কাওসার রহমান ॥ ঢাকার আশপাশের যে কোন জেলাতেই যদি সাত মাত্রার কোন ভূমিকম্প হয় তাহলে তা হবে শহরটির জন্য একটি বিশাল বিপর্যয়। ঢাকার পাশে মধুপুরকে একটি ভূমিকম্প ঝুঁকি এলাকা মনে করা হয়। সেখানে সাত বা সাড়ে সাত মাত্রার কোন ভূমিকম্প হলেই ঢাকার সাড়ে তিন লক্ষ ভবনের মধ্যে ৭০ হাজারের মতো ভবন ধসে পড়বে বা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। আর তাতে ২০১০ সালে হাইতির পোর্ট অব প্রিন্সে ভূমিকম্পের পর যে ধরনের ধসের চিত্র দেখা গেছে ঢাকাতেও একই ভয়াবহ অবস্থা হবে। এধরনের কোন বিপর্যয় হলে ঢাকায় লোকজনকে সরিয়ে নেয়ার কোন জায়গা নেই। হাসপাতালগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হলে ফিল্ড পর্যায়ে অস্থায়ী চিকিৎসা কেন্দ্র তৈরির কোন জায়গা থাকবে না।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা নিয়ে কাজ করছে এমন একটি সরকারী প্রকল্প কমপ্রিহেনসিভ ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট প্রোগ্রামের পরিচালক আব্দুল কাইউম বলছেন, তারা এই প্রকল্পের অধীনে ঢাকা, চট্টগ্রাম ও সিলেটসহ নটি বড় শহরের ঝুঁকি নির্ণয় করেছেন।
তিনি আরও বলছেন, ঢাকায় সম্ভাব্য কোন পরিস্থিতি সামাল দিতে স্বেচ্ছাসেবী তৈরি করা ছাড়া উপায় নেই। সেরকম ৬২ হাজার স্বেচ্ছাসেবী তৈরি করার উদ্যোগ নেয়া হলেও তার অর্ধেকই হয়নি। তিনি উদাহরণ হিসেবে রানা প্লাজা ধসের ঘটনা উল্লেখ করে বলেন, সেখানে স্বেচ্ছাসেবীরাই অনেক উদ্ধার কাজ করেছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সিলেটের ডাউকি ফল্ট ও টাঙ্গাইলের মধুপুর ফল্ট সক্রিয় থাকায় বাংলাদেশে শক্তিশালী ভূমিকম্পের ঝুঁকি রয়েছে। আর ভূমিকম্পের কোন পূর্বাভাস ও প্রতিরোধ ব্যবস্থা না থাকায় সচেতনতা ও প্রস্তুতিকেই সর্বোচ্চ করণীয় বলে মানছেন বিশেষজ্ঞরা।
গত সোমবার ভোরে ঢাকা থেকে প্রায় সাড়ে ৩০০ কিলোমিটার পূর্বে ভারতের মনিপুরে আঘাত হানা ৬ দশমিক ৭ মাত্রার ভূমিকম্পে কেঁপে উঠেছিল বাংলাদেশও। এ অবস্থায় নতুন করে শঙ্কা সৃষ্টি হয়েছে বিশ্বের ঘনবসতিপূর্ণ এ দেশে। সরকারের দায়িত্বশীল কর্মকর্তা ও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভূমিকম্প নিয়ে কোন আতঙ্ক নয়, প্রস্তুতিই এখন অগ্রাধিকার। সেই সঙ্গে সচেতনতারও কোন বিকল্প নেই।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক এ এস এম উবায়দুল্লাহ জানান, ১৯১৮ সালে সিলেট এলাকায় এবং পরবর্তীতে সিরাজগঞ্জ-বগুড়ায় শক্তিশালী ভূমিকম্প হওয়ার রেকর্ড রয়েছে। সাম্প্রতিক কোন শক্তিশালী ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল বাংলাদেশ নয়। তিনি বলেন, বাংলাদেশের ডাউকি ও মধুপুর ফল্টের বাইরে কাছাকাছি মনিপুর ফল্ট বেশ সক্রিয়। নিয়মিতই এসব জায়গায় ভূমিকম্প হচ্ছে। কয়েক বছর পর পর মৃদু থেকে মাঝারি কম্পন হয়; তা গণমাধ্যমে আসেও না।
অধ্যাপক উবায়দুল্লাহ বলেন, ‘আমরা ঝুঁকিতে আছি এটা সত্য। কিন্তু এ নিয়ে নতুন করে প্যানিক সৃষ্টি করা ঠিক হবে না। সচেতনতা ও প্রিপেয়ার্ডনেস হচ্ছে মূল করণীয়। সরকারী-বেসরকারী পর্যায়ে সবাইকে এ নিয়ে এগোতে হবে।’
