ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ০৮ জুন ২০২৫, ২৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

নদীর টানে ছুটছে জনতা: তিস্তা ব্যারাজে উপচে পড়া ভিড়

রিপন ইসলাম শেখ, নীলফামারী

প্রকাশিত: ১৯:৩০, ৮ জুন ২০২৫

নদীর টানে ছুটছে জনতা: তিস্তা ব্যারাজে উপচে পড়া ভিড়

নীলফামারীর ডিমলা ও লালমনিরহাটের হাতীবান্ধা উপজেলায় অবস্থিত তিস্তা ব্যারাজ এলাকাটি দিনদিন পর্যটকদের অন্যতম প্রিয় গন্তব্য হয়ে উঠছে। প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্য, নদীর জলের গর্জন, সূর্যাস্তের মনোমুগ্ধকর দৃশ্য আর স্থানীয় বাজারের প্রাণবন্ত পরিবেশ—সব মিলিয়ে পর্যটকদের জন্য এক অনন্য অভিজ্ঞতা দিচ্ছে এই তিস্তা ব্যারাজ। ঈদ ও অন্যান্য ছুটির দিনে তো বটেই, এখন সাপ্তাহিক ছুটিতেও হাজার হাজার মানুষ ভিড় করছেন এই অঞ্চলে।

তিস্তা নদীর ওপর নির্মিত এই ব্যারাজটি শুধুমাত্র জল নিয়ন্ত্রণ প্রকল্প হিসেবে নয়, এখন এটি উত্তরবঙ্গের অন্যতম পর্যটনকেন্দ্র হিসেবেও ব্যাপক জনপ্রিয়তা পাচ্ছে। বিশেষ করে ছুটির দিনে এখানে দেখা যায় দর্শনার্থীদের উপচে পড়া ভিড়। স্থানীয়দের ভাষ্য, প্রতিদিন গড়ে প্রায় ৪,০০০ থেকে ৫,০০০ মানুষ ভিড় করেন এই ব্যারাজে, আর ঈদ বা পূজার ছুটিতে সেই সংখ্যা ২০,০০০ ছাড়িয়ে যায়।

প্রায় ৭৫০ মিটার দীর্ঘ এই ব্যারাজের উপর দিয়ে হাঁটলে দুই পাশে তিস্তা নদীর বিশাল জলরাশি চোখে পড়ে। সকালের নরম রোদে বা বিকেলের সূর্যাস্তে এখানে দাঁড়িয়ে প্রকৃতি অবলোকনের যে অভিজ্ঞতা, তা বলে বোঝানো যায় না। অনেকেই বলেন, “এখানে আসলে মনে হয় যেন ছোটখাটো কক্সবাজারে দাঁড়িয়ে আছি।”

বিশেষ করে বিকেলের দিকে এখানকার পরিবেশ হয় প্রাণবন্ত। তরুণ-তরুণীরা দল বেঁধে আসেন, কেউ ঘুড়ি ওড়ান, কেউ নদীর পাড়ে বসে ছবি তোলেন, আবার কেউবা ফেসবুক লাইভে গিয়ে বন্ধুদের এই সৌন্দর্য দেখান।

জয়পুরহাট থেকে বেড়াতে আসা সফিকুল ইসলাম বলেন, “বন্ধুদের মুখে শুনেছিলাম তিস্তা ব্যারাজের কথা। এবার পরিবার নিয়ে এলাম। এমন প্রাকৃতিক দৃশ্য খুব একটা দেখা যায় না। এক কথায় অসাধারণ।”

রংপুর থেকে আসা কলেজছাত্রী শারমিন জাহান বলেন, “ফেসবুকে অনেক ছবিতে দেখেছিলাম এই জায়গাটা। এবার নিজের চোখে দেখলাম। জায়গাটা শুধু সুন্দরই না, খুব শান্তিও দেয়।”

