
ইউনিভার্সিটি অব ইনফরমেশন টেকনোলজি অ্যান্ড সায়েন্সেস (ইউআইটিএস) এর আইন বিভাগ 'বাংলাদেশে সংবিধান সংস্কার' শীর্ষক এক জনগুরুত্বপূর্ণ লেকচার সিরিজের আয়োজন করে। প্রধান বক্তা হিসেবে উপস্থিত ছিলেন খ্যাতনামা সংবিধান বিশেষজ্ঞ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অনুষদের অধ্যাপক, বাংলাদেশ সংবিধান সংস্কার কমিটির সদস্য, অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ একরামুল হক।
ইউআইটিএস আইন অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. এম. রবিউল হোসেন এর সভাপতিত্বে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ইউআইটিএস এর উপাচার্য অধ্যাপক ড. আবু হাসান ভূঁইয়া। দেশের বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অনুষদের শিক্ষকগণও এই লেকচার অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেন এবং এক প্রাণবন্ত একাডেমিক পরিবেশে তাদের মতবিনিময় করেন।
অধ্যাপক ড. একরামুল হক তাঁর বক্তব্যে বলেন, দেশের সংবিধানকে গণতন্ত্র, অন্তর্ভুক্তিমূলক শাসন ও ন্যায়বিচারের মূলনীতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ করে পুনর্গঠন করা সময়োপযোগী ও অত্যাবশ্যক। তিনি সংবিধান সংস্কার কমিশনের (Constitution Reform Commission) প্রস্তাবের প্রশংসা করে বলেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতা একটি জনযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত—এই বাস্তবতাকে সংবিধানের প্রস্তাবনায় (Preamble) প্রতিফলিত করা উচিত। তিনি মনে করেন, স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে (Proclamation of Independence) যে “সমতা, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার”-এর কথা বলা হয়েছে, সেগুলোকে সংবিধানের মূলনীতির অংশ হিসেবে প্রস্তাবনায় অন্তর্ভুক্ত করা বাঞ্ছনীয় ছিল।
নাগরিকত্ব সংক্রান্ত আলোচনায় অধ্যাপক হক বলেন, সংবিধানে “বাঙালি” শব্দের পরিবর্তে “বাংলাদেশি” শব্দ ব্যবহার করা উচিত, যাতে দেশের জাতিগত বৈচিত্র্যের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা হয়। তিনি সংবিধানের ৭(ক) ও ৭(খ) অনুচ্ছেদের বিষয়েও বক্তব্য রাখেন, যেখানে ৭(খ) ধারাটি ‘চিরস্থায়ী বিধান’ (eternity clause) হিসেবে সংযোজিত হয়েছে। অধ্যাপক হকের মতে, এটি একটি জীবন্ত সংবিধানের (living constitution) প্রগতিশীল চরিত্রের পরিপন্থী।
তিনি আরও বলেন, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অধিকারসমূহকে বাধ্যতামূলক ও কার্যকর মৌলিক অধিকার (binding fundamental rights) হিসেবে সংবিধানে সংযুক্ত করা প্রয়োজন, যাতে নাগরিকদের অধিকার সুরক্ষায় সাম্য প্রতিষ্ঠা সম্ভব হয়। তিনি মৌলিক অধিকারসমূহের ওপর যে কোনও সীমাবদ্ধতা আরোপের ক্ষেত্রে একটি একক ও অভিন্ন “অনুপাতিকতা পরীক্ষা” (proportionality test) প্রবর্তনের প্রস্তাব দেন, যা সেসব সীমাবদ্ধতার যৌক্তিকতা মূল্যায়নের মানদণ্ড নির্ধারণ করবে।
ভবিষ্যৎ প্রজন্মের অধিকার সংরক্ষণের লক্ষ্যে অধ্যাপক হক “প্রজন্ম ন্যায়বিচার” (intergenerational justice) প্রতিষ্ঠার অংশ হিসেবে একটি বিশেষ কমিশনার নিয়োগের প্রস্তাব দেন, যিনি শিশু ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের অধিকার রক্ষায় নিয়োজিত থাকবেন।
প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের অংশ হিসেবে তিনি দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভা (bicameral legislature) গঠনের প্রস্তাব করেন, যেখানে একটি সিনেট গঠিত হবে আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বের ভিত্তিতে। এটি শাসন ব্যবস্থায় ভারসাম্য ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করবে। পাশাপাশি তিনি বিরোধী দল ও স্বতন্ত্র রাজনীতিকদের অংশগ্রহণে ৯ সদস্যবিশিষ্ট একটি “জাতীয় সংবিধান পরিষদ” (National Constitutional Council - NCC) গঠনের আহ্বান জানান, যার মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ নিয়োগ ও কার্যাবলিতে স্বচ্ছতা নিশ্চিত হবে।
অধ্যাপক হক তাঁর বক্তব্যের শেষে সংবিধানের অষ্টম সংশোধনী মামলায় (8th Amendment Case) সুপ্রিম কোর্টের সংখ্যাগরিষ্ঠ রায়কে বর্তমান প্রেক্ষাপটে পুনঃমূল্যায়নের আহ্বান জানান এবং জোর দিয়ে বলেন, সংবিধানের প্রকৃত রচনাশক্তি (constituent power) জনগণের কাছেই নিহিত।
আঁখি