ঢাকা, বাংলাদেশ   সোমবার ০২ জুন ২০২৫, ১৯ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

মিডফোর্ড ঘাট ও পুরান ঢাকার নদীবাণিজ্যের শতবর্ষী ইতিহাস

সালাহউদ্দিন সালমান, কন্ট্রিবিউটিং রিপোর্টার, সিরাজদিখান, মুন্সীগঞ্জ

প্রকাশিত: ২০:০৭, ৩১ মে ২০২৫

মিডফোর্ড ঘাট ও পুরান ঢাকার নদীবাণিজ্যের শতবর্ষী ইতিহাস

বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে দাঁড়িয়ে থাকা মিডফোর্ড ঘাট শুধু একটি যাত্রীঘাট নয়, এটি পুরান ঢাকার নদীনির্ভর জীবনের শতবর্ষী সাক্ষ্য। শতবর্ষ পেরিয়ে আসা এই ঘাট এখনও প্রতিদিন হাজারো যাত্রী ও পণ্য বহনের দায়িত্ব পালন করছে।দিনরাত এই ঘাটে মাঝি-মাল্লাদের হাকডাকে নদীর কূলে ওঠে বাঁচার ছন্দ। নদীপথেই ঢাকার সঙ্গে সংযুক্ত হচ্ছে দক্ষিণাঞ্চলের জনজীবন।


১৮৫৮ সালে প্রতিষ্ঠিত মিডফোর্ড হাসপাতালের নামানুসারে এই ঘাটটির নামকরণ। ব্রিটিশ গভর্নর লর্ড মিডফোর্ড-এর নামেই হাসপাতাল এবং পরবর্তীতে ঘাটের নাম রাখা হয়। সেই সময় চিকিৎসা সামগ্রী, রোগী পরিবহন এবং ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে ঘাটটি ব্যবহৃত হতো।ইসলামপুর, সদরঘাট, চকবাজারসহ আশপাশের ব্যবসায়ীরা পালতোলা নৌকা ও স্টিমারে করে পণ্য আনতেন এই ঘাট দিয়ে। সময়ের ব্যবধানে স্টিমারের জায়গা নিয়েছে ইঞ্জিনচালিত ট্রলার ও ডিঙ্গি নৌকা।

আজও এই ঘাট দিয়ে প্রতিদিন গড়ে ৫,০০০ থেকে ৭,০০০ যাত্রী যাতায়াত করেন। উৎসব ও বর্ষার মৌসুমে এই সংখ্যা বেড়ে ১০,০০০ ছাড়িয়ে যায়।কেরানীগঞ্জ, জিনজিরা, নবাবগঞ্জ ও বসিলা থেকে যাত্রীরা এই ঘাট দিয়ে ঢাকায় প্রবেশ করেন। আবার ঢাকার স্কুল, কলেজ, কারখানা ও বাজারমুখী বহু মানুষও এই পথ বেছে নেন যাতায়াতের জন্য।


ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের (ডিএমসি) নিকটবর্তী হওয়ায় শরীয়তপুর, মাদারীপুর, মুন্সীগঞ্জ, বরিশাল, চাঁদপুরসহ দক্ষিণবঙ্গের রোগীরাও এই ঘাটের উপর নির্ভরশীল।নিত্য প্রয়োজনীয় চাল-ডাল, মাছ, সবজি ও ফলমূলও নদীপথে প্রতিদিন এই ঘাট দিয়ে রাজধানীতে প্রবেশ করে। নদীপথে যাতায়াত তুলনামূলকভাবে সাশ্রয়ী। যানজটপূর্ণ সড়কপথের বিপরীতে ট্রলারভাড়া কম এবং সময়ও লাগে অনেক কম। ফলে নিম্ন ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষের কাছে এটি এক কার্যকর ও নির্ভরযোগ্য সমাধান।

অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হলেও মিডফোর্ড ঘাটে নেই ছাউনিযুক্ত প্রতীক্ষালয় বা আধুনিক র‌্যাম্প। নদীতে পড়ে থাকে নিয়মিত বর্জ্য ও আবর্জনা। ঘাট ঘিরে গড়ে উঠেছে অস্থায়ী দোকানপাট। সন্ধ্যার পর অন্ধকারে ছিনতাইয়ের অভিযোগও রয়েছে।


৩০ বছর ধরে এই ঘাটে নৌকা চালানো মাঝি আব্দুল মান্নান বলেন,“আগে দিনে ৮-১০টা ট্রিপ দিতাম, এখন ২০-২৫ টা দেই। লোকজন আগের চেয়ে অনেক বেশি। কিন্তু ঘাটের অবস্থা সেই আগের মতোই। একটু শেড দিলে মানুষ রোদ-বৃষ্টিতে কষ্ট পেত না।”


সরকারি বা সিটি কর্পোরেশন উদ্যোগে মিডফোর্ড ঘাটে আধুনিক অবকাঠামো, নিরাপত্তা ব্যবস্থা ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন হলে পুরান ঢাকার এই ঐতিহ্যবাহী ঘাট নতুনভাবে শহরের প্রাণ হয়ে উঠতে পারে।


মিডফোর্ড ঘাট কেবল একটি নদীঘাট নয়, এটি পুরান ঢাকার জনজীবনের অঙ্গ, সময়ের সাক্ষ্য, এবং হাজারো শ্রমজীবী মানুষের প্রতিদিনকার ভরসা। এই ঘাটের উন্নয়ন মানেই নদীপথকেন্দ্রিক একটি পুরনো শহরের নবজাগরণ।

আঁখি

×