ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ০৯ মে ২০২৪, ২৫ বৈশাখ ১৪৩১

ভেনিস ॥ কুইন অব এ্যাড্রিয়াটিক

প্রকাশিত: ০৪:২৭, ২২ জানুয়ারি ২০১৬

ভেনিস ॥ কুইন অব এ্যাড্রিয়াটিক

সুরাইয়া ফারজানা পিৎজা আর কাপ্পুচিনো; মিলানে বিরতি জুরিখ হতে মিলানগামী ট্রেনটা এ মুহূর্তে ধূসর পর্বতমালার ভেতর দিয়ে চলছে। সম্পূর্ণ ভিন্ন একটা প্রাকৃতিক পরিবেশ চারপাশে। এখানে দর্শনীয় জিনিস কেবল একটাই- তা হলো গ্রেইপ ভাইন। ঢালু পাহাড়ী জমিনে আঙ্গুর খেতের জমাট বুনন। মাঝেমধ্যে কিছু অতিপুরাতন বাড়িঘর, চার্চ ইত্যাদি চোখে পড়ছে। সবকিছুতেই যেন কিছুটা দারিদ্র্যের ছোঁয়া। হলদেটে পুরনো জরাজীর্ণ দালানকোঠা। উঠানে খড়-বিচালির ছড়াছড়ি। ভাবছিলাম- এমন তো হওয়ার কথা নয়। উত্তর ইতালির এ অঞ্চলই তো অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির সুযোগে এ যাবত দক্ষিণ ইতালির ওপর আধিপত্য চালিয়েছে। এবার বেশকিছু সুদৃশ্য, অভিজাত ভিলা চোখে পড়ছে। ঝকঝকে নীল আকাশের নিচে নিরিবিলি ভিলাগুলোর সামনে পাতা শৌখিন চেয়ার, ছাউনিতে ঢুলুঢুলু অবকাশযাপনের হাতছানি। রাজধানী মিলান সন্নিকটে হতেই কম্পার্টমেন্টে একজন নারী টিকেট চেকারের আগমন ঘটল। বেতস লতার মতো ছিপছিপে শরীর। আঙ্গুর লতার মতো ঢেউ খেলানো নীলচে কালো চুল কোমর ছাড়িয়ে গেছে। কাছে এসে দাঁড়াতে মোহভঙ্গ হলো। কিছুটা রুক্ষ চেহারায় বলিরেখাগুলো অত্যন্ত সুস্পষ্ট। চেহারার রুক্ষতা ঢাকতে খুব গাঢ় করে কাজল টানা হয়েছে দু’চোখে। পলাশ খাম খুলে টিকেটখানা বের করল। আমরা এই মুহূর্তে উত্তর ইতালির আল্পসীয় ট্রেইল ধরে এগোচ্ছি। ইতালি ইউরোপের ইতিহাস ঐতিহ্য ও শিল্প সংস্কৃতির এক অনন্য তীর্থভূমি। ইতালি শব্দটি লাটিন ইতালিয়া থেকে এসেছে। প্রাচীনকালে এখানে একটি ছোট্ট জনপদ গড়ে ওঠে, যাকে সুসভ্য গ্রীকরা ইতালিয়া বলে ডাকত। গ্রীক দার্শনিক এ্যারিস্টটলের বয়ানে ইতালিয়া কথাটি বেশ কয়েকবার পাওয়া যায়। ইতালিয়া কথাটির গ্রীক অর্থ- গো চারণভূমি। একদা এ অঞ্চলে কৃষিভিত্তিক জনগোষ্ঠী বসবাস করত। পরবর্তীতে খ্রিস্টপূর্ব অষ্টম শতকে এই অখ্যাত জনপদ প্রাচীন গ্রীক ও রোমান সংস্কৃতির সংমিশ্রণে এক কালজয়ী সভ্যতায় পরিণত হয়, যা ইতিহাসে রোমান সভ্যতা হিসেবে চিহ্নিত। যে সভ্যতার সুদূরপ্রসারী প্রভাব- অন্যান্য পশ্চিমা সভ্যতা, রাজনীতি, দর্শন ইত্যাদিতে বিরাজমান। ট্রেনটা মিলান সেন্ট্রাল রেলস্টেশনে এসে থামল। এখানে দু’ঘণ্টা যাত্রাবিরতি; এরপর ভেনিসের পথে যাত্রা। স্টেশনে নেমেই আমরা হন্যে হয়ে খাবারের দোকান খুঁজতে লাগলাম। একটা বেশ বড় পিৎজার দোকান পেয়েও গেলাম। দোকানের সামনে প্যারিসের ‘গ্যারে ডি লিওন’ স্টেশনের মতো অসংখ্য পায়রা ঝটপট ঘুরে বেড়াচ্ছে। পিৎজার দোকানে ঢুকে খাবারযোগ্য পিৎজার তত্ত্ব-তালাশ করতে লাগলাম। দোকানের শোকেসে হরেক রকমের পিৎজার বিজ্ঞাপন। প্রতিটি পিৎজার পাশে নাম, উপকরণের