ষ্মায় আক্রান্ত হয়ে তার হাতে নিয়মিত ছয় মাস ওষুধ খেয়ে পুরোপুরি সুস্থ হয়েছেন মালেক হাওলাদার, হোসনেয়ারা বেগম, বারেক হাওলাদার, দেলোয়ার হোসেন, আবুল হোসেনসহ প্রায় শতাধিক নারী-পুরুষ। বর্তমানে যক্ষ্মা রোগের জীবাণু পাওয়ার পর তার হাতে ওষুধ খাচ্ছেন আরিফুর রহমান, ফারুক হোসেন, শিল্পী বেগম, অজুফা বেগম, আবু বক্কর, নুর মোহাম্মদসহ সাতজন। ব্র্যাকের সেবিকা সাহিদা বেগম আরও বলেন, কোর্স সফলভাবে সম্পন্ন করায় ব্র্যাক থেকে তাকে ৫শ’ টাকা করে দেয়া হচ্ছে। অর্ধশিক্ষিত গৃহবধূ সাহিদা ব্র্যাকের সেবিকা প্রশিক্ষণ নিয়ে এখন যক্ষ্মা রোগের চিকিৎসা এবং চিহ্নিতকরণের জন্য স্থানীয় হাসপাতালে রোগীদের নিয়ে যাওয়ার কাজ করছেন। এ কাজ করেই স্বামীহারা সাহিদা ২পুত্র ও ২কন্যাসন্তান নিয়ে তার অভাবী সংসারের হাল ধরেছেন। এই সেবিকা বলেন, ভাই এখন জীবনটা বেশ উপভোগ করতাছি। মানুষের উপকার কইরা ভাল লাগতাছে। কয় টাকা পাইলাম হেইডা বড় কথা না, অসহায় মানুষদের শান্তি দিতে পারছি, রোগমুক্তির জন্য সহযোগিতা করতে পারছি, এইটাই মোর জীবনে বড় পাওয়া। বরিশাল শের-ই বাংলা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বক্ষব্যাধি বিশেষজ্ঞ ডাঃ মোঃ ছিদ্দিকুর রহমান জানান, বাংলাদেশে এখনও লাখে ২২৫ যক্ষ্মা রোগী রয়েছে। এদের অনেকেই এখনও অসচেতন। ভীতি আর অজ্ঞতায় তারা চিকিৎসা সেবা থেকে অনেকেই বঞ্চিত হচ্ছেন। একটু সচেতনতাই দিতে পারে যক্ষ্মা থেকে মুক্তি। যদি সঠিক সময়ে রোগ চিহ্নিত করে চিকিৎসা নেয়া যায় তাহলে যক্ষ্মা একেবারেই সেরে যায়। আর এ কারণেই যক্ষ্মা চিহ্নিতকরণে নানামুখী উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। জেলা সিভিল সার্জন ডাঃ মোঃ শফিউদ্দিন জানান, যক্ষ্মার চিকিৎসা এখন অতি সজলভ্য। কিন্তু কোন যক্ষ্মা রোগী ওষুধের পুরো কোর্স সম্পন্ন না করলে মহাবিপদ। যক্ষ্মা একটি মারাত্মক সংক্রামক রোগ, যা প্রাথমিকভাবে ফুসফুসকে আক্রান্ত করে। তাই রোগী শনাক্তের মাধ্যমে ব্র্যাকের কর্মীরা ডট্স-এর আওতায় ঘরে ঘরে গিয়ে ওষুধ সেবন করানোর ফলেই বরিশালে আজ শতভাগ সফলতা এসেছে।
×