ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৬ মে ২০২৫, ১ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

উলিপুরে বীর মুক্তিযোদ্ধার স্ত্রী’র দিন কাটে ভিক্ষা করে

জাহিদুল ইসলাম জাহিদ, উলিপুর, কুড়িগ্রাম।

প্রকাশিত: ১৮:৫৭, ১৫ মে ২০২৫

উলিপুরে বীর মুক্তিযোদ্ধার স্ত্রী’র দিন কাটে ভিক্ষা করে

কুড়িগ্রামের উলিপুরে স্বাধীনতার ৫৫ বছর পরেও ‘৭১ এর বীর মুক্তিযোদ্ধার স্ত্রীর দিন কাটে ভিক্ষা করে। আওয়ামী দুঃশাসনের কারনেই ভারতীয় তালিকার ৩৯৭০৩ নম্বরের মৃত মফিজুল মুক্তিযোদ্ধার একমাত্র ছেলে ঠেলাগাড়ি চালক নিরক্ষর আব্দুল জব্বার ভিক্ষুক মা জোবেদার জন্য মুক্তিযোদ্ধার ভাতা চালু করতে পারেনি কোন ভাবেই।

অন্যদিকে, একই নামধারী সরকারি এক চাকুরিজীবীর বিরুদ্ধে মৃত ওই মুক্তিযোদ্ধার ভারতীয় তালিকার নম্বর ব্যবহার করে ভাতা ভোগের অভিযোগ। একাধিকবার দাবি নিয়ে প্রশাসন ও মুক্তিযোদ্ধাদের দ্বারে দ্বারে ঘুরলেও পাত্তা দেয়নি কেউ মুক্তিযোদ্ধার ছেলে আব্দুল জব্বারকে।

অভিযোগ সূত্রে জানা গেছে, ২০২৪ এর ৫ আগষ্টের অভ্যুত্থানে পরিবর্তনের পর মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয় ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা বাতিলের উদ্যোগ নেয়ায়, সম্প্রতি জেলা প্রশাসক বরাবর আবেদন করেছে মৃত ওই মুক্তিযোদ্ধার একমাত্র ছেলে নিরক্ষর ঠেলাগাড়ী চালক আঃ জব্বার। ভাতাভোগীর ভাতা বাতিল করে জব্বারের মায়ের নামে ভাতা চালু করে দিতে জব্বারের কাছে ২ লাখ টাকা খরচ হবে বলে দাবি করেছিল জনৈক এক মুক্তিযোদ্ধা।

করোনার সময় ভিক্ষুক মায়ের ফিতরা আদায় ও ভিক্ষা মিলে জমিয়ে একত্রে ৮ হাজার টাকাও দিয়েছিল জব্বার। চুক্তি হয়েছিল, কাজ করে দিলে আরো ৪০ হাজার টাকা সংগ্রহ করে দিবে সে। কাজ হবে বলে আশাও দিয়েছিল কিন্তু সেই আশার মুখেও ছাই পড়েছে। জব্বারের অভিযোগ, চাহিদামত টাকার যোগান দিতে না পারায় আমার বাবার নামের ভাতা মা জোবেদার নামে চালু করে দেয়নি। মুক্তিযোদ্ধার নিকট দেয়া ৮ হাজার টাকা ফেরতের জন্য বহুবার চেষ্টা করে আজও টাকা ফেরত পায়নি সে।

মৃত মুক্তিযোদ্ধার ছেলে আব্দুল জব্বার জানায়, ঠেলাগাড়ি চালিয়ে আমার সন্তানদের নিয়ে দিন কাটে খেয়ে না খেয়ে, তাই মা আমার আজও বাড়ি বাড়ি গিয়ে ভিক্ষা করে জীবন বাঁচায়। বাবার সহযোদ্ধাসহ অনেকের মুখে শুনেছি, বাবার নামের সাথে মিল থাকায় অন্য ইউনিয়নের এক সরকারি চাকুরিজীবি অনেক টাকা খরচ করে ভাতা চালু করে নিয়েছে। ২০২৩ সালের জুনে জেলা প্রশাসকের স্বরনাপন্ন হয়ে ভাতার জন্য আবেদন করে আবারো আশার আলো দেখেছিল জব্বার। কিন্তু সেই আবেদন তৎকালীন জেলা প্রশাসক উপজেলা নির্বাহী অফিসারকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহনের জন্য পাঠালেও উপজেলা সমাজ সেবা দপ্তর ওই আদেশ আমলে নিলেও প্রতারিত করেছে জব্বারকে।

কারণ ভারতীয় তালিকায় স্পষ্ট উল্লেখ করা হাতিয়া ইউনিয়নের অনন্তপুর গ্রামের মফিজুল ইসলামের ক্রমিক নং-৩৯৭০৩ নম্বরটি ব্যবহার করেই ভাতা ভোগ করছেন, দলদলিয়া ইউনিয়নের আর এক মফিজুল ইসলাম। তিনি বর্তমানে অবসরে যাওয়া একজন উপ-সহকারি কৃষি কর্মকর্তা। উপজেলার উত্তর দলদলিয়া ইউনিয়নের কুটিপাড়া গ্রামে তার বাড়ি।

