ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ০৩ মে ২০২৪, ১৯ বৈশাখ ১৪৩১

থানায় মামলা ॥ অভিযুক্তের হেফাজত থেকে অস্ত্র ও গুলি উদ্ধার

মনসুর আলী মেডিক্যাল কলেজে দ্বিতীয় দিনেও বিক্ষোভ

স্টাফ রিপোর্টার, সিরাজগঞ্জ

প্রকাশিত: ০০:০৬, ৬ মার্চ ২০২৪

মনসুর আলী মেডিক্যাল কলেজে দ্বিতীয় দিনেও বিক্ষোভ

সিরাজগঞ্জে মনসুর আলী মেডিক্যাল কলেজে ছাত্রকে গুলি করার প্রতিবাদে মঙ্গলবার শিক্ষার্থীরা মানববন্ধন

শহীদ এম মনসুর আলী সরকারি মেডিক্যাল কলেজের ক্লাস রুমে শিক্ষকের গুলিতে ছাত্র আহত হবার ঘটনায় দ্বিতীয় দিন মঙ্গলবারও কলেজ ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীরা ক্লাস বর্জন করে বিক্ষোভ মিছিল ও অবস্থান কর্মসূচি পালন করেছে। সকাল থেকেই শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। মেডিক্যাল কলেজের ইতিহাসে এমন কলঙ্কময় ঘটনার দ্রুত বিচার, ক্যাম্পাসে নিরাপত্তা, অভিযুক্ত শিক্ষক (প্রভাষক) রায়হান শরিফের বিএমডিসি সনদ বাতিলসহ পাঁচ দফা দাবি নিয়ে ইন্টার্ন চিকিৎসক পরিষদের নেতৃত্বে সাধারণ শিক্ষার্থী ক্লাস বর্জন করে রাস্তায় নেমে আসে।

ক্যাম্পাসের সামনে সড়ক বন্ধ করে প্রায় ঘণ্টাব্যাপী বিক্ষোভ ও অবস্থান কর্মসূচি পালন করেছে। এ সময় সড়কে যানজটেরও সৃষ্টি হয়। দুর্ভোগে পড়ে যাত্রীরা পরে কলেজ অধ্যক্ষের সঙ্গে কথা বলে শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাসে ফিরে যায়। এ সময় পুলিশও ক্যাম্পাসে শান্তিপূর্ণ পরিবেশ ফিরিয়ে আনার জন্য কাজ করেছে। তার বিরুদ্ধে হত্যাচেষ্টা এবং অবৈধ অস্ত্র রাখার অভিযোগে দুটি মামলা হয়েছে।
সিরাজগঞ্জ সদর আসন থেকে নির্বাচিত জাতীয় সংসদ সদস্য ড. জান্নাত আরা হেনরীর কাছে শিক্ষার্থীরা প্লাকার্ড উঁচিয়ে সেøাগান দিয়ে অভিযুক্ত শিক্ষক রায়হান শরিফের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেছেন। এ ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে সোমবার রাতেই মেডিক্যাল কলেজের একাডেমিক কাউন্সিলের জরুরি বৈঠক ডেকে পরিস্থিতি পর্যালোচনা করা হয়েছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (প্রশাসন) অধ্যাপক ডা. বায়েজীদ খুরশীদ রিয়াজকে আহ্বায়ক করে তিন সদস্য বিশিষ্ট তদন্ত কমিটি করা হয়েছে। কমিটির অন্য দুই সদস্য হলেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (চিকিৎসা শিক্ষা) অধ্যাপক মহিউদ্দিন মাতুব্বর এবং স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগের উপসচিব মোহাম্মদ মোহসীন উদ্দিন। তদন্ত কমিটি মঙ্গলবার ঘটনাস্থলে পৌঁছে তদন্ত শেষে আবার বিকেলেই ঢাকায় ফিরে গেছেন।  
শিক্ষার্থীদের ভয়ভীতি প্রদর্শন, ছাত্রীদের উত্ত্যক্ত করা, অস্ত্র নিয়ে কলেজ ক্যাম্পাসে প্রবেশসহ নানা অভিযোগ রয়েছে শিক্ষক ডা. রায়হান শরিফের বিরুদ্ধে। তার বিরুদ্ধে বারবার অভিযোগ এবং তাকে বদলির চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন কলেজ প্রশাসন।
কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী শ্রেয়া ঘোষ, দীপক বর্মণ, ইমামুল হাসান ছাব্বিরসহ আরও অনেকেই অভিযুক্ত শিক্ষক (প্রভাষক) রায়হান শরিফের ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ, ক্লাসে আগ্নেয়াস্ত্র নেওয়া, রাতে হোস্টেলে ঢুকে গান বাজনা করা মাদকসেবনসহ নানা অভিযোগ তুলে ধরেছেন। তিনি প্রায় নেশাগ্রস্ত থাকেন বলেও শিক্ষার্থীরা জানায়।

