ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ০৭ জুন ২০২৫, ২৪ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

‎ঘরে ফেরা নয়, যেন ন্যায্যতার যুদ্ধ: ঈদ ও দুর্ভোগের সমীকরণ

আব্দুল্লাহ্ খান, কনট্রিবিউটিং রিপোর্টার, ঢাকা 

প্রকাশিত: ২৩:৪৬, ৫ জুন ২০২৫

‎ঘরে ফেরা নয়, যেন ন্যায্যতার যুদ্ধ: ঈদ ও দুর্ভোগের সমীকরণ

‎পবিত্র ঈদ—একটি উৎসব, একটি আবেগ, ঘরে ফেরার অনিবার্য টান। কিন্তু বাংলাদেশের কোটি মানুষের জন্য এই ঘরে ফেরা শুধুই ভালোবাসার যাত্রা নয়, বরং এটি হয়ে দাঁড়ায় বছরের সবচেয়ে কঠিনতম পরীক্ষা। বাস, ট্রেন, লঞ্চ কিংবা ফেরিঘাট—যেখানেই চোখ ফেরানো যাক, সেখানে দেখা মেলে দীর্ঘ অপেক্ষা, অনিয়ম আর অসহায় যাত্রীদের ভিড়।

‎এই যাত্রা কেবল কয়েকশো কিলোমিটার পথ পাড়ি দেওয়ার গল্প নয়, বরং এটি আমাদের রাষ্ট্রীয় কাঠামোর ভিত নড়বড়ে হয়ে পড়ার এক জীবন্ত প্রমাণ। যেখানে সরকারি ঘোষণায় বলা হয় ‘নির্বিঘ্ন যাত্রার নিশ্চয়তা’, বাস্তবে সেখানে যাত্রাপথে খরচ হয় মনের শান্তি, শরীরের ক্লান্তি এবং পকেটের শেষ টাকা।

প্রতি ঈদে ফিরে আসে একই প্রশ্ন—ঘরে ফেরার এই মৌলিক অধিকার কি শুধুই দুর্নীতির ফাঁদে বন্দি থাকবে? ঈদের যাত্রা কি কখনোই হবে না স্বস্তির, নিরাপত্তার আর মর্যাদার?

পরিবহন খাতে অনিয়ম: ভাড়া বৃদ্ধির অজুহাত
‎ঈদ এলেই ঘরমুখো মানুষের ঢল নামে, আর সেই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে পরিবহন খাতে শুরু হয় চরম অনিয়ম। বিশেষ করে বাস মালিকরা সরকার নির্ধারিত ভাড়ার চেয়ে দ্বিগুণ বা তারও বেশি আদায় করে, যা সড়ক পরিবহন আইন অনুযায়ী দণ্ডনীয় হলেও বাস্তবে এর বিরুদ্ধে তেমন কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া হয় না।
‎‎বাস মালিকদের যুক্তি—ফাঁকা ফিরতি গাড়ি, জ্বালানি খরচ বা যানজট। কিন্তু বাস্তবে ঈদের মৌসুমকে তাঁরা এক ধরনের "বাণিজ্যিক উৎসবে" রূপ দেন। প্রশাসনের সীমিত অভিযান কিছু জরিমানা করলেও তা কোনো স্থায়ী সমাধান দেয় না।

‎রেলেও দেখা যায় টিকিটের কৃত্রিম সংকট। অনলাইনে টিকিট মুহূর্তেই 'সোল্ড আউট' হলেও, পরে তা কালোবাজারে পাওয়া যায় দ্বিগুণ দামে। স্টেশনসংলগ্ন চায়ের দোকানের আড়ালেও চলে এই চোরাবাজার। স্থানীয়রা বলছেন, "একটি প্রভাবশালী সিন্ডিকেট এই অনিয়মের সঙ্গে জড়িত, এবং রেল প্রশাসনের ভেতরে থাকা কিছু অসাধু চক্র এই ব্যবসায় সহযোগিতা করে"।
‎রেলের কর্মকর্তারা এর দায় এড়িয়ে যান কারিগরি সমস্যার কথা বলে, অথচ পর্দার আড়ালে থাকা কর্মচারী-ক্যাশিয়ার জড়িত সিন্ডিকেটের সঙ্গে—এ তথ্য নতুন নয়।

