ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ০২ মে ২০২৫, ১৯ বৈশাখ ১৪৩২

স্মৃতি ধূসর চাঁদশীর তিন জমিদার বাড়ি

এক গ্রামে ছিলেন তিনজন জমিদার, ছিল না কোনো বিরোধ

খোকন আহম্মেদ হীরা, বরিশাল

প্রকাশিত: ০৭:৫৫, ২ মে ২০২৫

এক গ্রামে ছিলেন তিনজন জমিদার, ছিল না কোনো বিরোধ

কালের স্রোতে হারিয়ে যাচ্ছে বরিশালের গৌরনদী উপজেলার চাঁদশী গ্রামের জমিদার অন্বিকা চরন গুহ, কেদারনাথ বসু ও অন্যদা বসুর সকল ঐতিহাসিক নিদর্শন। দখলকারীরা ক্রমেই নিশ্চিহ্ন করে দিচ্ছে জমিদারদের পুরোনো সব ঐতিহ্যকে।

প্রবীণ ব্যক্তিদের সাথে আলাপকালে একই গ্রামের তিন জমিদারের প্রভাব-প্রতিপত্তির কথা শোনা গেলেও তাদের অসংখ্য স্মৃতি আজ বিলীন হয়ে গেছে। দখল হয়ে গেছে তাদের বসতবাড়ি, দালান-কোঠাসহ যাবতীয় সহায় সম্পত্তি।

চাঁদশী গ্রামের প্রবীণ ব্যক্তিদের সাথে আলাপকালে জানা গেছে, ১৯৪৮ সালে দেশ বিভাগের পর জমিদাররা দেশত্যাগ করে ভারতে চলে যান। পরবর্তীতে তারা আর ফিরে আসেননি। এ সুযোগে স্থানীয় কতিপয় প্রভাবশালী ব্যক্তি জাল কাগজপত্র তৈরি করে জমিদারদের সহায় সম্পত্তি দখল করে নিয়েছেন।

তারা নিজেদের স্বার্থে জমিদার বাড়ির পূজামণ্ডপ, সমাধি মন্দির ও দালান কোঠা ভেঙে নিশ্চিহ্ন করে দেয়। একইসাথে নিশ্চিহ্ন করে ফেলে জমিদার বাড়ির সকল ঐতিহাসিক নিদর্শন।

জমিদার অন্বিকা চরন গুহ :

উত্তর চাঁদশী গ্রামের প্রয়াত জমিদার অন্বিকা চরন গুহের বাড়িতে গিয়ে দেখা গেছে, জমিদারের সমাধির নিচের অংশটি দখলদাররা ভেঙে ফেলেছে। সমাধির ইট-খোয়া দিয়েই মাত্র ৪/৫ গজ দূরত্বে তৈরি করা হয়েছে একটি শৌচাগার। শ্বেত পাথরের তৈরি কারুকার্য খচিত পঞ্চরত্ন নামে এ সমাধিটি নির্মিত হয়েছিল বাংলা ১৩১৮ সালে। প্রায় ৩৫ ফুট সু-উচ্চ এ সমাধি মন্দিরের উপরিভাগে রয়েছে চারটি গম্বুজ।

১৩০১ সালে জমিদার অন্বিকা চরন গুহ মৃত্যুবরণ করেন। তিনি বাড়ির সম্মুখভাগে খনন করিয়েছিলেন বিশাল দীঘি। ওই দীঘিটি গুহ বাড়ির দীঘি নামে এলাকায় ব্যাপক পরিচিত। দীঘির উত্তর ও দক্ষিণ পাড়ে রয়েছে শানবাঁধানো বিশাল ঘাটলা।

প্রায় ১১ একর জমির ওপর জমিদার অন্বিকা চরন গুহের বাড়ি। ওই বাড়িতে ছোট-বড় বিভিন্ন আকারে ছয়টি পুকুর রয়েছে। জমিদার অন্বিকা চরন গুহ থাকতেন দোতলা ভবনে। বাড়িতে ছিল জমিদারের দাওয়াখানা ও দুর্গা মন্দির। বাড়ির আশপাশে বাদ্যকর, নাপিত, ধোপা ও পাইক-পেয়াদারা থাকতেন। জমিদার বাড়িটি বারো মাসেই বিভিন্ন অনুষ্ঠানে মুখরিত থাকত। অনুষ্ঠানের আগেই পঞ্চরত্নের ওপরে বসে ঢ্যাড়া পিটিয়ে এলাকার লোকজনদের দাওয়াত দেওয়া হতো।

