ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

মারুফ রায়হান

ঢাকার দিনরাত

প্রকাশিত: ০৩:৩১, ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৬

ঢাকার দিনরাত

ঢাকা শহরে দুইযুগ আগের এই ফেব্রুয়ারি মাসে একটি নতুন সংবাদপত্রের জন্মপ্রস্তুতির কথা কল্পনা করে নিতে পারি। এই ২৪ বছরে ঢাকায় কত শত পত্রিকাই না প্রকাশিত হলো, জন্ম হলো ডজন ডজন সংবাদপত্রের। তার ভেতর জনকণ্ঠের কথা আলাদাভাবে উচ্চারণের প্রয়োজন রয়েছে। এসব কথা উঠছে এই কারণে যে, ২৪তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর চূড়ান্ত পর্যায়ের কাজ চলছে এখন জনকণ্ঠ ভবনে। এই কাজের সঙ্গে যুক্ত আমরা যারা, তাদের ব্যস্ততা এমন বেড়েছে যে পরপর দুদিন- পহেলা ফাল্গুন আর ভালবাসা দিবসে ভবনের বাইরে চোখ মেলে দেখার সামান্য সুযোগই মিলছে না। সে কথায় পরে আসছি। বলছিলাম ২৪ বছর আগের কথা। জনতার কণ্ঠ হয়ে ওঠার সৎসাহস ও অঙ্গীকার নিয়ে জনকণ্ঠ পত্রিকাটি আত্মপ্রকাশ করেছিল ভাষার মাস ফেব্রুয়ারিতে। পৃষ্ঠা বিন্যাসে ও বিষয়বৈচিত্র্যে পত্রিকাটি নতুনত্বের পতাকা উর্ধে তুলে ধরেছিল। পরে যে কয়টি দৈনিক জন্ম নিলো, তাদের সামনে পথপ্রদর্শকের ভূমিকায় ছিল এই জনকণ্ঠ। দেশের প্রধান প্রধান জেলাশহর থেকে একযোগে ছাপা হতো জনকণ্ঠ। তাই ঢাকার পাঠকের সঙ্গে রাজশাহী বা খুলনার পাঠকের প্রাপ্তিযোগের সময়দূরত্ব ঘুচে গিয়েছিল। ঢাকার পাঠকের মতোই ভোরবেলা মফস্বলের পাঠকের হাতে পৌঁছে যেত জনকণ্ঠ। তখন ভালবাসা দিবস পালিত হতো না বটে। তাতে কি, ভালবাসার কবিতার তো কমতি ছিল না। মনে পড়ে এমন একটা পঙক্তি রচনা করেছিলাম শুধু জনকণ্ঠের কথা ভেবেই- ‘পাঁচটি শহরে একযোগে ছাপা হচ্ছে আমার কবিতা, প্রেমপত্র/তার একটির নির্জনতায় রয়েছো তুমি প্রতীক্ষাকাতর’। জানি না সেদিন জনকণ্ঠের কবিতা-পাঠকেরা কিভাবে নিয়েছিলেন এ কবিতা। সে যাক। ধীরে ধীরে জনকণ্ঠ হয়ে উঠল মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষ শক্তির প্রধান কণ্ঠস্বর, হলো মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী সংগ্রামে অগ্রণী জনতার মুখপত্র। সামনের সপ্তাহে প্রকাশিতব্য প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী সংখ্যায় তার কিছুটা ধরার চেষ্টা থাকছে। এই সংখ্যাটির জন্য দিনের কাজ শেষ করে আমরা শনিবার বেরিয়ে পড়ি রাজপথে, তখন বসন্তের প্রথম সন্ধ্যাটি আমাদের স্বাগত জানাল। পথে পথে মানুষের আনন্দময়তার জয়গান। কয়েক বছর আগেও কিন্তু আমরা ঢাকার রাজপথে এমন