ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ০৩ মে ২০২৪, ১৯ বৈশাখ ১৪৩১

আজ যুক্ত হচ্ছে জাতীয় গ্রিডে, দিনে উৎপাদন সক্ষমতা ২০ কোটি ঘনফুট

সম্ভাবনার ভোলার গ্যাস

স্বপ্না চক্রবর্তী

প্রকাশিত: ২৩:৩৮, ২০ ডিসেম্বর ২০২৩

সম্ভাবনার ভোলার গ্যাস

দেশের ক্রমবর্ধমান জ্বালানির চাহিদা মেটাতে সম্ভাবনা দ্বীপ জেলা ভোলার গ্যাস

দেশের ক্রমবর্ধমান জ্বালানির চাহিদা মেটাতে সম্ভাবনা দ্বীপ জেলা ভোলার গ্যাস। মজুত ২ ট্রিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের মধ্যে এই অঞ্চলের ৯ কূপ থেকে দৈনিক উৎপাদন সক্ষমতা ২০ কোটি ঘনফুট গ্যাস। কিন্তু উৎপাদন সক্ষমতা থাকার পরও শুধু পাইপলাইন না থাকার কারণে এতদিন এই অঞ্চলের গ্যাস জাতীয় গ্রিডে যোগ করা যাচ্ছিল না। তবে আজ বৃহস্পতিবার শেষ হচ্ছে এই প্রতিবন্ধকতা। এই প্রাকৃতিক গ্যাসকে সিএনজিতে (কম্প্রেসড ন্যাচারাল গ্যাস) রূপান্তর করে আনার প্রক্রিয়া শুরু হচ্ছে আজ। এতদিন মোট উৎপাদন ক্ষমতার মাত্র ৮০ থেকে ৮৫ ঘনফুট গ্যাস স্থানীয় চাহিদা মেটাতে ব্যবহার হলেও এখন থেকে তা জাতীয় চাহিদা মেটাতেও কাজে লাগবে। 
বাংলাদেশ তেল, গ্যাস ও খনিজসম্পদ করপোরেশন (পেট্রোবাংলা) বলছে, দেশে এখন দৈনিক গ্যাসের চাহিদা ৩৩০০ মিলিয়ন ঘনফুট। আর এর বিপরীতে সরবরাহ করা হচ্ছে ২৭০০ মিলিয়ন ঘনফুটের মতো। সে হিসাবে প্রতিদিন গ্যাসের ঘাটতি থাকছে ৫০০ মিলিয়ন ঘনফুট। এদিকে গ্যাসের অভাবে শিল্প কারখানা ও বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর উৎপাদনও ব্যাহত হচ্ছে। ফলে গত বছরের শেষ থেকে লোডশেডিং করে গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো বন্ধ রাখা হয়। পরে এলএনজি আমদানি সাপেক্ষে এগুলো চালু হলেও চাহিদার তুলনায় তা ছিল সীমিত।