পর্যটকদের এই আগমনে স্থানীয় ব্যবসাও চাঙা হয়ে উঠেছে। তিস্তা ব্যারাজের প্রবেশপথে গড়ে উঠেছে অস্থায়ী ফুড কোর্ট, চটপটি-ফুচকার দোকান, পানিপুরি, ঘুড়ির স্টল, এমনকি মোবাইল কভার ও সানগ্লাস বিক্রির দোকানও।

স্থানীয় ব্যবসায়ী হামিদুল ইসলাম বলেন, “কয়েক বছর আগেও এখানে কিছুই ছিল না। এখন প্রতিদিন ভালো বিক্রি হয়। ঈদের সময় তো আরও বেশি হয়। পর্যটকেরা আসেন, খাওয়াদাওয়া করেন, আমাদেরও উপার্জন হয়।”

তবে দর্শনার্থীর চাপ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাড়ছে কিছু সমস্যা। পর্যাপ্ত টয়লেট সুবিধার অভাব, যত্রতত্র ময়লা ফেলা, গাড়ি পার্কিংয়ের জায়গার সংকট এসবই কিছুটা হলেও দর্শনার্থীদের বিরক্ত করছে।

ডালিয়া পানি উন্নয়ন বোর্ড কর্তৃপক্ষ থেকে জানা গেছে, কয়েকটি উন্নয়ন প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। পার্কিং জোন, শৌচাগার, বিশ্রামাগার, ও ট্র্যাশ বিন বসানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। পর্যটন সুবিধা উন্নয়নের জন্য ইতিমধ্যে একটি মাস্টারপ্ল্যান তৈরির কথাও ভাবা হচ্ছে।

এত বড় জনসমাগমে নিরাপত্তা একটি বড় চ্যালেঞ্জ। দোয়ানী ফাড়ি ইনচার্জ মো. এরশাদুল হক জানান, “ছুটির দিনগুলোতে আমাদের অতিরিক্ত ফোর্স মোতায়েন করা হয়। মোবাইল টিমও কাজ করে। নিরাপত্তা নিশ্চিত করার চেষ্টা চলছে।” তবে ভিড়ের মধ্যে কখনো কখনো হারিয়ে যায় ছোট শিশুরা, বা ঘটে পকেটমারের ঘটনা। এ নিয়ে সবাইকে সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে।

ডালিয়া পানি উন্নয়ন বোর্ড এর নিবাহী প্রকৌশলী অমিতাভ চৌধুরী বলেন, “তিস্তা ব্যারাজ শুধু প্রকৌশল কাঠামো নয়, এটি একটি পর্যটন সম্ভাবনার কেন্দ্রবিন্দুতে রূপ নিচ্ছে। আমরা চাই একে ঘিরে একটি পূর্ণাঙ্গ পর্যটন এলাকা গড়ে উঠুক। এজন্য সরকারি ও বেসরকারি উভয় পর্যায়ে পরিকল্পনা হচ্ছে।”

বাংলাদেশ পর্যটন কর্পোরেশন ইতিমধ্যেই এই এলাকায় সম্ভাব্য রিসোর্ট বা ভিজিটর সেন্টার স্থাপনের জন্য প্রাথমিক জরিপ করেছে। কিছু দিন পর হয়তো এখানকার পর্যটন চেহারাই পাল্টে যাবে।

প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, নদীর বিশালতা আর প্রাণবন্ত মানুষের ভিড়—সব মিলিয়ে তিস্তা ব্যারাজ হয়ে উঠেছে এক নতুন সম্ভাবনার নাম। এটি শুধু বিনোদনের জায়গা নয়, বরং স্থানীয় অর্থনীতির চাকা ঘোরানোর এক শক্তিশালী মাধ্যমও। সঠিক পরিকল্পনা ও নজরদারির মাধ্যমে এই জায়গাকে আরও বেশি আকর্ষণীয় ও টেকসই করে গড়ে তোলা সম্ভব।

Jahan

×