নিঃশঙ্ক চিত্তে তরুণ বয়সী নরনারীদের যুগল বা দলবদ্ধ হয়ে আনন্দে অবগাহিত হতে দেখিনি। আমরা রাস্তায় হাঁটছিলাম। মানুষ বসন্তকে স্বাগত জানাচ্ছে বাসন্তী পোশাকে। বসন্তের রঙ যেমন রয়েছে তাদের পোশাকে, নিশ্চয়ই মনেও লেগেছে বসন্তের রঙ। সব মিলিয়ে পহেলা ফাল্গুনে ঢাকা সত্যিই দর্শনীয় হয়ে ওঠে। গত বছরের ফাল্গুনের (বা ফেব্রুয়ারির) দিনগুলোর কথা স্মরণ করা যাক। তখন সপ্তাহের প্রতিটি কর্মদিবসেই ছিল হরতাল। শুক্র-শনিবার দুই ছুটির দিনে চালু ছিল অবরোধ। এ দুদিন ঢাকার সড়কে কোন না কোন বাসে পেট্রোলবোমা ছোড়া নিয়ম করে নিয়েছিল নাশকতাকারীরা। তবু ঢাকার মানুষ এসব যেন কেয়ারই করেনি। গত বছর শুক্র-শনিবারেই পড়েছিল দুটি অসাধারণ দিবস- পহেলা ফাল্গুন ও ভালবাসা দিবস। ঢাকার সকল পথ এসে যেন মিলেছিল শাহবাগে, টিএসসিতে, বইমেলায়। মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত সমাবেশ সর্বকালেই সুন্দর ও প্রাণবান। কিন্তু একটি স্পেসেরও তো ধারণক্ষমতা রয়েছে! পেয়ালা উপচে ওঠা জল ছলকে গিয়ে ছড়িয়ে পড়তে পারে, তাতে বিশেষ ক্ষতিবৃদ্ধি ঘটে না। কিন্তু মানুষের বেলায় ভিন্ন হিসাব। শাহবাগ থেকে টিএসসি পর্যন্ত এই সামান্য পথটুকু পেরুতে যাদের ঘণ্টা পার হয়ে গেছে তারাই জানেন ভিড় কত প্রকার হতে পারে। বিশেষ করে পহেলা ফাল্গুনে সবার গন্তব্য হয়ে ওঠে বইমেলা। মানুষপ্রতি একখানা করে বই বিক্রি হলে একদিনেই ‘ফতুর’ হয়ে যেত সব বইয়ের দোকান। আহা যদি শতকরা একজনও বই কিনতেন! ৩০০ জনের মধ্যে ২৯৯ জনই বইমেলায় সেদিন গেছেন স্রেফ ঘুরতে, এটা সাদা চোখের হিসেবেই নিশ্চিতভাবে বলতে পারব। একজন ক্রেতার সাপেক্ষে ৫০ জন দর্শক থাকলেও না হয় মেনে নেয়া সম্ভব। ভিড়ের কারণে আমার মতো হাজার হাজার মানুষ গত বছর পহেলা ফাল্গুনে বইমেলায় প্রবেশ করতে পারেননি বিকেলে বা সন্ধ্যায়। এবারও কি তার ব্যতিক্রম ঘটল? বসন্তে রঙিন ভালবাসা দিবস ভ্যালেন্টাইন ডের পুরো নামটা আসলে সেন্ট ভ্যালেন্টাইন্স্ ডে- ভ্যালেন্টাইন নামক তৃতীয় শতাব্দীর দুজন সন্তের নামানুসারে। ভ্যালেন্টাইন ডে-কে ভালবাসা দিবস হিসেবে পালন করার প্রচলন অবশ্য তারও অনেক আগে থেকে। কথিত আছে যে, রোমান সাম্রাজ্যের লুপারচেলিয়া অঞ্চলে ১৫ ফেব্রুয়ারিতে একটি বিশেষ ভোজানুষ্ঠানের আয়োজন হতো যেখানে যুবক-যুবতীরা পরস্পরের জীবনসাথী বাছাই করত। কালে কালে সেটা ১৪ ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিত আরেকটা ভোজোৎসবের সঙ্গে মিশে যায়, যার উপলক্ষ্য ছিল দুজন শহীদ যোদ্ধাকে