শক্তিশালী ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল দেশের ভেতরে হলে ঘনবসতিপূর্ণ ঢাকাসহ অন্যান্য মহানগরীতে বেশ ক্ষয়ক্ষতি হবে বলে জানান তিনি। কোন পরিসংখ্যান না দিয়ে অধ্যাপক উবায়দুল্লাহ বলেন, ‘ভূমিকম্প হচ্ছে-হবে; এখন আর এ নিয়ে মানুষকে বিচলিত করা যাবে না। ধ্বংসযজ্ঞ হলেও যারা বেঁচে থাকবে তাদের উদ্ধারের জন্য তৈরি থাকতে হবে। এজন্য উপযুক্ত যন্ত্রপাতি কেনা ও যান চলাচলের উপযোগী রাস্তাঘাট রাখতে হবে। বাড়ির আশপাশের জায়গা ছেড়ে দিয়ে ভবন নির্মাণ করতে হবে; না থাকলে তা তৈরি করে নিতে হবে।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এ শিক্ষকের সঙ্গে একমত পোষণ করে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদফতরের মহাপরিচালক রিয়াজ আহমেদ বলেন, ‘ভূমিকম্পের কোন আর্লি ওয়ার্নিং বা প্রতিরোধ ব্যবস্থা না থাকলেও প্রস্তুতির কাজ অনেক এগিয়ে রাখা হয়েছে।’
তিনি বলেন, দেশের অভ্যন্তরে রিখটার স্কেলে সাড়ে ৭ থেকে বেশি মাত্রার ভূমিকম্প হলে পৌনে এক লাখ ঝুঁকিপূর্ণ ভবন ভেঙ্গে পড়তে পারে। এ সংক্রান্ত সম্ভাব্য ঝুঁকি বিবেচনা করে আমরা বেশ কিছু কাজ করেছি। ইতোমধ্যে ঢাকার ৭২ হাজারেরও বেশি ঝুঁকিপূর্ণ ভবন চিহ্নিত করেছি। চট্টগ্রাম এবং সিলেটে রয়েছে সাড়ে তিন হাজারের বেশি ঝুঁকিপূর্ণ ভবন। এ তিন মহানগরে ভূমিকম্পের পর লোকজনকে স্বাস্থ্যসেবা দেয়া, আবর্জনা সরানো ও উদ্ধার কাজ দ্রুত করতে প্রস্তুতি রয়েছে।’
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদফতরের মহাপরিচালক রিয়াজ আহমেদ জানান, জান-মালের ক্ষয়ক্ষতি কমাতে সচেতনতা বাড়াতে পাঠ্যসূচীতে এ সংক্রান্ত বিষয় রাখা হয়েছে। আতঙ্ক না ছড়িয়ে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেয়ার প্রশিক্ষণও চলছে। ভবন নির্মাণে বিল্ডিং কোড অনুসরণে জোর দেয়া হচ্ছে। ঝুঁকিপূর্ণ ভবনগুলোকেও দ্রুত বিল্ডিং কোড মেনে তা মেরামতের তাগিদ দেয়া হয়েছে।
রিয়াজ আহমেদ জানান, দুর্যোগ মোকাবেলায় সম্প্রতি ৬৭ কোটি টাকার ভারি যন্ত্রপাতি কেনা হয়েছে; যা দমকল বাহিনী ও সশস্ত্র বাহিনী বিভাগে রাখা হয়েছে। আরও ১৬৭ কোটি টাকার যন্ত্রপাতি কেনা প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। তবে দুর্যোগ আসলে ঢাকার, বিশেষ করে পুরান ঢাকার অলিগলির কারণে উদ্ধার তৎপরতা বড় ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে মনে করেন তিনি।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদফতরের মহাপরিচালক বলেন, ‘বাংলাদেশ দুর্যোগ মোকালোয় রোল মডেল। আমরা নানা ধরনের দুর্যোগে নেতৃত্ব দিয়েছি। ভূমিকম্পের আগাম সতর্ক ব্যবস্থা না থাকলেও পিছিয়েও থাকব না। আতঙ্কিত না সচেতনতা ও প্রস্তুতি কাজ এগোচ্ছে।’
২০০৯ সালে প্রকাশিত ইউএনডিপির কম্প্রিহেনসিভ ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট প্রোগ্রাম- সিডিএমপি প্রকল্পের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, তখন রাজধানীতে বিভিন্ন ধরনের ভবনের সংখ্যা ছিল প্রায় সোয়া তিন লাখ। এই ভবনগুলোর প্রায় ৪০ শতাংশের অবস্থাই ঝঁকিপূর্ণ বা নাজুক এবং ‘মধ্যম’ মানের ভবন ছিল প্রায় ৩৫ শতাংশ। ভবনগুলোর অর্ধেকের বেশি নির্মিত হয় ৩০ বছর বা তারও আগে।
গতিশীল প্লেটের সঞ্চারণে ভূকম্পন ॥ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ও আর্থ অবজারভেটরির তত্ত্বাবধায়ক সৈয়দ হুমায়ুন আখতার জানান, ভূমিকম্প, অগ্নুৎপাত, পাহাড়-পর্বত সৃষ্টি- এসব কিছুই নিয়ন্ত্রিত হয় ভূত্বক গঠনকারী প্লেটগুলোর সঞ্চরণের ওপর।