এমন অবস্থায় ভোলার গ্যাস কিছুটা হলেও চাহিদা মেটাতে পারত উল্লেখ করে বিশেষজ্ঞরা বলছেন উৎপাদন সক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও শুধু আনার উপায় না থাকার কারণে জাতীয় সম্পদ এ রকম অব্যবহৃত থাকবে তা মানা যায় না। তাই সরকারের প্রতি তাদের আহ্বান ছিল যত দ্রুত সম্ভব এ গ্যাসকে জাতীয় গ্রিডে আনতে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেওয়ার জন্য। এরই ধারাবাহিকতায় সম্প্রতি ভোলার গ্যাস আনার আনুষ্ঠানিক প্রক্রিয়া শুরু হচ্ছে আজ। 
জ্বালানি বিভাগ সূত্রে জানা যায়, তরল গ্যাস (কম্প্রেসড ন্যাচারাল গ্যাস) আকারে আনবে ইন্ট্রাকো রিফুয়েলিং স্টেশন পিএলসি। ভোলা থেকে সিলিন্ডারে করে আনা গ্যাস তিতাস গ্যাস কোম্পানির গ্রাহকের প্রান্তে সরবরাহের উদ্বোধন হবে আজ। যে প্রক্রিয়াটি বাস্তবায়ন করবে সুন্দরবন গ্যাস কোম্পানি লিমিটেড।
সুন্দরবন গ্যাস কোম্পানি লিমিটেডের মহাব্যবস্থাপক প্রদীপ রঞ্জন কুণ্ডু জানান, সিএনজি হচ্ছে প্রাকৃতিক গ্যাসের আরেক রূপ যা ওজনে বাতাসের থেকেও হাল্কা। চাপের দ্বারা সঙ্কুচিত করে, তরল পরিণত করে ট্যাঙ্কে জমা করা যায়। ভোলা থেকে সিলিন্ডারে করে এনে গ্রাহকের প্রান্তে আবার পূর্বের অবস্থায় (১৫ পিএসআই) করে গ্রাহককে দেওয়া হবে। এ জন্য নির্ধারিত গ্রাহক প্রান্তেও আরসি (রেগুলেটিং কন্ট্রোল ইউনিট) স্থাপন করা হয়েছে। তিনি বলেন, প্রথমত দৈনিক ৫ মিলিয়ন করে পরিবহন করবে ইন্ট্রাকো। তবে কোন পথ দিয়ে যাবে, কোন গ্রাহককে দেওয়া হবে সেসব বিষয়ে কোনো তথ্য দেননি তিনি। 
এদিকে ইন্ট্রাকো রিফুয়েলিং স্টেশন পিএলসি ব্যবস্থাপনা পরিচালক রিয়াদ আলী সাংবাদিকদের বলেন, আমরা ইতোমধ্যে সফল পরীক্ষা সম্পন্ন করেছি। বৃস্পতিবার (আজ) থেকে আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনের প্রস্তুতি নিয়েছি। এরপর থেকে ধারাবাহিকভাবে আসতে থাকবে। প্রথম গ্যাস দেওয়া হচ্ছে গ্রাফিক্স টেক্সটাইল লিমিটেডকে।
এর আগে, চলতি বছরের ২১ মে সুন্দরবন গ্যাস কোম্পানি লিমিটেড ও ইন্ট্রাকো রিফুয়েলিং স্টেশন পিএলসি চুক্তি স্বাক্ষর করে। চুক্তির আওতায় ভোলার উদ্বৃত্ত ২৫ মিলিয়ন ঘনফুট (দৈনিক) গ্যাস সিএনজি আকারে পরিবহন করে তিতাস গ্যাসের আওতাধীন এলাকায় সরবরাহ করবে কোম্পানিটি। 
দামের বিষয়ে জ্বালানি বিভাগ এর আগে এক বিজ্ঞপ্তিতে জানায়, বর্তমান বৈশ্বিক জ্বালানি পরিস্থিতিতে দেশে বিদ্যুৎসহ শিল্প কারখানায় গ্যাসের সংকট নিরসনে ভোলা অঞ্চলের উদ্বৃত্ত গ্যাসে সর্বোত্তম ব্যবহার করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। এরই অংশ হিসেবে সুন্দরবন গ্যাস কোম্পানি লিমিটেড (এসজিসিএল)-এর তত্ত্বাবধানে ইন্ট্রাকো রিফুয়েলিং স্টেশন লিমিটেডের মাধ্যমে গ্যাস কম্প্রেসড করে নিয়ে এসে তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড (টিজিটিডিসিএল) এর আওতাধীন এলাকার শিল্প প্রতিষ্ঠানের গ্রাহকদের সরবরাহ করা হবে। এক্ষেত্রে ভোক্তা পর্যায়ে প্রতি ঘনমিটার গ্যাসের মূল্য হবে ৪৭.৬০ টাকা। এর মধ্যে উদ্যোক্তা প্রতিষ্ঠানের চার্জ ৩০.৫০ টাকা, ফিড গ্যাসের মূল্য ১৭ টাকা এবং ডিমান্ড চার্জ ০.১০ টাকা অন্তর্ভুক্ত থাকবে। 
এসব বিষয় নিয়ে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম এক্সপ্লোরেশন অ্যান্ড প্রোডাকশন কোম্পানি লিমিটেডের (বাপেক্স) ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ শোয়াইব জনকণ্ঠকে বলেন, ভোলার মোট ৯টি কূপের মধ্যে শাহবাজপুর গ্যাস ফিল্ডে সর্বোচ্চ উৎপাদন হচ্ছে ১৩০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস। এর মধ্যেমে স্থানীয় চাহিদা মেটাতে ব্যবহৃত হচ্ছে মাত্র ৮০ থেকে ৮৫ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস। বাকিটা উদ্বৃত্ত থেকে যেত। আর ভোলা নর্থের ২ ও ইলিশা-১ এর উৎপাদন সক্ষমতা ৬০ থেকে ৬২ মিলিয়ন হলেও এটি পুরোপুরি অব্যবহৃত ছিল। তাই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় সিএনজি আকারে আনা হবে ভোলার এ উদ্বৃত্ত গ্যাস। সিএনজি আকারে গ্যাস ব্যবহার করতে মূলত ‘ক্যাসকেড’ পদ্ধতির পরিকল্পনা করা হয়েছে।

