ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২১ জুন ২০২৫, ৭ আষাঢ় ১৪৩২

সীতাকুণ্ডে গৃহবধূকে আগুন দিয়ে হত্যা: স্বামী মুসলিম উদ্দিনের শাস্তির দাবি

চট্টগ্রাম অফিস

প্রকাশিত: ১৭:১৬, ২১ জুন ২০২৫; আপডেট: ১৭:১৭, ২১ জুন ২০২৫

সীতাকুণ্ডে গৃহবধূকে আগুন দিয়ে হত্যা: স্বামী মুসলিম উদ্দিনের শাস্তির দাবি

ছবি: জনকণ্ঠ

চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে গৃহবধূ ফাতেমা আক্তারকে আগুন দিয়ে হত্যার অভিযোগে স্বামী মুসলিম উদ্দিনের শাস্তির দাবি করেছেন ভুক্তভোগী পরিবার ও এলাকাবাসী।

শনিবার (২১ জুন) সকালে সীতাকুণ্ড প্রেস ক্লাবে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এমন দাবি করেন তারা। এ সময় হত্যাকাণ্ডের সুষ্ঠু তদন্তসহ পাঁচটি দাবি তুলে ধরেন। এর আগে উত্তর বগাচতর এলাকাবাসী ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আনদোলনের ব্যানারে মানববন্ধন করেন ভুক্তভোগীর পরিবার ও এলাকাবাসী।
 
সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে উত্তর বগাচতর এলাকার বাসিন্দা ও সামাজিক সংগঠনের প্রতিনিধি আব্দুল্লাহ আল যাকারিয়া বলেন, ফাতেমা আক্তার মিরসরাই উপজেলার জোরারগঞ্জ থানার দক্ষিণ সোনা পাহাড় এলাকার নুরুল আবছারের মেয়ে। ১০ বছর আগে সীতাকুণ্ড উপজেলার ১নং সৈয়দপুর ইউনিয়নের উত্তর বগাচতর এলাকার নুরুল মোস্তফার ছেলে মুসলিম উদ্দিনের সঙ্গে তার বিবাহ হয়। এরপর থেকে তার স্বামীর দ্বারা শারীরিক, মানসিক ও সামাজিক নির্যাতনের শিকার হয়ে আসছেন ফাতেমা। অবশেষে সেই নির্যাতনের বলী হয়ে আগুনে দগ্ধ হওয়ার পাঁচদিন পর মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ে গত ১৮ জুন রাতে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে (চমেক) তিনি মারা যান।

স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, দীর্ঘদিন ধরে স্বামী মুসলিম তার স্ত্রীকে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করে আসছিলেন ফাতেমা। গত ১৪ জুন পারিবারিক কলহের একপর্যায়ে স্বামী আবারও মারধর করে। পরে ফাতেমাকে অগ্নিদগ্ধ অবস্থায় চমেক হাসপাতালের আইসিইউতে ভর্তি করা। তার শরীরের প্রায় ৬০ শতাংশ অংশ পুড়ে গিয়েছিল বলে জানান চিকিৎসকরা। পাঁচদিন চিকিৎসাধীন থাকা অবস্থায় গত বুধবার রাতে চমেক হাসপাতালে তিনি মারা যান।

স্বামী মুসলিম উদ্দিনকে গ্রেপ্তারের দাবি জানিয়ে যাকারিয়া বলেন, আশপাশের প্রতিবেশীদের তথ্যে আমরা জেনেছি, মারধরের এক পর্যায়ে ফাতেমাকে গৃহবন্দী করে আগুন লাগিয়ে দেয় মুসলিম। আগুনের তীব্র লেলিহানে চিৎকার শুনে আশপাশের মানুষ এগিয়ে আসে, ততক্ষণে শরীরের অর্ধেকাংশ পুড়ে যায়। ঘটনার সময় মুসলিম প্রথমে দাবি করে গ্যাস সিলিন্ডার থেকে আগুন লেগেছে। পরে বলে স্ত্রী নিজেই নিজের শরীরে আগুন লাগিয়ে দিয়েছে। তার অসংলগ্ন কথাবার্তা আমাদের মনে সন্দেহের জন্ম দেয়।

তিনি বলেন, ঘটনার পর এলাকার কয়েকজন যুবক মুসলিমের বাড়িতে যায়। তারা সেখানে গিয়ে টেনে তোলা মুষ্টিবদ্ধ চুল দেখতে পায়। সিলিন্ডার থেকে আগুন লাগার কোনো কোনো চিহ্ন খুঁজে পাননি তারা। মুসলিমের বড় ছেলে বলেছে, ঘটনার দিন মাকে তার বাবা মেরেছে। গলাও টিপে ধরছিল। তার ভিডিও বক্তব্য আমাদের কাছে সংরক্ষিত আছে। এলাকাবাসীর ধারণা, সম্প্রতি মুসলিম গোপনে দ্বিতীয় বিবাহ করেছে।

হত্যার রহস্য উন্মোচনের কথা জানিয়ে যাকারিয়া বলেন, মারধরের পর ফাতেমা অগ্নিদগ্ধ হওয়ার ঘটনা আমাদের কাছে রহস্যজনক। পাড়া প্রতিবেশী বলছে, আগুন লাগিয়ে দিয়েছে মুসলিম ও তার মা। অনেকে বলছে, ওইদিন মারধরের মাত্রা চরম মাত্রায় ছিল। তা সহ্য করতে না পেরে আত্মহননের পথ বেঁচে নেয় ফাতেমা। কিন্তু ফাতেমা কি এই কাজ করবে? তার ভাইয়েরা বলছে, ফাতেমা বিভিন্ন সময় স্বামীর মারধর সইতে না পেরে বাবার বাড়িতে চলে আসতো। আবার চলে যেতো সন্তানদের জন্য। শত অত্যাচারেও তিন ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে ফাতেমা মুসলিমের সংসার করে আসছে। সেই ফাতেমা নিজের শরীরে আগুন দিবে, এটা কখনো কল্পনা করা যায় না।

তিনি বলেন, বৃহস্পতিবার যখন চট্টগ্রাম মেডিকেল থেকে ফাতেমার মরদেহ ময়নাতদন্তের জন্য মর্গে নেওয়া হয়, তখন থেকে মুসলিম আত্মগোপনে চলে যায়। এমন কি স্ত্রীর জানাজায়ও উপস্থিত ছিল না। সে যদি নির্দোষ হতো, পালাতো না। পুলিশ প্রশাসনকে আমরা অনুরোধ করবো, পাষণ্ড স্বামী মুসলিমকে আইনের আওতায় এনে জিজ্ঞাসাবাদ করে প্রকৃত ঘটনা উন্মোচন করতে।

মামলা নেওয়ার বিষয়ে পুলিশের গড়িমসির অভিযোগ তুলে যাকারিয়া বলেন, অত্যন্ত পরিতাপের সঙ্গে জানাচ্ছি যে, ফাতেমার মৃত্যুর পর তার পরিবার সীতাকুণ্ড থানায় মামলা করতে গেলেও মামলা নেওয়া হয়নি। ঘটনার ৭২ ঘণ্টা পেরিয়ে গেলেও পুলিশের কোনো কার্যকর পদক্ষেপ আমরা লক্ষ্য করেনি। এরমধ্যে মুসলিম পালিয়ে গেছে। অসহায় মানুষের পাশে আইন, পুলিশ, রাষ্ট্র কেউ থাকে না, তার চরম প্রতিচ্ছবি যেন ভুক্তভোগীর ফাতেমার পরিবার।

এই মর্মান্তিক ঘটনায় আমরা গভীরভাবে উদ্বিগ্ন।ফাতেমার মৃত্যু কোনো নিছক পারিবারিক ঘটনা নয়; এটি একটি সামাজিক ব্যর্থতা, একটি রাষ্ট্রীয় অগ্রাহ্যতার প্রতিচ্ছবি। আমরা এর তীব্র নিন্দা জানাই এবং ঘটনার বিচার ও প্রতিকার জানিয়ে সরকার ও পুলিশ প্রশাসনের নিকট পাঁচটি দাবি উত্থাপন করছি। এগুলো হলো- আগামী ২৪ ঘণ্টার ভেতর পুলিশ মামলা গ্রহণ করতে হবে। অন্যর্থায় সীতাকুণ্ডের আপামর ছাত্র-জনতাকে নিয়ে বৃহত্তর কর্মসূচি দিতে আমরা বাধ্য হবো, অভিযুক্ত মুসলিমকে অবিলম্বে গ্রেপ্তার করে আইনানুগ বিচার প্রক্রিয়ার আওতায় আনতে হবে, ঘটনাটির পূর্ণাঙ্গ তদন্ত করে দোষীদের দ্রুত আইনের আওতায় এনে কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে, ফাতেমার পরিবারকে আইনি ও মানসিক সহায়তা প্রদান করতে হবে ও নারী নির্যাতন প্রতিরোধে স্থানীয় প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও সামাজিক সংগঠনগুলোর ভূমিকা আরও জোরদার করতে হবে।

এক প্রশ্নের জবাবে ভুক্তভোগীর মেজ ভাই নুর নবী বলেন, আমার বোনকে প্রায় সময়ে মুসলিম নির্যাতন করতেন। আমরা বলতাম, তুই আর সংসার করিস না। তখন বোন বলতো, তিনটি ছোট ছোট সন্তান; তাদের রেখে কিভাবে আসবে। ছেলেদের মুখের দিকে তাকিয়ে নির্যাতনের পরও মুসলিমের সংসার করেছে। তার প্রতিদানে আমার বোন আজ নেই। পাষণ্ড মুসলিম ও তার পরিবার আমার বোনকে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে মেরেছে। এই হত্যাকাণ্ডের বিচার চাই।

সংবাদ সম্মেলনে আরও উপস্থিত ছিলেন- সীতাকুণ্ড বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের প্রতিনিধি আসাদুজ্জামান, উত্তর বগাচতর একালার বাসিন্দা মহিবুর রহমার শওকত, খাইরুল ইসলাম, বোরহান উদ্দিন ও নেছার উদ্দিন মেজবা।

শিহাব

×