স্মরণ করা। দুজনকে একই নামে নামকরণ করা হয়েছিল- সেন্ট ভ্যালেন্টাইন। প্রেমিক-প্রেমিকাদের হৃদয়ে এই সন্তদ্বয়ের একটা বিশেষ স্থান ছিল। দুজনকেই ভাবা হতো প্রেমের প্রতীক। ১৪ ফেব্রুয়ারিকে বাছাই করার কারণ, প্রাচীন কিংবদন্তি অনুযায়ী এই দিনেই নাকি পাখিরা তাদের সখা-সখী নির্বাচন করে। আমাদেরও আছে প্রেমের কাহিনী। প্রাচীন ভারতবর্ষে রয়েছে রাধাকৃষ্ণের গল্প। মধ্যযুগীয় পারস্য থেকে আমরা পেয়েছি শিরী-ফরহাদ আর লায়লামজনুর করুণ কাহিনী। প্রেম দিয়েই তো আমাদের পুঁথিপত্র পরিপূর্ণ। রাধাকৃষ্ণের চিত্তাকর্ষক প্রেমের গল্প থেকেই কি উৎসারিত হয়েছে উপমহাদেশের প্রেমসমৃদ্ধ কাব্যশিল্পগাথার ঐতিহ্য? তাঁরা বাস্তব ছিলেন কি ছিলেন না তা হতে পারে ইতিহাসের পণ্ডিতদের বিতর্কের বিষয়, কিন্তু তাঁদের প্রেম যে একটা অনুপম মূর্তি নির্মাণ করে গেছে যুগযুগান্তের প্রেমপূজারীদের জন্যে তাতে তো কাল্পনিক কিছু নেই। ভালবাসা দিবসের ঢাকার কথা কি লিখে শেষ করা যাবে? ভালবাসা দিবসকে এখন বাংলাদেশের তরুণ সমাজ বেশ ভালভাবেই উপভোগ করে। নানা ব্যক্তিগত আয়োজনে তারা দিনটিকে স্মৃতিময় করে রাখার চেষ্টা করে। একইসঙ্গে ইলেক্ট্রনিক এবং প্রিন্ট মিডিয়া ভালবাসা দিবসকে কেন্দ্রে রেখে বহু বর্ণিল একটি বৃত্ত রচনা করে, যার সময়সীমা ১৪ ফেব্রুয়ারির ২৪ ঘণ্টাকে ছাপিয়ে বহুদূর পর্যন্ত বিস্তৃত হয়। বলা অসঙ্গত হবে না যে, বিগত এক-দেড় দশকে আমাদের ভালবাসা দিবস উদ্যাপনের বহুমাত্রিকতা তার পরিসর ও ওজন বিবেচনায় পৃথিবীর যে কোন দেশকে ছুঁয়ে ফেলতে পারঙ্গম। আমাদের প্রেমিকরা বিশ্বের কোন দেশের প্রেমিকের তুলনায় সামান্যতমও পিছিয়ে নেই। আর কে না জানে যে, প্রেমের কোন বয়স নেই। আমি সত্তরোর্ধ এমন ব্যক্তিকেও চিনি (নাম বা পেশা বলার কী দরকার!) যিনি এখনও প্রেমকাতর একজন বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া তরুণের প্রতিযোগী হতে সক্ষম, প্রেমপ্রকাশ ও প্রেম উপাদান গ্রহণ উভয় ক্ষেত্রে। সত্যি বলতে কি, জীবনের এক শ’ একটা যন্ত্রণার ভেতর সেঁধিয়ে থাকা মানুষের দেহমনে একটুখানি হলেও ভালবাসার সুবাতাস এসে আছড়ে পড়ে এই দিন, হোক তা কয়েকটি মুহূর্তের জন্য। বড়ই বস্তুবাদী আর কাঠঠোকরার ঠোঁটের মতোই কঠিন ও জটিল স্যুটেড-ব্যুটেড ব্যক্তিও ভালবাসার মদিরায় মনটাকে ভিজিয়ে ফেলার জন্য উদগ্রীব হয়ে থাকেন। গৌরচন্দ্রিকা বাদ দিয়ে আসল কথায় আসি। এই বঙ্গে ফাগুন আর ভালবাসা দিবস আসে হাত ধরাধরি করে। ভালবাসা দিবসের বারতাই যেন এখন বাংলার ফাল্গুন