বর্ণনা। পিৎজাগুলো হ্যাম, স্যামন ছাড়া বিভিন্ন সী-ফুডের ফিলিং দেয়া। চিকেন কিংবা বিফ পিৎজা নেই। অবশেষে ‘ভেজিটেরিয়ান মার্গারিটা’ পিৎজাই বেছে নিলাম। দাম বেশ স্বস্তা- মাত্র দুই ইউরো। মজারেলা চিজ আর টমেটো পিউরির টপিং দেয়া সাধাসিধা পিৎজাটি বেশ সুস্বাদু। প্লেটের পিৎজার শেষ টুকরাটুকু সাবাড় হলে পলাশ আমাকে কফি আনতে পাঠাল। আইটেম লিস্টে কাপ্পুচিনো কফির দাম দেখা যাচ্ছে- মাত্র এক ইউরো! বেশ সস্তাই বলা যায়। তাড়াতাড়ি দু’কাপ অর্ডার দিলাম। কিন্তু কফি পেয়ে তো কিংকর্তব্যবিমূঢ়! কাপ তো দূরের কথা, অতিক্ষুদ্রাকায় একটি পাত্রে কয়েক ফোঁটা কফি। আশঙ্কা হলো, এরা বিদেশী বলে আমার সঙ্গে রসিকতা করছে না তো। দোকানের কর্মচারীর গাম্ভীর্যপূর্ণ চেহারা দেখে আশ্বস্ত হলাম- নাহ্! সে এ রকম অনধিকারচর্চাটি করছে না। কাপ্পুচিনোর এমন করুণ চেহারা দেখে পলাশ তো হেসে অস্থির। আমিও বোকার মতো হাসতে লাগলাম। এক চুমুকে শেষ করে মনে হলো- এটা অমৃতের বদলে গরল হলেও হতে পারে। কেমন তিতকুটে তামাক তামাক স্বাদ। এ-ই তাহলে ইতালিয়ান কাপ্পুচিনো! পলাশ মুচকি হেসে বলল- যাও, এবার গিয়ে বলো ক্রিম কফি চাই। উঠে গিয়ে কাউন্টারের কর্মচারীটিকে আকার-ইঙ্গিতে বুঝিয়ে দিলাম, ক্রি-ম কফি চাই। এবার যথার্থ ক্রিম কফি পেলাম, তবে জ্যামিতিক হারে দাম বেড়ে গেছে অলরেডি। ভেনিসগামী ট্রেন আসতে এখনও ঘণ্টাখানিক সময় বাকি। পলাশ মনে করিয়ে দিল, এই মিলান শহরটি দু-দুটি ফুটবল টিমের জন্য বিখ্যাত। এসি মিলান ও ইন্টার মিলান। আজ আমরা ‘ফুটবলের শহর’ মিলানের ক্ষণিকের অতিথি। লাগেজের কারণে স্টেশনের বাইরে গিয়ে শহরটা একটু চক্কর মেরে দেখতে পারছি না। কেমন উসখুস করছি! যাত্রাবিরতির অবশিষ্ট সময়টুকু কাটানোর জন্য শেষ পর্যন্ত প্রসাধনীর দোকানেই ঢুকলাম। এ্যাড্রিয়াটিকের রানী ভেনেসিয়া ভেনিসের মূলত দুটি অংশ- মূল ভূখ- ও দ্বীপগুচ্ছ। পর্যটকরা যে ভেনিস দেখতে যায়- তা মূলত দ্বীপগুচ্ছ। ওখানকার স্টেশনের নাম সান্তা লুসিয়া। আমরা ভেনিসের মূল ভূখ- মেস্ত্রেতে নামলাম। এখানকার হোটেলেই আমাদের বিশ্রাম ও রাতযাপনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। একেই বোধ হয় ‘স্টোন থ্রো ডিস্ট্যান্ট’ বলে। ‘ত্রিস্তার’ হোটেলটি একদম স্টেশন লাগোয়া। খাটো চুলের গুরুগম্ভীর রিসিপশনিস্টটি রুমের চাবি দেয়ার আগে একটা ফরম ধরিয়ে দিল। পর্যটকদের জন্য প্রযোজ্য বিশেষ সিটি ট্যাক্সটি কেটে নিল। এই প্রথম আমরা এ ধরনের ট্যাক্স দিলাম। আবলুস কাঠের সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় আমাদের জন্য নির্ধারিত কক্ষটিতে ঢুকলাম। বিশালাকায় রুমটায় ভারি ভারি জানালা আঁটা। ঘরের আসবাব ও সাজসজ্জায় ভেনিসীয় ঐতিহ্যের প্রকাশ। সাদা মকমলের পর্দা সরিয়ে জানালা খোলার চেষ্টা করলাম। জানালায় ভারি হুড়কো আর আড়াআড়িভাবে কাঠের ডাসা বসানো। কে জানে হয়ত চুরি ঠেকাতে এই