ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

মেয়েবেলার পুতুলখেলা অবচেতন মনে বউ হওয়ার স্বপ্ন দেখায়

ছিল মধুময় ॥ সেদিনের ছেলেবেলা

প্রকাশিত: ০৬:৪৮, ১৭ অক্টোবর ২০১৫

ছিল মধুময় ॥ সেদিনের ছেলেবেলা

ছেলেবেলার গল্প শোনার দিনগুলো এখন কত দূরে আর আসে না রাজার কুমার পঙ্খীরাজে উড়ে...’ পঞ্চাশের দশকে হেমন্তের কণ্ঠের এই গান আজও মধ্যবয়সী ও প্রবীণদের নস্টালজিক করে তোলে। প্রত্যেক মানুষের জীবনে ছেলেবেলার দিনগুলো কতই না মধুর! যে মধুর দিন আর ফিরে আসে না। মায়ের কোলে যেমন সন্তান নিশ্চিন্তে ঘুমায় তেমনই ছেলেবেলায় মা বাবার কাছ থেকে আগামী দিনের স্বপ্ন দেখা ছাড়া আর কোন ভাবনা আসে না। মা বাবার ¯েœহের সুরে শাসনকেও মনে হয় কেন এতো বকা... কেন এত কথা...! মা বাবার এই ¯েœহমাখা আদর শাসনের কথা মনে হয় বড় হলে। যখন নিজে বাবা মা হয়ে সন্তানকে তেমনই আদর দিতে হয়। জীবন চলার পথে কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে তখন শুধু বলতে ইচ্ছে করে- মা... বাবা তোমরা কেন এসে বকা দাও না, শাসন কর না, এখন কেউ যে আর আমার ভুল ধরে দেয় না শাসন করে না...। মা বাবা হয়ত তখন না ফেরার দেশে। ওপর থেকেই তখন তারা সন্তানের পাশে অদৃশ্যে এসে মনের গভীরে ঢুকে সাহস দেয়। তবে সেইভাবে ডাকতে হয়। মা বাবার কাছে সন্তান কখনই বড় হয় না। মনে হয় সেই ছোট্টটিই রয়ে গেছে। মনে হয় দিন কত দ্রুত চলে যায়...। যারা মধ্যবয়সী তারাও মনে করে এই তো সেদিন বন্ধুদের সঙ্গে কি মধুময় সময় না কাটিয়েছি। স্কুল জীবনের বন্ধু প্রকৃত বন্ধু। কিশোর বেলা বা শৈশবের দিনগুলোতে যাদের সঙ্গে সখ্য গড়ে ওঠে তারাই শেষ দিন পর্যন্ত হৃদয়ে থাকে। শৈশব ও কৈশোর মানুষের জীবনের সবচেয়ে বড় অধ্যায়। তারপর জীবনের একেকটি সময়কে মনে হয় একেকটি অধ্যায়। সেই অধ্যায়ে রয়ে যায় কতই না স্মৃতি। যে স্মৃতি ভোলার নয়। স্মৃতির ভেলায় চড়লে অতল গহ্বরে ডুবেও যেতে হয়। সেই স্মৃতি যেন ব্যক্তি জীবনের ইতিহাসের পাতা। যে পাতা কখনও আবীর মেখে রং ছড়ায়। যেন বিবর্ণ হতে দেবে না মণিকোঠায়। সেই মণিকোঠায় তাকালে প্রথমেই ভেসে আসে শৈশবের দিনগুলো। ভোরে ঘুম থেকে উঠেই শুরু হয় ছুটোছুটির পালা। দিনভর চলে একটানা। যেন কোন ক্লান্তি নেই। এভাবেই পাঠশালা থেকে স্কুলের গ-ি। জুটে যায় কত বন্ধু। কৈশোর উচ্ছ্বলতায় সব অসম্ভবই তখন সম্ভব। তখন সবকিছুতেই বাজি গানের মতো ‘আমি রাজি রাখো বাজি একডুবে ভরা নদী হয়ে যাব পার...’। শৈশব থেকেই শুরু হয় মানব জীবনের প্রণয়ের অধ্যায়। যাকে ভাল লাগে তাকে দেখে কত যে স্বপ্ন দেখা। মনে হয়েছে সাত সমুদ্র তেরো নদী পাড়ি দিয়ে আনা হবে স্বপ্নে দেখা সেই রাজকন্যা! ছেলেবেলার বা মেয়েবেলার এমন দিনে বর বউ খেলাও হয় আঙিনায়। একটা সময় একান্নবর্তী পরিবারে চাচাত জ্যাঠাত ভাইবোন মিলে কখনও পাড়া পড়শির কোন ঘরের ছেলেমেয়ের সঙ্গে মজা করে বর-বউ খেলে কতই না পুলক অনুভব হয়েছে। মেয়েবেলায় পুতুল খেলা, পুতুলের বিয়ে দেয়ার আনন্দ সেদিনও ছিল, আজও আছে। পাটকাঠিতে শলাকা দিয়ে হাত বানিয়ে কাপড়ের টুকরো দিয়ে শাড়ি পরিয়ে পিজবোর্ডের মধ্যে রেখে কিই না মজা করা হতো। দু’টি পুতুল বানিয়ে বলা হতো বর-বউ। মেলা থেকে মাটির পুতুল কিনে এনেও এমন খেলা হয়েছে। সময়ের বিবর্তনে বর্তমানে এসেছে আধুনিক পুতুল বারবিডল। মেয়েবেলার পুতুল খেলা অবচেতন মনে বউ হওয়ার স্বপ্ন গেঁথে যায়। বড় হয়ে জীবনের আরেক অভিষেকে বউ হয়ে কোন ঘরে গিয়ে ছেলেবেলার স্বপ্ন সাধ পূরণ হয়ে ঘরে জন্ম নেয় আরেক শিশু। আদর করে নবজাতককে দেখে বলাবলি হয়, একেবারে পুতুলের মতো। ছেলেবেলার মিষ্টি মধুর দিনগুলোতে সন্ধ্যা বাতি দেয়ার আগেই ঘরে ফেরা ছিল বাধ্যতামূলক। ছেলেরা তাও খেলার মাঠে দূরে কোথাও হৈ হুল্লোর করে যেতে পারে। মেয়েরা ঘরের বাইরে বলতে বহির্আঙ্গিনা পর্যন্ত। তবে বর্তমানে গ্রামের মেয়েরা নদী তীরে স্কুলের মাঠে ছুটোছুটি করে বেড়ায়। দড়ি খেলা, বৌছি, দাড়িয়াবান্ধা খেলে। শৈশবে ছেলেমেয়েরা একসঙ্গে ছুটোছুটি করে মাতিয়ে তোলে নিজেদের। বড় হয়ে বাস্তবতার চিরন্তন অধ্যায়ে ছায়াছবির ফ্রেমের মতো একের পর এক দৃশ্যপট ভেসে আসে স্মৃতির এ্যালবামে। জন্মাবার পর শৈশব থেকে ছেলেবেলার দিনগুলো হয়ে যৌবন ও তারুণ্যে এবং জীবনের শেষ অধ্যায়ে পৌঁছার গীত রচনা করেছেন বরেণ্য গীতিকার পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়। জীবনকে সাতটি অধ্যায়ে ভাগ করে তিনি লিখেছেন- অরূপের অন্ধকার থেকে প্রথমে আলোর বিন্দু এসে ঝরে পড়ে রূপের জগতে। সে আলোয় শিশুর প্রথম আবির্ভাবেই চেতনার জন্ম হয়। আত্মচেতনা উপলব্ধির মন্ত্রে উজ্জীবিত হয়ে বলে, মাগো মা আমি এলাম তোমার কোলে, তোমার ছায়ায় তোমার মায়ায় মানুষ হবো বলে। সেই শিশু একদিন মায়ের কোল থেকে নেমে হাঁটতে থাকে। হাঁটি হাঁটি পা পা করে কৈশোরের উচ্ছ্বলতা পেরিয়ে তারুণ্যের উদ্দীপনার পর উত্তরণ হয় যৌবনের অভিষেকে। আত্মহারা কণ্ঠ অভ্যর্থনা জানায় এসো যৌবন এসো হে বন্ধু দিন গুনেছি তোমার জন্য। সেই উচ্ছ্বাস একদিন ডুবে যায় প্রশান্তির মাধুর্যে। অনুভব করে সে একা নয় পাশে কেউ আছে। সুখের সেই স্মৃতিতে গেয়ে ওঠে তুমি-আমি আর আমাদের সন্তান, এই আমাদের পৃথিবী। দিন কেটে যায়... মাঝ রাতে ঘুম ভেঙে যায়। ভাবতে থাকে জীবনের কত কাজ সারা হয়ে গেল আরও কত বাকি...। শৈশবের সেই দিনগুলোর কথা মনে করে কালের পাতা শেষের দিকে গিয়ে কোন এক সময়ে সেই মায়ের কোলে ফিরে গিয়ে মুখ লুকিয়ে আকুতি জানায়, আমায় চিনতে কেন পারছো না মা সবই ভুলে গেলে আমি তোমার অবোধ ছেলে ফিরে এলাম মায়ের কোলে...। মহাজীবন থেকে জীবনে আসা আর মহাজীবনে ফিরে যাওয়ার অনন্তকালের সারাজীবনে পৌঁছানোর ধারায় সূচিত হয় ছেলেবেলা। সেই ছেলেবেলা বা মেয়েবেলা নিয়ে বেড়ে ওঠে জীবন। কেউ কখনও ভুলতে পারে না শৈশবের দিনগুলো। জীবনের সবচেয়ে মধুরতম অধ্যায় ছেলেবেলা। মানব জীবনের প্রণয়ের সূচনা এই ছেলেবেলাতেই। প্রণয় বলতে শুধু মানব মানবীর প্রেমই নয়, হৃদয়কে আবেগে ভরে দেয় প্রণয়। Ñসমুদ্র হক, বগুড়া থেকে
×