আকাশে-বাতাসে, মাটিতে ও কংক্রিটে ছড়িয়ে দেয়। বাংলাদেশের বাংলা পঞ্জিকায় পহেলা ফাল্গুন হলো তেরোই ফেব্রুয়ারি আর ভ্যালেন্টাইন ডে ঠিক তার পরেরদিন। অমর একুশে গ্রন্থমেলায় এসে আছড়ে পড়ে ফাল্গুন আর ভালবাসা দিবসের ঢেউ। ভালবাসা দিবসের রূপ-রস-গন্ধ-উত্তাপ রাজধানীর যে অঞ্চলে সবচেয়ে বেশি দৃশ্যমান হয় তা হলো এ বইমেলা। বইমেলা যদি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন প্রাঙ্গণ বাংলা একাডেমিতে না হতো তাহলে পহেলা ফাল্গুন আর ভালবাসা দিবসে আমরা ভালবাসার ওই সর্বব্যাপী রূপছটা থেকে অনেকখানি বঞ্চিত হতাম কিনা, সেটা বড় জিজ্ঞাসা। বইমেলা সত্যিই এক মুক্তাঞ্চল, তা যতই পুলিশ-মেটাল ডিটেক্টর-সিসিটিভি ক্যামেরার শ্যেনদৃষ্টি থাকুক না কেন। দলে দলে তরুণ-তরুণী বইমেলায় এসে উদ্যাপন করেন ভালবাসা দিবস। মোল্লারা আর রক্ষণশীলরা চোখ কপালে তুলে রাখলেও তাতে কোন প্রতিবন্ধকতা পড়ে না। একসময় প্রায় নিয়মিতভাবেই ভালবাসা দিবসেও হরতাল ডাকা হয়েছে। তাতে কী। ভালবাসার মানুষদের কেউ দমাতে পারেনি। বইমেলায় তার অপরূপ রূপ প্রত্যক্ষ করা যায়। বইমেলার প্রসঙ্গ এসে পড়ায় মনটা কিছুটা খারাপও হয়ে গেল। গত বছর বইমেলায় নরঘাতকদের চাপাতির আঘাতে মুক্তমনা তরুণ বুদ্ধিজীবী অভিজিৎ রায় নিহত হন। তাঁর বই প্রকাশের দায়ে দুজন তরুণ প্রকাশকের ওপরও মৌলবাদীরা আক্রমণ চালায়। দীপনকে হারায় বাংলাদেশ। গুরুতর আহত হয়েও প্রাণে বেঁচে যায় প্রকাশক ও কবি আহমেদুর রশীদ টুটুল। বইমেলা এখন মাঝপথে। টুটুল বইমেলাকে মিস করছেন কতটা তা বলার অপেক্ষা রাখে না। ফেসবুকে তিনি যা লিখেছেন, তাতে আমাদের একটি চোখ ভিজে আসে। আরেক চোখে ঝরে পড়ে আগুন। তিনি লিখেছেন, ‘সকালের ঝলমলে রোদ জ্যোৎস্নায় আমি আমার হাতের তালুর দিকে তাকিয়েছিলাম। চোখ গেল আঙুলগুলোর দিকে, তালুর উল্টোপিঠের দিকে। অনেক বছর ধরে এই সিজনে আমি হাত দিয়ে ভাত খেতে পারিনি। হাতে এক ধরনের এলার্জির আক্রমণ হতো এই নবেম্বর-ডিসেম্বর থেকে মার্চ-এপ্রিল পর্যন্ত সময়ে। ডাক্তার পরীক্ষা করে বলেছিলেন নতুন কাগজে থাকা কোন এক ধরনের রাসায়নিক উপাদানের কারণে এমনটি হয়। কিন্তু এই সিজনে নতুন কাগজ স্পর্শ করা ছাড়া আমার উপায় ছিল না। একে আমি আমার জীবনের অংশ হিসাবেই মেনে নিয়েছিলাম। সঙ্গে সঙ্গে চামচ-কাটাচামচ দিয়ে ভাত খাওয়ার একটা আলাদা ভাবও অনুভব করতাম। এবার তালু ও আঙুলের এলার্জি, মিস করছি, ভীষণ মিস।’ ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ [email protected]
×