সূত্রমতে, অন্বিকা চরন গুহের চার ছেলে ছিল। তারা হলেন—রাইচরন গুহ, বিমল গুহ, কালি প্রসন্ন গুহ ও নলিনী গুহ। বিমল গুহ ছিলেন জেলা জজ। জমিদার অন্বিকা চরন গুহের বাড়িটি স্থানীয় প্রভাবশালী আয়নুল হক ও তার বড় ভাই আবদুল হক ভুয়া কাগজপত্র তৈরি করে দখল করে নিয়েছেন।

দখলদারদের পরিবারের সাথে আলাপ করে জানা গেছে, আয়নুল হকের পিতা রিয়াজ উদ্দিন ছিলেন গ্রাম্য মোড়ল। তিনি নিলামে ক্রয় করে ওই সম্পত্তির মালিক হয়েছেন। ওই বাড়ির ৪ একর ৮ শতক সম্পত্তির দাবিদার চাঁদশী হাই স্কুল। জমি নিয়ে দখলদার পরিবারের সাথে চাঁদশী স্কুলের মামলা চলমান রয়েছে।

জমিদার কেদারনাথ বসু :

জমিদার অন্বিকা চরন গুহের বাড়ির উত্তর পাশে মাত্র কয়েক শ গজ দূরত্বে জমিদার কেদারনাথ বসুর বাড়ি। দোতলা ভবনে জমিদার কেদারনাথ থাকতেন। কারুকার্য খচিত ভবনের দেয়ালের চুনকাম অনেক আগেই খসে পড়েছে। বাড়ির পূর্ব পাশে বউঠাকুরানীর দীঘি। দীঘির দক্ষিণ পাড়ে পাকা ওয়াল ঘেরা শানবাঁধানো ঘাটলা।

এলাকার প্রবীণ ব্যক্তিরা জানিয়েছেন, জমিদার তার নিজের স্ত্রী কাদম্বিনী বসু মজুমদারের নামে দীঘিটি খনন করেছিলেন। কেদারনাথ তার বাবার নামে প্রতিষ্ঠা করেছেন চাঁদশী ঈশ্বরচন্দ্র বসু মাধ্যমিক বিদ্যালয়। ১৯৪৮ সালে তিনি দেশত্যাগ করেন। ওই স্ট্রেটের কেয়ারটেকার ছিলেন জিতেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী। বর্তমানে ওই বাড়িতে তার চার ছেলে বসবাস করছেন।

জিতেন্দ্রনাথের ছেলে অজিত কুমার (৭০) জানিয়েছেন, জমিদার কেদারনাথের বাড়িতে তিনখানা দুর্গাপূজা হতো। এছাড়াও বিভিন্ন সময়ে পূজা উপলক্ষে জমিদার বাড়িতে নাচ, গান ও যাত্রানুষ্ঠানে মুখর থাকত। জমিদার কেদারনাথের এক ছেলে ছিল। তার নাম কালিদাস বসু। তিনি ভারতে চলে যাওয়ার পর মারা গেছেন।

তাদের জমিদারী চলত বিল্লগ্রাম, বাশাইল, ধানডোবা ও চাঁদশী এলাকায়। খাজনা আদায়ের জন্য তাদের বিভিন্নস্থানে কাচারী ছিল। জমিদার গুহ পরিবার ও বসু পরিবার চাঁদশী হাটের মালিক ছিলেন, কিন্তু জমিদারী নিলামে ওঠার কারণে সবকিছুই বেহাত হয়ে গেছে।

জমিদার অন্যদা বসু :

জমিদার কেদারনাথ বসুর বাড়ির পূর্ব পাশেই আরেক জমিদার অন্যদা বসুর বাড়ি। বর্তমানে ওই বাড়িতে বসবাস করছেন জমিদার অন্যদা বসুর নাতি (মুকুন্দনাথ বসুর ছেলে) তপন বসু। এ বাড়িটি দারোগা বাড়ি নামে পরিচিত। তপন বসু একাই আট একরের জমিদার বাড়ির বিশাল অট্টালিকায় বসবাস করছেন। ভবনটির বেহাল দশা, তাই তিনি কিছু অংশ ভেঙে ফেলেছেন। এ বাড়ির রাধাকৃষ্ণের বিশাল মন্দিরটি এখনও সবার দৃষ্টি কাড়ে।

