
ছবি: দৈনিক জনকন্ঠ।
কোরবানির ঈদের দিন যতই ঘনিয়ে আসছে ঠাকুরগাঁও জেলার হাট বাজারগুলোতে ততই বাড়ছে কোরবানির পশু কেনাবেচার ব্যস্ততা। তবে হাটে দেখা দিয়েছে এক ধরনের বৈপরীত্য। ক্রেতারা কিছুটা কম দামে গরু কিনে খুশি হলেও, বিক্রেতা ও খামারিরা বলছেন, গরু পালনের খরচ তোলা তো দূরের কথা, অনেক ক্ষেত্রে লোকসান গুনতে হচ্ছে।
জেলার সদর, হরিপুর, বালিয়াডাঙ্গী, পীরগঞ্জ ও রাণীশংকৈল উপজেলার গরুর হাটগুলো ঘুরে দেখা গেছে, এবার দেশি গরুর সরবরাহ ভালো। অনেক খামারই তাদের খামারের গরু নিয়ে হাটে আসছেন বিক্রির আশায়। কিন্তু ক্রেতারা গরুর প্রত্যাশিত দাম না বলায় তারা পড়ছেন বিপাকে।
খামারিরা কয়েক মাস আগে থেকেই গরু প্রস্তুত করেছেন কোরবানির জন্য। কিন্তু বাজারে অন্যান্য ফসল আলু, মরিচের ধাম কমে যাওয়ায় ও চাহিদার তুলনায় পশু বেশি হওয়ায় এবং দক্ষিণাঞ্চলের ব্যবসায়ী এবং পাইকারদের উপস্থিতি কম থাকায় গরুর দাম কম বলে মনে করছেন অনেকে।
স্থানীয় দুলাল ও জাহাঙ্গীর আলম নামে স্থানীয় দুই খামারি বলেন, “একটি গরু বড় করতে আট-দশ মাস সময় লেগে যায়। খাবার, ঔষধ, পরিচর্যা সব মিলিয়ে অনেক খরচ হয়। এখন হাটে এসে দেখছি ক্রেতারা যে দাম বলছেন তাতে খরচই ওঠে না। গত বছরের তুলনায় এবার গরু প্রতি ১০-২০ হাজার টাকা ও প্রতি ছাগলে ৩-৫ হাজার টাকা কম বলছেন। এবার গরু লালন পালন করে অনেক লস।”
এছাড়াও হাটে কাঁদা-পানি জমে থাকা ও অব্যবস্থাপনা সহ অতিরিক্ত টোল আদায় করা হচ্ছে বলে অভিযোগ করেন ক্রেতা-বিক্রেতা ও ব্যবসায়ীরা।
পুরাতন ঠাকুরগাঁও এলাকার গরু বিক্রেতা সারোয়াার বলেন, “এবার অনেক মানুষের হাতে টাকা নাই। কারণ আলু ও মরিচ চাষীরা দাম কম পাওয়ায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তাই এবার গরুর দাম নেই। গতবার তিন মণ ওজনের যে গরু বিক্রি করেছি ৮০-৯০ হাজার এবার ওই গরু বিক্রি করলাম ৭০ হাজার টাকায়।”
অন্যদিকে, অনেক সাধারণ ক্রেতা ও অন্য জেলা থেকে আগত ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, অন্যান্য বছরের থেকে এবার হাটে-বাজারে গরুর দাম তুলনামূলকভাবে কম ও সহনীয়। এ দামে পশু ক্রয় করতে পেরে খুশি তাঁরা।
ঠাকুরগাঁও রোড মথুরাপুর এলাকার বাসিন্দা মো. ইসরাক বলেন, “গত বছরের তুলনায় এবার গরুর দাম কিছুটা কম।” রোড এলাকার আব্দুস সোবহান সদর উপজেলার বড় খোঁচাবাড়ি পশুর হাটে ছেলেকে নিয়ে গরু নিতে এসেছিলেন। তিনি বলেন, “ বাজারে যদিও দালালের দৌরাত্ম্য বেশি সরাসরি মূল মালিকের কাছ থেকে গরু কেনা কষ্টকর তারপরেও অন্যান্য বারের তুলনায় আমার কাছে মনে হয়েছে বাজার কম। যে বাজেট নিয়ে এসেছিলাম সেই অনুযায়ী গরু নিতে পেরেছি। গত বছর যে গরু ১ লাখ ও ৯০ হাজার টাকা দাম ছিল সেই গরু এবার ৭০-৭৫ হাজার টাকায় পাওয়া যাচ্ছে। তিনি এবার ৬৯ হাজার ৫শ’ টাকায় গরুটি নিয়েছেন। সেটির মাংস একশত কেজি হবে বলেছেন গরু বিক্রেতা। তাঁর ধারণা ৯০-৯৫ কেজি মাংস হতে পারে। এতে তিনি খুশি। ”
চট্টগ্রাম হালীশহর থেকে আসা নূর ইসলাম নামে গরুর এক ব্যবসায়ী বলেন, “তিনি প্রতিবছর ঠাকুরগাঁওয়ের কয়েকটি হাট থেকে কোরবানির গরু কেনেন। এবারও এসেছেন । তবে অন্যান্য বারের তুলনায় এবার সহনীয় দামে গরু কিনতে পারছেন। বলা যায় এবার এদিকে গরুর দাম কিছুটা কম।”
গরুর স্থানীয় ব্যবসায়ী জবাইদুল ইসলাম বড় খোচাবাড়ি হাটে এসে বলেন, “এই হাটে কাঁদা-পানি জমে থাকে। ঠিকভাবে হাঁটাহাঁটি করা যায় না। এছাড়াও অতিরিক্ত টোল আদায় করা হচ্ছে। এতে এক গাড়ি গরু নিতে শুধু টোল খরচ ১২-১৩ হাজার টাকা লাগছে। এভাবে বাজারে ব্যবসায়ী আসতে চায়? তাই তো বাজারে ক্রেতা কম।” তার মতো আরও অনেক ব্যবসায়ী জেলার বিভিন্ন হাটের অব্যবস্থাপনাসহ অতিরিক্ত টোল আদায় করার অভিযোগ করেন।