‎মূল সমস্যা হলো দুর্বল তদারকি, জবাবদিহির অভাব এবং প্রশাসনের ঢিলেঢালা মনোভাব। প্রতিবছরই এই অনিয়মের চিত্র দেখা যায়, অথচ স্থায়ী কোনো পরিবর্তন ঘটে না। মানুষ কষ্ট করে ঘরে ফিরলেও, ন্যায্য সেবা পাওয়ার অধিকার থেকে বঞ্চিতই থেকে যায়।

‎আইন থাকলেও নেই কার্যকর নজরদারি। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ), রেলওয়ে বা জেলা প্রশাসনের ভ্রাম্যমাণ আদালত ব্যবস্থা যদিও মাঝে মাঝে দেখা যায়, কিন্তু তা মূলত লোক দেখানো। কারণ যারা চক্রে জড়িত, তাদের অনেকেই রাজনৈতিক ছত্রচ্ছায়ায় অপারেট করে—যা ধরা পড়ে না, ধরাও পড়ে না।

‎‎যাত্রার অনিয়ম: পথেই জমে দূর্ভোগ 
‎‎ঢাকার গাবতলী, মহাখালী, সায়েদাবাদ, সদরঘাট কিংবা কমলাপুর—ঈদ এলে এসব টার্মিনালে যাত্রীদের উপচে পড়া ভিড়, দীর্ঘ অপেক্ষা আর ক্ষোভের কান্না যেন এক পরিচিত চিত্র হয়ে দাঁড়ায়। বাস নির্ধারিত সময়ে ছাড়ে না, আর ছাড়লেও গাদাগাদি করে তোলা হয় অতিরিক্ত যাত্রী। ৪০ আসনের বাসে উঠে পড়ে ৬০ থেকে ৭০ জন মানুষ। যাত্রীসেবা, নিরাপত্তা, স্বাস্থ্যবিধি—সব কিছু পেছনে পড়ে থাকে, এগিয়ে চলে শুধু মুনাফার নির্লজ্জ হিসাব।

‎ট্রেনের চিত্র আরও ভিন্ন, হয়তো আরও ভয়ংকর। ছাদে ওঠা যাত্রীর স্রোত যেন এখন স্বাভাবিক ঘটনা। ঈদযাত্রায় উত্তরাঞ্চলমুখী ট্রেনগুলোতে ছাদজুড়ে মানুষের ঝুঁকিপূর্ণ ভ্রমণের দৃশ্য ছিল নিত্যনৈমিত্তিক। তবুও রেল মন্ত্রণালয়ের বক্তব্য—‘সবকিছু নিয়ন্ত্রণে আছে’। অথচ বাস্তবতা বলে ভিন্ন কথা।

‎সরকারি পরিবহন সংস্থা বিআরটিসিও তার দায়িত্ব পালন করতে ব্যর্থ। যেখানে দরিদ্র ও সাধারণ মানুষের নির্ভরতার প্রতীক হওয়ার কথা, সেখানে দেখা যায় বাস পাওয়া যায় না ঠিক সময়ে। বহরে পর্যাপ্ত বাস নেই। কিছু বাস আবার অচল হয়ে পড়ে থাকতে দেখা যায়।
‎অন্যদিকে, লঞ্চ ও ফেরিঘাটের দুরবস্থাও কম নয়। সদরঘাট থেকে ভোলা বা বরিশালগামী লঞ্চে অতিরিক্ত যাত্রী ওঠানো যেন নিয়মে পরিণত হয়েছে। তার চেয়েও বড় সমস্যা ঘাট ব্যবস্থাপনায়। কোনো শৃঙ্খলা নেই, নেই পর্যাপ্ত আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, আর সড়ক ও নৌ প্রশাসনের মধ্যে নেই প্রয়োজনীয় সমন্বয়। এর খেসারত দিতে হচ্ছে সাধারণ মানুষকে—জীবনের ঝুঁকি নিয়েই তারা ঘরে ফিরছে। কেউ কেউ তো লঞ্চে ওঠার সময় নদীতে পড়ে গিয়ে প্রাণ হারাতে হারাতে রক্ষা পেয়েছে।