ক্যাসকেড হচ্ছে উচ্চচাপের গ্যাস সিলিন্ডার স্টোরেজ সিস্টেম, যেখানে অনেকগুলো ছোট ছোট সিলিন্ডার থাকে। কম্প্রেসার দিয়ে সেগুলো রিফিল করে অন্যত্র পরিবহন করা হয়। এরপর সেই গ্যাস বিতরণ কোম্পানির পাইপলাইনে কিংবা সরাসরি শিল্প এলাকায় বিতরণ করা হয়। এতদিন আমরা সিএনজি আকারে গ্যাস সরবরাহের এ পরিকল্পনা কতটুকু বাস্তবসম্মত, ব্যবহার উপযোগী ও বৈশ্বিকভাবে কীভাবে সরবারাহ করা হয় সেসব দিক বিবেচনা করেছি। পেট্রোবাংলাও কাজ করেছে। তারা পর্যালোচনা করে সিদ্ধান্ত নিয়েছে এটি আনা সম্ভব। আর তাই দাম নির্ধারণ প্রক্রিয়া চূড়ান্ত করা হয়েছে। 
সাম্প্রতিক সংকটে দেশীয় কূপ খননসহ ঘাটতি গ্যাসের চাহিদা মেটাতে নানামুখী তৎপরতা শুরু করে জ্বালানি বিভাগ। এই তৎপরতার অংশই এই ভোলার গ্যাস আনার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে জানিয়ে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ জনকণ্ঠকে বলেন, দ্বীপ জেলা ভোলায় যে কয়টি গ্যাসক্ষেত্র রয়েছে, সেগুলোর বর্তমান দৈনিক উৎপাদন সক্ষমতা প্রায় ২০০ মিলিয়ন ঘনফুট। স্থানীয় চাহিদা মেটানোর পরেও ৭০ থেকে ৮০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস অব্যবহৃত থেকে যায়। যা পাইপলাইন না থাকার কারণে ভোলার বাইরে নেওয়া সম্ভব হয়নি এতদিন।

এখন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী নির্দেশ দিয়েছেন এই গ্যাস আনার জন্য। তাই আমরা চেষ্টা করছি এটি আনার। যেহেতু আমাদের পাইপলাইন নেই তাই এখনি পুরো গ্যাস আনা যাবে না। আপাতত ২৫ মিলিয়ন ঘনফুটের বেশি গ্যাস আসবে না। তবে আমরা পাইপলাইন তৈরির কাজ শুরু করব শীঘ্রই। এটি হলে ভোলা থেকে উৎপাদিত সব গ্যাসই জাতীয় গ্রিডে আসবে।

×