ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

মিলু শামস

দক্ষিণ চীন সাগরে ঝড়ের পূর্বাভাস

প্রকাশিত: ০৪:২৪, ১১ নভেম্বর ২০১৫

দক্ষিণ চীন সাগরে ঝড়ের পূর্বাভাস

পুঁজিবাদী অর্থনীতির জনক এ্যাডাম স্মিথ যে দুটো ঘটনাকে মানুষের ইতিহাসে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও মহত্তম বলে উল্লেখ করেছেন তার একটি চৌদ্দশ’ বিরানব্বই সালে কলম্বাসের আমেরিকা ‘ আবিষ্কার’। অন্যটি উত্তমাশা অন্তরীপ হয়ে পূর্ব ভারতের পথ খুঁজে পাওয়া। তার ভাষায় এ দুই ঘটনা ইউরোপের জন্য নতুন ও বিশাল বাজার এবং সম্পদ লাভ, উৎপাদিকা শক্তির বিপুল বিকাশের পথ প্রশস্ত করে দিয়েছিল। মার্কিনীদের কলম্বাসের তথাকথিত আমেরিকা আবিষ্কারের ইতিহাসের প্রাসঙ্গিক তথ্য থেকে জানা যায়, চৌদ্দশ’ বিরানব্বই সালে যে ঘটনার নায়ক হয়েছিল ইউরোপ সামান্য ভুল না হলে নায়কের ওই আসন হয়ত হত এশিয়ার। ভুলটি করেছিলেন চীনের সম্রাট। পনের শতকের শুরু থেকেই চীনারা সমুদ্র বাণিজ্যে নৈপুণ্য ও আধিপত্য অর্জন করেছিল এবং ওই শতকের মাঝমাঝি চীনা বণিক ও নাবিকেরা নতুন অঞ্চল সন্ধানের যে পরিকল্পনা করেছিল তাতে তাদের আমেরিকা পৌছানোর উজ্জল সম্ভাবনা ছিল। তাদের উন্নতমানের জাহাজ ও অন্যান্য প্রস্তুতি নিয়ে তারা যদি কলম্বাসের পঞ্চাশ বছর আগেই আমেরিকায় পৌঁছতে পারত তাহলে পৃথিবীর ইতিহাসই হয়ত উল্টে যেত। কিন্তু চীনা বণিক ও নাবিকদের সব প্রস্তুতি ও প্রচেষ্টা থমকে যায় সমুদ্র বাণিজ্য ও নতুন অঞ্চল সন্ধানের ওপর সে সময়ের চীনা সম্রাটের নিষেধাজ্ঞা আরোপে। তেমন হলে হয়ত আগ্রাসী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জায়গায় শান্তিকামী চীন হতো পৃথিবীর নেতৃত্ব দেয়া দেশ। এবং সন্ত্রাস, অস্থিরতা, অস্ত্র প্রতিযোগিতা ইত্যাদির বদলে মানুষ পেত নিরুদ্বিগ্ন বাসযোগ্য এক পৃথিবী। এসবই সম্ভাবনার কথা। হতে পারতো কিন্তু হয়নি। যা হয়েছে, বলা ভাল এ মুহূর্তে যা হচ্ছে তাই বাস্তব। সেই বাস্তবতা জানান দিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র এখন চীনকে অশান্ত করতে বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। মধ্যপ্রাচ্য, আরব ইত্যাদির পর যুক্তরাষ্ট্রের পরবর্তী নাটকটি সম্ভবত মঞ্চায়িত হতে যাচ্ছে দক্ষিণ চীন সাগরে। দক্ষিণ চীন সাগর নিয়ে চীন-মার্কিন দ্বন্দ¦ প্রায় ক্লাইমেক্সে। চব্বিশ অক্টোবর রয়টার্সের খবর জানায়, মার্কিন প্রশাসনের পক্ষ থেকে দক্ষিণ চীন সাগরের স্প্যাতলি দ্বীপপুঞ্জের বার নটিক্যাল মাইল এলাকায় রণতরী বা যুদ্ধবিমান পাঠানোর কথা আলোচনায় আসার পর থেকে অবস্থা থমথমে। আন্তর্জাতিক আইনে সব দেশেরই নিজের উপকূল থেকে বার নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত বিস্তৃত জলরাশির ওপর বৈধ অধিকার রয়েছে। সে অনুযায়ী চীনের নিজস্ব ভূখন্ড স্প্যাতলি দ্বীপপুঞ্জের চার দিকের বার নটিক্যাল মাইল সমুদ্র সীমা চীনের। কিন্তু গায়ের জোরে মাতব্বরি করার চিরাচরিত স্বভাব অনুযায়ী য্্ুক্তরাষ্ট্র যথারীতি ঘোষণা দিয়েছে স্প্যাতলি দ¦ীপপুঞ্জের ওপর চীনের ওই দাবী তারা মানে না। মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী চীনকে সাবধান করে বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র সময়মত অবশ্যই সেখানে রণতরী পাঠাবে, এবং তা আগামী দু’সপ্তাহের মধ্যে হতে পারে। য্ক্তুরাষ্ট্রের এই অবস্থানের বিপরীতে চীনের অবস্থান এখনও শান্ত। চীনা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র বলেছেন, আমরা আশা করছি যুক্তরাষ্ট্র বাস্তুব ও নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে দক্ষিণ চীন সাগরের বর্তমান পরিস্থিতি দেখবে এবং এখানকার শান্তি ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে চীনের সঙ্গে একযোগে এক গঠনমূলক ভূমিকা পালন করবে। ওই মুখপাত্র গভীর উদ্বেগ জানিয়ে বলেন, মার্কিন পক্ষের কাছে চীনের সংশ্লিষ্ট নীতিগত অবস্থান খুবই স্পষ্ট। চীনকে অশান্ত করতে য্্ুক্তরাষ্ট্রের এমন মরিয়া হয়ে ওঠার অন্যতম কারণ সম্ভবত অর্থনৈতিক পরাশক্তি হিসেবে চীন যুক্তরাষ্ট্রের বড় প্রতিপক্ষ হয়ে উঠছে। তেলের বাজার এবং অন্য অনেক ব্যবসায় যুক্তরাষ্ট্র চীনের কাছে বার বার মার খাচ্ছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে মার্কিন অর্থনীতি বড় ধরনের সংকটে পড়বে। আসন্ন নির্বচনও গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর। যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতি কর্পোরেট স্বার্থ কেন্দ্র করে আবর্তিত। কর্পোরেট পুঁজির কর্ণধারদের চটানোর ধৃষ্টতা স্বয়ং প্রেসিডেন্টেরও নেই। তারা যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধংদেহী চেহারা দেখতে পছন্দ করে। কারণ যুদ্ধের সঙ্গে তাদের স্বার্থ নিবিড়ভাবে জড়িত। ফলে ডেমোক্রেটিক, রিপাবলিকান নির্বিশেষে রাষ্ট্রপতি পদপ্রার্থীরা যুদ্ধবাদী যুক্তরাষ্ট্রকেই সমর্থন করে। যদিও দেশের সাধারণ নাগরিকরা যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধবাদী ও আগ্রাসী পররাষ্ট্র নীতিকে তীব্র সমালোচনা করেন। এছাড়া দক্ষিণ চীন সাগরে চীনের প্রতিবন্ধকতার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের অবাধ চলাচল বাধা পাচ্ছে। ইচ্ছে করলেই যেকোন সময় এশিয়ার যেকোন দেশে অস্ত্র ও সামরিক সরঞ্জাম পরিবহন করা কঠিন হয়ে পড়ছে। যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধংদেহী হওয়ার এটাও এক বড় কারণ। চীনের পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র নরম সুরে কথা বললেও দক্ষিণ চীন সাগরে চীনের অবস্থান বদলের সম্ভাবনা খুবই কম, কেননা এটি তাদের জাতীয় নিরাপত্তা কৌশলের সঙ্গে সম্পর্কিত। পুঁজিবাদী বাজার অর্থনীতির কেন্দ্রের শক্তিশালী দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় ঋণদাতা এখন সমাজতান্ত্রিক বাজার অর্থনীতির চীন। ডলারের হিসাবে এ মুহূর্তে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি চীনের অর্থনীতির প্রায় তিন গুণ বড় হলেও বেজিংয়ের অর্থনীতিবিষয়ক পরামর্শদাতা প্রতিষ্ঠান জিকে ড্রাগনোমিক্সের এক কর্মকর্তা বছর দুয়েক আগে প্রত্যয়ের সঙ্গে বলেছিলেন, আগামী দশ বছরের মধ্যে চীনের অর্থনীতির আয়তন যুক্তরাষ্ট্রের