আব্দুল জব্বার আরো জানায়, আমার বাবার বাড়ি উপজেলার হাতিয়া ইউনিয়নের অনন্তপুর গ্রামে ছিল। ‘৭১ এর যুদ্ধের সময় আমার বাবা দেশ স্বাধীন করতে ভারতে গিয়ে ট্রেনিং নেয়। ভারতের মুজিব ক্যাম্পে ট্রেনিং নিতে যাদের সংগে আমার বাবা ছিল, তাদের মধ্যে ৪ জন বীর মুক্তিযোদ্ধা এখনো বেঁচে আছেন। সেই বীর মুক্তিযোদ্ধারা স্বাক্ষি দিলেও আমার বাবার নামে মুক্তিযোদ্ধার ভাতা চালু করেনি সমাজ সেবা অফিস। সঠিক তদন্তের মাধ্যমে ভূয়া মুক্তিযোদ্ধার ভাতা বাতিল করে ভারতীয় তালিকায় থাকা তার বাবার নামে ভাতা চালু করার আকুতি জানিয়েছেন জব্বার।

ভাতাভোগী মফিজুল ইসলামের সাথে কথা হলে তিনি জানান, আমি ২০১০ সাল থেকে ভাতা ভোগ করে আসছি । ২০২৩ সালে মুক্তিযোদ্ধার স্ত্রীর দাবিদার জোবেদা বেগম নামের একজন আমাকে ভুয়া প্রমাণ করতে আবেদন করেছিল কিন্তু সমাজ সেবা কর্মকর্তার তদন্তে উত্তর দলদলিয়া এলাকায় তাঁকে খুঁজে পাওয়া যায়নি। তাই আমি সঠিক মুক্তিযোদ্ধা বলে সমাজসেবা কর্মকর্তা প্রতিবেদন দিয়েছে।

সরেজমিনে উপজেলার পান্ডুল ইউনিয়নের বিভিন্ন এলাকার ৪ জন বীর মুক্তিযোদ্ধার সাথে কথা হলে তারা বলেন, হাতিয়া অনন্তপুরের মফিজুল ইসলামসহ আমরা ভারতের মুজিব ক্যাম্পে একসাথে প্রশিক্ষন নিয়েছি। প্রশিক্ষন শেষে সে অন্য গ্রুপের সাথে কোথায় যে যুদ্ধে যায়? তা আমরা জানি না। তাদের একজনের সাথে মফিজুল ইসলামের শেষ দেখা হয়েছিল নীলফামারিতে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর সে আর কখনোই বাড়ি ফিরে আসেনি। একসাথে ট্রেনিং নেয়া মুক্তিযোদ্ধাদের সকলেরই ধারনা মফিজুল যুদ্ধের পরই কোন না কোন ভাবেই মারা যায়। তাই সে আর পরিবারের কাছে ফিরে আসেনি। 


সাক্ষাতকার দেয়া বীর মুক্তিযোদ্ধারা হলেন, মোঃ আব্দুল বাতেন সরকার, (ভারতীয় তালিকা নং ৩৯৬৮১), নুর মোহাম্মদ, (ভারতীয় তালিকা নং ৩৯৬৮২), মোঃ রবিউল ইসলাম, (পরিচিতি নং ০১৪৯০০০১৭৯৯), শ্রী সুবল চন্দ্র রায়, ভারতীয় তালিকা নং ৩৯৪৭৯। সকলেরই বাড়ি উপজেলার পান্ডুল ইউনিয়নে। সাক্ষাতকার দেয়া মুক্তিযোদ্ধাদের দাবি, সঠিক তদন্ত হলেই আসল মুক্তিযোদ্ধার বিষয়টি বেড়িয়ে আসবে।

উলিপুর উপজেলা সমাজসেবা অফিসার লুৎফর রহমান স্বাক্ষরিত প্রতিবেদনে দেখা যায়, জোবেদা বেগমের ঠিকানা উত্তর দলদলিয়া। অথচ জোবেদা বেগমের আবেদনে বর্তমান ঠিকানা দেয়া ছিল তবকপুর ইউনিয়নে। জোবেদার দেয়া চেয়ারম্যানের সার্টিফিকেট বদল করে এবং আবেদন পত্রে কাটাছেড়া করে, ঠিকানা বদলিয়ে জোবেদাকে ভূয়া প্রমান করানো হয়েছে সমাজ সেবার তদন্ত রিপোর্টে। সঠিক তদন্ত হলে থলের বিড়াল বেড়িয়ে পড়বে।

উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা মোঃ লুৎফর রহমান জানান, আমি দাখিলকৃত কাগজপত্র ও ভাতাভোগী মফিজুল ইসলামের স্বাক্ষীদের স্বাক্ষ্য প্রমানের ভিত্তিতে তদন্ত রিপোর্ট দিয়েছি। আসলে জোবেদার পক্ষে কোন ভাল লোক সাহায্য করেনি কিংবা স্বাক্ষ্য দেয়নি। আবারও পূণরায় তদন্ত হলে আর তদন্তের দায়িত্ব আমার দপ্তরে আসলে আমি বিষয়টি ভালভাবেই তদন্ত করে দেখবো বলে জানিয়েছেন তিনি।

অভিযোগ পাওয়ার কথা স্বীকার করে উপজেলা নির্বাহী অফিসার নয়ন কুমার সাহা জানান, আমি বিষয়টি নিয়ে তথ্য অনুসন্ধান করছি। উপরের নির্দেশনা পেলেই নতুনভাবে যাচাই-বাছাই করে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা খুঁজে বের করা হবে।

রিফাত

×