‎সরকারি প্রস্তুতির ঘাটতি: ব্যর্থ প্রশাসনের গল্প
‎‎প্রতি বছরই ঈদের আগে সরকারের নানা দপ্তর ঘটা করে ঘোষণা দেয়—“নির্বিঘ্ন যাত্রা নিশ্চিতে সব প্রস্তুতি সম্পন্ন।” ২০২৫ সালেও সেই প্রচারণার ব্যতিক্রম হয়নি। কিন্তু বাস্তবের চিত্র ছিল ঠিক তার উল্টো। যাত্রীসাধারণের জন্য নেওয়া প্রস্তুতির বেশিরভাগই থেকে গেছে কাগজে-কলমে, মাঠপর্যায়ে তার প্রতিফলন মেলেনি।

‎ঈদের যাত্রা ব্যবস্থাপনায় পাঁচটি প্রধান সংস্থার দায়িত্ব থাকে—সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়, রেল মন্ত্রণালয়, নৌপরিবহন অধিদপ্তর, বিআরটিএ এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, বিশেষ করে পুলিশ ও হাইওয়ে পুলিশ। কিন্তু এই সংস্থাগুলোর মধ্যে কার্যকর কোনো সমন্বয় দেখা যায়নি। কেউ কাউকে দায়িত্ব জিজ্ঞেস করে না, দায় এড়ানো যেন স্বাভাবিক প্রক্রিয়া।

সড়কে পুলিশ থাকলেও অধিকাংশ সময় তারা যানবাহন তল্লাশিতে আন্তরিক নয়। রেলের টিকিট কালোবাজারি রোধে চোখে পড়ার মতো কোনো পদক্ষেপ নেয়নি রেল কর্তৃপক্ষ। আর বিআরটিএর তৎপরতা—তা সীমাবদ্ধ থেকেছে কেবল সংবাদ সম্মেলন আর কিছু আনুষ্ঠানিক পরিদর্শনের গণ্ডিতে। বাস্তবে অতিরিক্ত ভাড়া আদায়, অচল বাস, লাইসেন্সবিহীন চালক—সবই চলেছে নির্বিঘ্নে।

‎বরিশালগামী যাত্রী সানজিদা ইসলাম বলেন, “ঈদের যাত্রা শুধু ব্যক্তিগত ভ্রমণ নয়, এটি আসলে দেশের অভ্যন্তরীণ শাসন ও ব্যবস্থাপনার এক প্রতিফলন।” যদি প্রযুক্তির সহায়তায় টিকিট কালোবাজারি ঠেকানো না যায়, যদি রাষ্ট্রীয় পরিবহন ব্যবস্থায় ন্যূনতম সুশাসন না আসে, আর যদি আইন থাকলেও প্রয়োগ না হয়—তবে এই যাত্রার দুর্ভোগ শুধু চলবেই না, বরং তা একসময় জাতীয় অপদার্থতার প্রতীক হয়ে উঠবে।

‎‎সাধারণ মানুষের কাঁধে ঈদের খরচ: অর্থনৈতিক চাপে বিষন্নতা 

‎‎ঈদ মানেই আনন্দের সময়, ঘরে ফেরার উত্তেজনা, প্রিয়জনের সঙ্গে কিছু মুহূর্ত কাটানোর আশায় অপেক্ষা। কিন্তু সেই আনন্দযাত্রা যদি পরিণত হয় অনিশ্চয়তা আর দুর্ভোগের এক যন্ত্রণাময় অভিজ্ঞতায়, তখন তার সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে অর্থনৈতিক চাপের করাল ছায়া।