ছাত্রীদেরও উত্ত্যক্ত করার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। এ সব অভিযোগ কলেজের অধ্যক্ষকে বারংবার জানানো সত্ত্বেও কোনো ব্যবস্থা নেননি। শিক্ষার্থীরা বলেন, শিক্ষক রায়হান শরিফ উগ্র মস্তিষ্কের মানুষ। সোমবার বিকেলে তিনি শ্রেণিকক্ষে এসে শিক্ষার্থীদের ভাইভা নিচ্ছিলেন। এ সময় আমার একটি পোষা পাখি আছে- এ কথা বলেই তার ব্যাগ থেকে পিস্তল বের করেন। পিস্তল দেখিয়ে বলেন, এটাই আমার ‘পোষা পাখি।’ পিস্তলটি তাক করেই গুলি করে তমালের ডান পায়ের উরুতে।

আরেক শিক্ষার্থী লাবিবার কানের পাশ দিয়ে যায়। তার কানও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। দুজনই মেডিক্যাল কলেজে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। মেডিক্যাল কলেজ ক্যাম্পাসে বেলা ১১টায় ড. জান্নাত আরা হেনরী এমপি সাংবাদিকদের বলেছেন তাঁর নির্বাচনী এলাকায় এমন কলঙ্কময় ঘটনা সত্যিই দুঃখজনক, তিনি মর্মাহত। শিক্ষার্থীদের আশ্বস্ত করে তিনি বলেন ঘটনার তদন্ত শুরু হয়েছে।

সন্ত্রাসী কাজ করে, শিক্ষার পরিবেশ নষ্ট করে কোনো অপরাধী ছাড় পাবে না। শাস্তি তাকে পেতেই হবে। শিক্ষার্থীরা আগামী দিনের ভবিষ্যৎ উল্লেখ করে তাদের নিজ নিজ ক্লাসে ফিরে যাবার আহ্বান জানান তিনি।
মেডিক্যাল কলেজের প্রিন্সিপ্যাল অধ্যাপক ডা. আমিরুল হোসেন চৌধুরী সাংবাদিকদের বলেছেন সোমবার রাতেই একাডেমিক কাউন্সিলের জরুরি বৈঠক ডেকে পরিস্থিতি পর্যালোচনা করা হয়েছে। একাডেমিক কাউন্সল থেকে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। তাছাড়াও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (প্রশাসন) অধ্যাপক ডা. বায়েজীদ খুরশীদ রিয়াজকে আহ্বায়ক করে তিন সদস্য বিশিষ্ট তদন্ত কমিটি করা হয়েছে। কমিটির তদন্ত রিপোর্ট নিয়ে মন্ত্রণালয় চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে বলেও তিনি জানান। তিনি শিক্ষার্থীদের  কাছ থেকে এ ঘটনার আগে কোনো লিখিত বা মৌখিক আভিযোগ পাননি বলেও তিনি জানান।
এদিকে অভিযুক্ত শিক্ষক (প্রভাষক) রায়হান শরিফের নামে আহত শিক্ষার্থীর বাবা বগুড়া শহরের নাটাইপাড়া মহল্লার মো. আব্দুল্লাহ আল আমিন তার ছেলেকে হত্যার উদ্দেশ্যে ডান পায়ের উরুতে গুলি করার অভিযোগ এনে সিরাজগঞ্জ সদর থানায় মামলা করেছেন।