জাকির হোসেন নামে গরুর অপর এক ব্যবসায়ী বলেন, “ এবার এইদিকের বাজার গুলিতে ভারতীয় গরু নেই কিন্তু তার পরেও দেশি গরুর দাম কম। ক্রেতা নেই। বাজার গুলিতে প্রচুর পরিমাণে গরু আমদানি হয়েছে সেই তুলনায় অন্য জেলার ব্যবসায়ী ও কেনার লোক নেই। এবার আড়াই থেকে তিন মণের গরুতে ১০ হাজার টাকা কম ও ৫-৬ মণ ওজনের গরুতে প্রায় ২০-২৫ হাজার টাকা দাম কম। বর্তমানে আরও তো গ্রামের তেমন গরু বাজারে এখনো উঠেনি। বিভিন্ন গ্রামের গরু গুলো বাজারে আনা শুরু করলে দাম আরও কমে যাবে। এবার ব্যবসায়ীদের লসের পাল্লা ভারী।”
আল-আমিন ও মজিবর রহমান নামে ছাগল বিক্রেতা বলেন, “ছাগলের দাম চাই ৮ হাজার দাম বলে ৪-৫ হাজার। গত বছর যে ছাগলের দাম ছিল ১০ হাজার সেই ছাগল এবার ৭-৮ হাজার টাকা। গত বছর ছাগলের প্রতি কেজি মাংস ১ হাজার থেকে ১১শ’ টাকা অনুযায়ী বিক্রি হয়েছিল। এবার ৮শ’ টাকাতেও বিক্রি হচ্ছে না।”
আগামী কয়েক দিনে বাজারে পশুর দাম বাড়ার সম্ভাবনার কথা জানতে চাইলে অনেক ব্যবসায়ী জানান বর্তমান আবহাওয়া ও সার্বিক অবস্থায় এবার মনে হয় না আর দাম বাড়বে বরং দাম আরও কমতে পারে বলেও জানান তারা।
হাটে অতিরিক্ত টোল আদায়ের কথা অস্বীকার করে বড় খোচাবাড়ি হাটের ইজারাদার রবিউল ইসলাম টিপুসহ অন্যান্য হাটের ইজারাদারা জানান, রাস্তায় গরু বহনকারী ট্রাক ছিনতাই ও বাস ডাকাতির কারণে এবার বাইরের জেলা থেকে তেমন পাইকাররা আসছেন না। এ কারণে এবার গরুর কিছুটা দাম কম। এছাড়াও অন্যান্যবার যেখানে কোরবানির প্রতি হাটে প্রায় দুই থেকে আড়াই হাজার পশু কেনা বেচা হতো এবার ১ হাজারও হচ্ছে না।
এবার প্রচুর সংখ্যক খামারি আগে থেকেই প্রস্তুতি নিয়েছিলেন গরু পালনের, কিন্তু ক্রয় ক্ষমতা হ্রাস, মধ্যবিত্তদের বাজেট কমে যাওয়ার পাশাপাশি অনলাইন প্ল্যাটফর্ম গুলো থেকেও ক্রয় বেড়ে যাওয়ায় স্থানীয় হাটগুলোতে তেমন ক্রেতা নেই বলেও জানান অনেকেই।
জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তার দেওয়া তথ্যমতে ঠাকুরগাঁও জেলায় এবার কোরবানির পশুর চাহিদা রয়েছে ৭৫ হাজার। সে জায়গায় পশু লালনপালন করে প্রস্তুত করা হয়েছে প্রায় ৯১ হাজার। যা চাহিদার তুলনায় প্রায় ১৬ হাজার পশু বেশি রয়েছে।
জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডাঃ ইজহার আহমেদ খান বলেন, বর্তমানে গরুর দাম কম হলেও পাইকারের সংখ্যা বাড়লে পশুর দাম বাড়ার সম্ভবনা রয়েছে ও গরুর স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য জেলার প্রতিটি হাটে ভেটেরিনারি টিম মোতায়েন করা হয়েছে ও গরুর স্বাস্থ্য পরীক্ষার পাশাপাশি ক্রেতা-বিক্রেতাদের সচেতন করা হচ্ছে বলে জানান।
সদর উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা মো: খাইরুল ইসলাম হাটে জাল টাকার নোট শনাক্ত করার ব্যবস্থা, অতিরিক্ত টোল আদায় রোধ, হাট ব্যবস্থাপনা ও নিরাপত্তা নিশ্চিতে সব ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, পশুর হাটে নির্ধারিত ফি থেকে যেন বেশি টোল আদায় করা না হয় সেজন্য জেলার ৪০টি হাটের ইজারাদারকে নির্দেশ দেওয়া আছে। এছাড়াও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটগণ বাজার মনিটরিং করছেন কোথাও কোনো ব্যত্যয় হলে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে।
এছাড়াও সড়কে ছিনতাই ও ডাকাতি রোধে ইতিমধ্যে জেলা প্রশাসক সংশ্লিষ্টদের নির্দেশনা দিয়েছেন। মহাসড়কে হাইওয়ে পুলিশের তৎপরতা জোড়দার করা হয়েছে। এছাড়াও হাটগুলো উন্নয়নের বিষয়ে আমরা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও ঠিকাদারদের সাথে আলোচনা করে আগামী অর্থবছরে উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে বলেও জানান তিনি।
মিরাজ খান