‎ঢাকা থেকে খুলনা, রাজশাহী কিংবা বরিশাল—যেকোনো গন্তব্যে যেতে ঈদের সময় যাত্রীদের খরচ হয় স্বাভাবিকের দ্বিগুণ বা তিনগুণ। শুধু অতিরিক্ত ভাড়া নয়, দীর্ঘ সময় ধরে যানজটে আটকে থাকা, মানসিক দুশ্চিন্তা, এবং অনিশ্চয়তায় ঘেরা যাত্রাও এক ধরনের আর্থিক ক্ষতির রূপ নেয়। সময়ের অপচয়, স্বাস্থ্যঝুঁকি, এমনকি পরিবারের অন্যদের সঙ্গে পরিকল্পিত সময় কাটাতে না পারার ক্ষতি হিসাবের বাইরে থাকলেও, প্রভাব পড়ে গভীরভাবে।

‎এর পাশাপাশি বড় শহরের নিম্নআয়ের মানুষদের জন্য ঈদের সময়টা আরেকভাবে কঠিন। অনেকে আগে ভাগেই শহর ছেড়ে যান, ফলে গৃহকর্মী, রিকশাচালক কিংবা নির্মাণশ্রমিকদের আয় বন্ধ হয়ে যায়। যারা গ্রামে ফেরেন, তাদের জন্য টিকিটের মূল্য তো আছেই, সঙ্গে যোগ হয় খাবার খরচ, যাত্রাকালে কাজ হারানোর সুযোগ খরচ এবং গ্রামে আত্মীয়দের সামনে সম্মান বজায় রাখার চাপ—সব মিলিয়ে ঈদ হয়ে ওঠে বোঝা।

‎মধ্যবিত্তের অবস্থা আরও জটিল। হাতে অতিরিক্ত টাকা নেই, তবুও সামাজিক মর্যাদা ধরে রাখতে গ্রামে ফেরা, কেনাকাটা, উপহার দেওয়া সবই একরকম বাধ্যতামূলক হয়ে দাঁড়ায়। ঈদের যাত্রার বাড়তি খরচ এই শ্রেণিকে ফেলে এক কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি, যেখানে তারা না পারছে খরচ এড়াতে, না পারছে সেটা সহজে বহন করতে।

‎ঈদের যাত্রা কখনোই শুধু কয়েক ঘণ্টার রাস্তা পাড়ি দেওয়ার ঘটনা নয়। এটি যুক্ত থাকে হাজারো মানুষের জীবনের স্বপ্ন, আত্মমর্যাদা, পারিবারিক ভালোবাসা আর অর্থনৈতিক সংগ্রামের সঙ্গে। কেউ নিজের অসুস্থ মায়ের পাশে থাকতে চান, কেউ সন্তানদের সঙ্গে ঈদের নামাজ পড়ার আশায় ছুটে চলেন, কেউবা শুধুই গ্রামবাংলার আকাশের নিচে কিছুটা প্রশান্তি খোঁজেন।

‎কিন্তু যে রাষ্ট্র তার নাগরিকদের এই মৌলিক আনন্দযাত্রায় নিরাপত্তা, শৃঙ্খলা কিংবা সম্মানজনক সেবা নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হয়, সেই রাষ্ট্রের উন্নয়নের পরিসংখ্যান কাগজে যতই বড় হোক, মানুষের হৃদয়ে তা হয়ে ওঠে একটি বড় প্রশ্নবোধক চিহ্ন।

‎প্রতিবছর এই একই অনিয়ম, অব্যবস্থা আর অবহেলার চিত্র ফিরে আসে—যেন এটি একটি নিষ্ঠুর ‘ঈদ রুটিন’। অথচ পরিবর্তন সম্ভব, যদি থাকে সদিচ্ছা, জবাবদিহি আর বাস্তবভিত্তিক পরিকল্পনা।

রাজু

×