জেলার গোয়েন্দা পুলিশের উপপরির্দশক ওয়াদুদ আলী বাদী হয়ে অবৈধ অস্ত্র রাখা এবং তা ব্যবহারের অভিযোগ এনে আরও একটি মামলা দায়ের করেছেন। পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের কাছে মামলার তদন্তভার দেওয়া হয়েছে বলে সিরাজগঞ্জ সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সিরাজুল ইসলাম সাংবাদিকদের জানিয়েছেন। 
অভিযুক্তের হেফাজত থেকে অস্ত্র ও গুলি উদ্ধার ॥ স্টাফ রিপোর্টার, সিরাজগঞ্জ শহীদ এম মনসুর আলী সরকারি মেডিক্যাল কলেজের ক্লাসরুমে ছাত্রকে গুলি করে আহত করার ঘটনার অভিযুক্ত শিক্ষক (প্রভাষক) ডা. রায়হান শরিফের হেফাজত থেকে গোয়েন্দা পুলিশ সেভেন পয়েন্ট ফাইভ সিক্স বোরের অত্যাধুনিক দুটি বিদেশী পিস্তল, ৮১টি গুলি, চারটি ম্যাগাজিন ও ১২টি বিদেশী চাকু উদ্ধার করেছে। ডিবি পুলিশ জানায়, অস্ত্রের প্রতি তার বিশেষ আকর্ষণ ছিল।

মঙ্গলবার সকাল সাড়ে ১০টার দিকে জেলা গোয়েন্দা শাখার (ডিবি) ওসি জুলহাজ উদ্দীন এ তথ্য নিশ্চিত করেন। রায়হান শরিফ ওই কলেজের কমিউনিটি মেডিসিন বিভাগের শিক্ষক। তবে তিনি ফরেনসিক বিভাগের শিক্ষার্থীদের পড়াতেন। 
ওসি আরও জানান, গুলিবিদ্ধ শিক্ষার্থী আরাফাত আমিনের (তমাল) বাবা বগুড়া শহরের নাটাইপাড়া ধানসিঁড়ি এলাকার আবদুল্লাহ আল আমিনের করা মামলায় শিক্ষক রায়হান শরিফকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে। তাকে গ্রেপ্তারের পর তার মুঠোফোন ঘেঁটে ইন্টারনেট থেকে ডাউনলোড করা অত্যাধুনিক বিদেশী পিস্তলের বহু ছবি পাওয়া গেছে। আরও অস্ত্র আছে কি না, খোঁজ নিতে তাকে নিয়ে তার বিএ কলেজ রোডের প্রফেসর গার্ডেনের বাসায় অভিযান চালানো হয়। তবে ওই বাসা থেকে নতুন কোনো অস্ত্র উদ্ধার হয়নি।
এই কর্মকর্তা বলেন, শিক্ষার্থীর পায়ে গুলি করার ঘটনায় সোমবারই ডা. রায়হান শরিফকে আটক করা হয়। তখন প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে তিনি স্বীকার করেন, একটি বিদেশী পিস্তল তিনি লাখ টাকায় কিনেছিলেন। অস্ত্রের প্রতি তার বিশেষ আকর্ষণ থেকেই তিনি কিনেছিলেন বলে জানিয়েছে।
ইন্টারনেটে বিদেশী পিস্তলের ছবি দেখলেই ডাউনলোড করে রাখতেন। এরপর বিদেশী অস্ত্র কেনার দিকে ঝুঁকে পড়েন। রায়হান শরিফের মুঠোফোনের হোয়াটস অ্যাপে দেখা গেছে, একজন চিকিৎসক তার কাছে জানতে চেয়েছিলেন তিনি কিসের ব্যবসা করেন। জবাবে তিনি লিখেছেন, অস্ত্র কেনাবেচার ব্যবসা।
সিরাজগঞ্জ সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সিরাজুল ইসলাম বলেন, রায়হান শরিফের বিরুদ্ধে সোমবার রাত ১২টার পর থানায় দুটি মামলা হয়েছে। একটি মামলার বাদী গুলিবিদ্ধ শিক্ষার্থী আরাফাত আমিনের বাবা আবদুল্লাহ আল আমিন। এ মামলায় তিনি তার ছেলেকে গুলি করে হত্যাচেষ্টা ও ভয়ভীতি দেখানোর অভিযোগ এনেছেন।

এ ছাড়া সিরাজগঞ্জ ডিবির উপ-পরিদর্শক ওয়াদুদ আলী বাদী হয়ে অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ আইনে ডা. রায়হান শরিফের বিরুদ্ধে আরেকটি মামলা করেছেন। দুপুরে এই শিক্ষককে রিমান্ড চেয়ে আদালতে পাঠানো হয়েছে। এ রিপোর্টাটি লেখা (বিকেল ৫টা পর্যন্ত আদালতের কোনো আদেশ পাওয়ায় যায়নি বলে ডিবির ওসি নিশ্চিত করেছেন।

×