নিরাপত্তাব্যবস্থা। তাই আপাতত জানালা খোলার চেষ্টা বাদ দিলাম। ডাবল বেডের পাশাপাশি একটা সিঙ্গেল বেড পাতা। ফ্যামিলিসহ থাকার ব্যবস্থা। বিছানার চাদর, সুজনি, এমনকি পর্দা পর্যন্ত সাদা। নিকষকালো আবলুস কাঠের ভারি ফার্নিচারের বিপরীতে মানিয়েছে বেশ। কাঠের মধ্যে পেতলের সুক্ষ্ম কারুকাজ করা বিশেষ কেতার সাইড টেবিলটা এই অন্দরসজ্জার বিশেষ আকর্ষণ। রুমের প্রবেশমুখে হলরুমের মতো অতিকায় প্যাসেজটিও অত্যন্ত আকর্ষণীয়ভাবে সাজানো। এক কোনায় ভারি কাঠের টেবিল পাতা। টেবিলের ওপর ফুলদানিতে কিছু সাদা লিলি রাখা। প্যাসেজের মাঝখান বরাবর বড় কার্পেট পাতা। উপরে একটা বড় ঝাড়বাতি ঝুলছে। ছাদে আড়াআড়িভাবে লম্বা কালো কাঠের কড়িবর্গা দেয়া। ভেনিসবাসীর এসব নান্দনিকতার পরিচয় পেয়ে মনে মনে তারিফ করলাম- ‘বাহ্, বাহ্!’ ত্রিস্তারে দু’দ- বিশ্রাম শেষে সান্তা লুসিয়ার পথে পা বাড়ালাম। ভরদুপুরে ‘মেস্ত্রে’ স্টেশনটা খাঁ খাঁ করছে। প্রচ- শীতের কারণে পর্যটকের আনাগোনা কম। টিকেট কাউন্টার থেকে টিকেট কেটে চটজলদি ভেনিস যাওয়ার ট্রেনে উঠে পড়লাম। ট্রেন ছাড়লে আস্তে আস্তে শহর ছাড়িয়ে দু’পাশে জলাভূমি দেখা গেল। পানি থৈ থৈ করছে। মাঝেমধ্যে দূরে বিন্দু বিন্দু গ্রামের মতো চোখে পড়ছে। প্রাচীনকালের লাল ইটের সব দালানকোঠা। সিমেন্টের পলেস্তারা খসে পড়া, ক্ষয়ে পড়া দালানগুলো যেন দাঁত বের করে আছে। দৃশ্য হিসেবে খুব মনোরম কিছু নয়। আমাদের দেশেও গ্রামগঞ্জে এ রকম পুরনো দালানকোঠার সন্ধান মেলে। তবে অপরাহ্নের আলোয় এগুলো কেমন মায়াবি আর রহস্যময় মনে হচ্ছে। নাক টেনে টেনে যেন পুরাতনের গন্ধ পাচ্ছি। জায়গাটিকে আর ইউরোপের কোন নগর বলে মনে হচ্ছে না। প্রায় আধা ঘণ্টা পর ভেনিসের সান্তা লুসিয়া রেলস্টেশনে পৌঁছলাম। মূলত এই ট্রেনলাইন দ্বারা ভেনিসের চারপাশের ল্যাগুন বা জলাভূমিকে মেইনল্যান্ডের সংযোগ স্থাপন করা হয়েছে। আমরা স্টেশনে নেমে ভেনিস ট্যুরিজম কাউন্টারটি খুঁজে বের করলাম। লম্বা টিংটিংয়ে পর্যটন কর্মকর্তাটি হাত নেড়ে জানালেন- যেহেতু এখন ট্যুরিস্ট সিজন নয়, তাই হেঁটে অথবা ওয়াটারবাসে করে পুরো ভেনিস শহরটাকে দেখতে হবে। ভেনিসের বিখ্যাত গন্ডোলা বা বিশেষ বোটে চড়ে বেড়ানোর ব্যবস্থা আপাতত বন্ধ রয়েছে। ভেনিসে এসে গন্ডোলায় চড়া হবে না- ব্যাপারটা যেন অনেকটা প্যারিসে এসে আইফেল টাওয়ার না দেখে বাড়ি ফেরার মতো। কী আর করা, অফ সিজন বলে কথা! আমরা স্টেশনের গেট দিয়ে এ্যাড্রিয়াটিক সাগরের পূর্বতীরে অবস্থিত ইউরোপের সবচেয়ে ঐতিহ্যময় স্থান ভেনিস নগরে প্রবেশ করলাম। ভেনিসকে ইতালিয়ানরা ভিনিজিয়া বলে ডাকে। এর সুপ্রাচীন স্থাপত্য ও শিল্পকলার জন্য একে ‘কুইন অব এ্যাড্রিয়াটিকও বলা হয়। আধুনিক প্রযুক্তির বিধ্বংসী ছোঁয়া থেকে বাঁচাতে ইউনোস্কো একে ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট হিসেবে ঘোষণা করেছে। (চলবে)
×