সমান হবে। এ ভবিষ্যদ্বাণীতে অতিরঞ্জন নেই বলেই মনে হয়। কারণ, বিশ্ব মুদ্রা মজুদের চল্লিশ শতাংশের বেশি রয়েছে চীনের কাছে। দু’হাজার পঁচিশ সালের মধ্যে দু’শ’ একুশটি নগর ও আটটি অত্যাধুনিক মেগাসিটি নির্মাণের পরিকল্পনা রয়েছে তাদের; যার প্রতিটিতে জনসংখ্যা থাকবে দশ লাখ। চীনের অর্থনীতি লাফিয়ে এগোচ্ছে। দু’হাজার দশের শেষ দিকে ডলারের হিসাবে তার অর্থনীতির আয়তন ছিল পাঁচ দশমিক আট ট্রিলিয়ন ডলার বা ছয় লাখ কোটি ডলার। এক শ’ পঁয়ত্রিশ কোটি দশ লাখ জনসংখ্যার দেশ চীন বর্তমান বিশ্বে দ্বিতীয় বৃহত্তম তেলভোক্তা। প্রথম স্থানে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। তেলের জন্য চীনকে তাই বিভিন্ন মহাদেশে অনুসন্ধান চালাতে হচ্ছে। আরও আছে। বিমানবাহী জাহাজ তারা সমুদ্রে ভাসিয়েছে সে খবর এখন পুরনো। সবশেষ খবর (২০১২ সালের) হলো, চীন দূরপাল্লার ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র মোতায়েন শুরু করেছে যা সমুদ্রে চলমান জাহাজে আঘাত করতে সক্ষম। এ ধরনের ক্ষেপণাস্ত্র বিশ্বে এই প্রথম। আর বিশ্ববাসীর জানা আছে, বিমানবাহী জাহাজ হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের নৌশক্তির মূল স্তম্ভ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে বিমানবাহী জাহাজ হচ্ছে নৌশক্তি প্রদর্শনের অন্যতম স্ট্যাটাস সিম্বল। সুতরাং, চীন কোথায় যাচ্ছে তা সহজেই অনুমান করা যায়। দু’হাজার বারো সালে চীনে অনুষ্ঠিত বিমান প্রদর্শনীতে তারা চালক বা মানুষবিহীন হেলিকপ্টার জেড-ফাইভ এবং চালক বা মানুষবিহীন বিমান ডব্লিউজে-সিক্স হান্ড্রেড প্রদর্শন করে যা রাডার ফাঁকি দিয়ে উড়তে সক্ষম। চীনের এ দ্রুত এগিয়ে চলা ভূ-রাজনীতিকে বিশেষ করে দক্ষিণ এশিয়ার চিত্র আমূল পাল্টে দিতে পারে। এমনকি বিশ্বকে নিয়ন্ত্রণের চাবি পাশ্চাত্য থেকে প্রাচ্যের হাতে চলে আসতে পারে বলেও অনেকে মনে করছেন। চীন, ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশই এখন মূলত দক্ষিণ এশিয়ার ভূ-রাজনীতির কেন্দ্রে। পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেকের বাস এখানে। বিশ্ব অর্থনৈতিক শক্তির দ্বিতীয় ও তৃতীয় অবস্থানের দেশ রয়েছে দক্ষিণ এশিয়ায়। এর পরের অবস্থানের দেশটি দক্ষিণ এশিয়ায় না হলেও এশিয়ায়। চীন তার পররাষ্ট্রনীতিতে ধীরে ধীরে নিজের শক্তির প্রকাশ ঘটাচ্ছে। যেমন দু’হাজার দশে তারা দক্ষিণ চীন সাগরে দ্বীপমালার মালিকানা দাবি করার মধ্য দিয়ে এর প্রকাশ ঘটিয়েছিল। এসব দ্বীপের মালিকানা নিয়ে চীনের সঙ্গে প্রতিবেশী দেশের সম্পর্কের টানাটানি চলছে বহুদিন ধরে। দুই হাজার দুইয়ে আসিয়ানের সঙ্গে চীন একমত হয় যে, বিষয়টি বহুপক্ষীয়ভাবে মীমাংসা করা হবে। কিন্তু পরে চীন ওই সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসে জানায়, এ সমস্যার সমাধান হবে আলাদা আলাদা বা দ্বিপক্ষীয়ভাবে। যাহোক, চীন-মার্কিন দু’দেশের মুখোমুখি সংঘর্ষ কোনভাবেই কাম্য নয়। কারণ দক্ষিণ চীন সাগর অস্থিতিশীল হলে তা শুধু সেখানেই সীমাবদ্ধ থাকবে না- ভারত মহাসাগর হয়ে ছড়িয়ে পড়বে বঙ্গোপসাগরেও।
×