ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ২৮ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

খাগড়াছড়ি জেলা

নির্বাচনে বড় ফ্যাক্টর ইউপিডিএফ

জীতেন বড়ুয়া, খাগড়াছড়ি

প্রকাশিত: ০০:২৯, ১৮ অক্টোবর ২০২৩

নির্বাচনে বড় ফ্যাক্টর ইউপিডিএফ

পাহাড়ের রাজনীতিতে রয়েছে এক জটিল সমীকরণ

পাহাড়ের রাজনীতিতে রয়েছে এক জটিল সমীকরণ। আর এ সমীকরণের মধ্যেই ২৯৮নং খাগড়াছড়ির সংসদীয় আসনে আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতি চলছে। জমে উঠেছে নির্বাচনী রাজনীতি। আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে ইতোমধ্যে এই আসনের ভোটের রাজনীতি চাঙ্গা হয়ে উঠেছে। শেষ পর্যন্ত কে হবেন আসনটির পরবর্তী কর্ণধার, তা নিয়ে প্রতিদিনই চায়ের কাপে ঝড় উঠছে।
পাহাড় বিস্তৃত নৈস্বর্গিক উপত্যকায় ঘেরা ৯টি উপজেলা নিয়ে গঠিত খাগড়াছড়ি জেলায় সংসদীয় আসন একটিই। পার্বত্য এই জেলায় মোট জনসংখ্যা ৫ লাখ ২৫ হাজার ৬৬৪ জন। এরমধ্যে মোট ভোটার হচ্ছে ৪ লাখ ৭৬ হাজার ১১৭ জন। এরমধ্যে পুরুষ ভোটার ২ লাখ ৪৪ হাজার ৭৪২ এবং মহিলা ভোটার ২ লাখ ