
সরকারি নিষেধাজ্ঞা এবং পরিবেশবিদদের একাধিক সতর্কবার্তা সত্ত্বেও পঞ্চগড় জেলার বিভিন্ন উপজেলায় অবাধে বিক্রি হচ্ছে পরিবেশবিনাশী ইউক্যালিপটাস ও আকাশমনি গাছের চারা। জেলার হাটবাজার, সড়কের পাশে এবং বিভিন্ন নার্সারিতে এই চারাগুলো প্রকাশ্যে বিক্রি হচ্ছে, যা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন পরিবেশ সচেতন নাগরিকরা।
মাঠপর্যায়ে নিষেধাজ্ঞার প্রয়োগ নেই:
সম্প্রতি দেবীগঞ্জ, বোদা, তেঁতুলিয়া, আটোয়ারী ও সদর উপজেলার বিভিন্ন বাজার ঘুরে দেখা গেছে, একাধিক নার্সারি ও স্থানীয় বিক্রেতা ইউক্যালিপটাস ও আকাশমনি গাছের চারা প্রকাশ্যে বিক্রি করছেন। তবে কোথাও প্রশাসনিক তদারকি বা পরিবেশ অধিদপ্তরের কোনো পদক্ষেপ দৃশ্যমান নয়।
এর আগে, গত ১৫ মে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় এক প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে ইউক্যালিপটাস ও আকাশমনিকে “আগ্রাসী প্রজাতি” হিসেবে ঘোষণা করে। ওই প্রজ্ঞাপনে এসব গাছের চারা রোপণ, উত্তোলন ও বিক্রয় সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করা হয়।
প্রজ্ঞাপনে বলা হয়:
“পরিবেশ, প্রতিবেশ ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের স্বার্থে সরকারি, বেসরকারি ও ব্যক্তি পর্যায়ে ইউক্যালিপটাস এবং আকাশমনি গাছের চারা রোপণ, উত্তোলন ও বিক্রয় নিষিদ্ধ করা হলো। দেশীয় ফলজ, বনজ ও ঔষধি গাছ রোপণে উৎসাহ প্রদান করতে হবে।”
বিক্রেতাদের অজুহাত: ‘চাহিদা আছে, তাই বিক্রি করি’
টেপ্রীগঞ্জ বাজারের এক চারা বিক্রেতা বলেন, “মানুষ তো এই গাছই চায়। আগেই চারা এনেছি, এখন না বিক্রি করলে লোকসান হবে। কেউ তো নিষেধ করছে না।”
একজন কৃষক বলেন, “এই গাছ দ্রুত বড় হয়, তাই অনেকেই লাগায়। তবে শুনেছি এর আশপাশে ফসল হয় না।”
পরিবেশের ওপর ক্ষতিকর প্রভাব:
পরিবেশবিদদের মতে, ইউক্যালিপটাস গাছের শিকড় গভীর থেকে পানি শোষণ করে, যার ফলে ভূগর্ভস্থ জলস্তর হ্রাস পায় এবং মাটির উর্বরতা কমে যায়। অন্যদিকে, আকাশমনি গাছ মাটিতে এক ধরনের রাসায়নিক পদার্থ নিঃসরণ করে, যা আশপাশের উদ্ভিদ বৃদ্ধিতে বিঘ্ন ঘটায় এবং জীববৈচিত্র্যকে ক্ষতিগ্রস্ত করে।
পরিবেশ আন্দোলনের দাবি:
কঠোর নজরদারি ও সচেতনতা জরুরি।
পঞ্চগড়ের পরিবেশ আন্দোলনের সভাপতি বলেন, “শুধু কাগজে নিষেধাজ্ঞা থাকলে চলবে না। প্রয়োগে প্রশাসনের কঠোরতা ও জনসচেতনতা বাড়াতে হবে। নিয়মিত অভিযান এবং পর্যবেক্ষণের মাধ্যমেই এই আগ্রাসী গাছের বিস্তার রোধ সম্ভব।”
দেশীয় প্রজাতির প্রতি জোর:
পরিবেশবিদ ও বন কর্মকর্তারা দেশীয় প্রজাতির গাছ যেমন জাম, কাঁঠাল, আমলকি, বহেড়া, অর্জুন, গামারি, মেহগনি ইত্যাদি ফলজ, বনজ ও ঔষধি গাছ রোপণে উৎসাহিত করার আহ্বান জানিয়েছেন। এসব গাছ পরিবেশবান্ধব হওয়ার পাশাপাশি কাঠ, ফল ও ওষুধের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ।
প্রশাসনের অবস্থান:
দেবীগঞ্জ উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. নাঈম মোর্শেদ বলেন, “বিভিন্ন দপ্তরের সমন্বিত উদ্যোগ ও জনগণের অংশগ্রহণের মাধ্যমে এই নিষেধাজ্ঞা বাস্তবায়ন সম্ভব।”
দিনাজপুর বন বিভাগের পঞ্চগড় শাখার সহকারী বন সংরক্ষক নূরুন্নাহার জানান, “বন বিভাগের আওতাধীন সকল নার্সারিতে ইউক্যালিপটাস ও আকাশমনি চারা উৎপাদন ও বিক্রয় বন্ধ করা হয়েছে।”
দেবীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. মাহমুদুল হাসান বলেন, “নিষিদ্ধ ঘোষিত ইউক্যালিপটাস ও আকাশমণি চারা উৎপাদন ও বিপণন রোধে জনসচেতনতা বাড়াতে হবে। প্রয়োজনে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
তিনি আরও বলেন, “ক্ষতিকর প্রভাব তুলে ধরে প্রচার-প্রচারণা জোরদার করতে হবে এবং পরিবেশবান্ধব ফলদ, বনজ ও ঔষধি গাছ রোপণে জনগণকে উৎসাহিত করতে হবে।”
সরকারি নিষেধাজ্ঞা জারি করেই দায়িত্ব শেষ নয়। বাস্তবিক প্রয়োগ, কঠোর নজরদারি এবং সর্বস্তরে সচেতনতা তৈরির মাধ্যমেই পঞ্চগড়সহ সারাদেশে ইউক্যালিপটাস ও আকাশমনি গাছের ক্ষতিকর প্রভাব রোধ করা সম্ভব। প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষায় জরুরি ভিত্তিতে দেশীয় প্রজাতির বৃক্ষরোপণ কার্যক্রম জোরদার এবং আগ্রাসী প্রজাতির বিরুদ্ধে কার্যকর অভিযান চালানোর আহ্বান জানান পরিবেশ সচেতন মহল।
Jahan