তপন বসু বলেন, ১৯৪৮ সালে দেশ বিভাগের পর তার দাদু (ঠাকুরদাদা) জমিদার অন্যদা বসু ভারতে গিয়ে আর ফিরে আসেননি। ১৯৭১ সালে পাকবাহিনী এ বাড়িতে হামলা চালিয়ে মন্দির ও তাদের দালানের ব্যাপক ক্ষতি সাধন করে।

ওই সময় তাদের হামলার কবল থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য পাশ্ববর্তী রাংতার ক্যাতনার বিলে পালাতে গিয়ে তার ছোট ভাই স্বপন বসু, বোন শেফালী ও জুথিকা বসু গুলিবিদ্ধ হয়ে একইসাথে শহীদ হন। বাড়ির লোকজন ওই সময় সহদর তিন শহীদকে বউঠাকুরানীর দীঘির পাড়ে মাটি চাপা দিয়ে রাখেন। শহীদ স্বপন বসু তখন ছিল ঢাকা মেডিকেল কলেজের প্রথম বর্ষের ছাত্র আর শেফালী ও জুথিকা ছিল চাঁদশী স্কুলের দশম শ্রেণির ছাত্রী। জমিদারের নাতি তপন বসু ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা। তাই তাদের বাড়িতে স্থানীয় রাজাকারদের ইশারায় পাকসেনারা হামলা চালিয়ে ব্যাপক লুটপাট করে।

তপন বসু ক্ষোভের সাথে বলেন, পাকসেনাদের হাতে তার তিন সহদর শহীদ হওয়া সত্ত্বেও আজও তাদের শহীদ পরিবার হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি। এমনকি তার নামও অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি মুক্তিযোদ্ধার তালিকায়।

চাঁদশী গ্রামের তিন জমিদার বাড়ির আশপাশ ঘুরে দেখা গেছে জমিদারদের নানা স্মৃতি। প্রত্যেক জমিদার বাড়িতে প্রবেশের জন্য রয়েছে আলাদা রাস্তা ও খাল।

এলাকার প্রবীণ ব্যক্তিদের সাথে আলাপকালে জানা গেছে, তিনজন জমিদার একই গ্রামে বসবাস করে তাদের জমিদারী পরিচালনা করলেও তাদের মধ্যে ছিল না কোনো বিরোধ, ছিল সুসম্পর্ক।

১৯১৫ সালে কেদারনাথ বসু চাঁদশী স্কুল প্রতিষ্ঠা করার সময় তৎকালীন গুহ বংশের জমিদার তাকে সার্বিক সহায়তা প্রদান করেছিলেন। ১৯২৪ সালে গুহ বংশের জমিদারের উপহার স্বরূপ প্রদানকৃত একটি কাঠের আলমারি আজও চাঁদশী স্কুলে স্মৃতি বহন করছে। কালের বিবর্তনে ও দখলকারীদের উদাসীনতায় আজ ক্রমেই বিলীন হয়ে যাচ্ছে চাঁদশীর তিন জমিদারের সকল স্মৃতি।

আফরোজা

×

শীর্ষ সংবাদ:

যেই সরকার জনগণের ভোটে নির্বাচিত হবে তারা জনগণের কাছে দায়বদ্ধ থাকবে: আমীর খসরু
জামায়াত নেতারা রাজাকার হলে পাকিস্তানে গাড়ি বাড়ি থাকতো : শামীম সাঈদী
এনসিপির সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত সম্পৃক্ততা নেই- উমামা ফাতেমা
‘বাংলাদেশি’ সন্দেহে আটকদের অধিকাংশই ভারতীয় মুসলমান
ইয়েমেনে হামলা চালিয়েই সাগরে ডুবে গেল মার্কিন সর্বাধুনিক যুদ্ধবিমান
জামিন পেলেননা তারেক রহমানের খালাতো ভাই তুহিন
লন্ডনে আজ আর্সেনাল পিএসজি মহারণ
১৭ অভিনয়শিল্পীর নামে মামলা, তালিকায় আছেন নুসরাত ফারিয়া-অপু বিশ্বাস-ভাবনাসহ অনেকেই
১০০ টাকা মূল্যমানের প্রাইজবন্ডের ১১৯তম ড্র অনুষ্ঠিত হবে আগামীকাল
স্বর্ণের দাম, রেকর্ড উচ্চতা থেকে পতনের পথে
কুমিল্লায় পুলিশ-সেনাবাহিনীর চাকরির নামে প্রতারণা: দালালসহ ১৩ জন গ্রেফতার
১২ বছর বয়সী ছেলে শিক্ষার্থীকে বলাৎকারের অভিযোগে ৩ মাদ্রাসা শিক্ষক গ্রেফতার