পৃথিবীর উপরিভাগের ৭০-১০০ কিলোমিটার পুরুত্বের লিথোস্ফিয়ার ছোট-বড় ১৩টি খ-ে (প্লেটে) বিভক্ত। উত্তপ্ত ও নরম এস্থোনোস্ফিয়ারের ওপর ভাসমান এ প্লেটগুলো গতিশীল। বাংলাদেশের উত্তরে ইন্ডিয়ান প্লেট এবং ইউরেশিয়ান প্লেটের সংযোগস্থল; পূর্বে বার্মিজ প্লেট এবং ইন্ডিয়ান প্লেটের সংযোগস্থল। প্লেটগুলো গতিশীল থাকায় বাংলাদেশ ভূখ- ধীরে ধীরে সরে যাচ্ছে বলে জানান সৈয়দ হুমায়ুন।
২০০৪ সালে ভারত মহাসাগরে সুনামিতে (ভূমিকম্পের ফলে সৃষ্ট জলোচ্ছ্বাস) বিভিন্ন দেশে দুই লাখের বেশি মানুষ প্রাণ হারায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের এই অধ্যাপক মনে করছেন, ভূমিকম্পে ঢাকা, পার্বত্য চট্টগ্রাম, রংপুর, ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা ও দিনাজপুর অঞ্চলই সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ। বাংলাদেশ ছাড়াও ভারতের মেঘালয়, আসাম, মনিপুর, মিজোরাম এবং মিয়ানমার সীমান্তের কাছে রিখটার স্কেলে ৭ এর বেশি মাত্রার ভূমিকম্প হলে ক্ষয়ক্ষতির মাত্রা ভয়াবহ হবে বলে জানান তিনি।
ভূমিকম্পে যা করতে হবে ॥ বিশেষজ্ঞরা জানান, ভূমিকম্প হলে কোনভাবে আতঙ্কিত না হয়ে কাজ করতে হবে। ভারতের মনিপুরে গত সোমবারের ভূমিকম্পে বাংলাদেশে আতঙ্কিত হয়ে তাড়াহুড়া করতে গিয়ে অন্তত পাঁচজনের মৃত্যুও হয়েছে।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদফতরের মহাপরিচালক রিয়াজ আহমেদ জানান, বিল্ডিং কোড মেনে ভবন নির্মাণ করলেও ক্ষয়ক্ষতি অনকে কমবে। তিনি বলেন, ‘ভূমিকম্পের সময় তাড়াহুড়া করে সময় নষ্ট না করে ভবনের পিলারের কাছাকাছি অবস্থান করতে হবে। প্রাথমিকভাবে পারলে টেবিল বা খাটের নিচে অবস্থান করতে হবে; যাতে ভাঙ্গা টুকরো শরীরে না লাগে।’ আর ভবন থেকে বেরুতে পারলে একটু ফাঁকা এলাকায় অবস্থান করার পরামর্শও দিয়েছেন তিনি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক উবায়দুল্লাহ বলেন, ‘প্রত্যেক নাগরিককে এ নিয়ে সচেতন হতে হবে। অন্তত যারা বেঁচে থাকবে তাদের উদ্ধার ও সেবা দিতে উপযুক্ত প্রস্তুতি থাকতে হবে।’
বিশেজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশ ঘূর্ণিঝড়, বন্যা ইত্যাদি প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলায় যথেষ্ট সাফল্য দেখালেও ভূমিকম্পের মত ব্যাপক বিধ্বংসী দুর্যোগ সামাল দেয়ার প্রস্তুতির ক্ষেত্রে অনেক পিছিয়ে। এই আকস্মিক দুর্যোগে বিপুল প্রাণহানি ও সম্পদহানির ঝুঁকিতে রয়েছে বাংলাদেশ। বিশেষত বড় শহরগুলোয় এই ক্ষতির মাত্রা ব্যাপক হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। তবে এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে একমত নন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণমন্ত্রী মোফাজ্জাল হোসেন চৌধুরী মায়া। তিনি বলেন, ‘আমি মনে করি, ঢাকার মাটি ভূমিকম্পকে সহনশীল করতে পারে। সাত মাত্রার ভূমিকম্প হলেও ঢাকায় ক্ষতি হবে বলে আমার মনে হয় না, এটা আমার আত্মবিশ্বাস।’
সোমবার ভোরে যে ভূমিকম্পে বাংলাদেশ কেঁপে উঠেছে, তার কেন্দ্র ছিল ঢাকা থেকে ৩৫২ কিলোমিটার পূর্ব উত্তর-পূর্বে ভারত-মিয়ানমার সীমান্তের কাছাকাছি। এর উৎপত্তিস্থল ছিল ভূপৃষ্ঠের ৫৫ কিলোমিটার গভীরে। ওই ভূমিকম্পে পুরান ঢাকার বংশাল এবং যাত্রাবাড়ীর রায়েরবাগে দুটি ভবনে হেলে পড়ার খবর পাওয়া গেছে। সিলেট নগরীর একটি নির্মাণাধীন মার্কেটের দেয়াল ধসে পাশের ভবনে পড়ে চারজন আহত হয়েছেন।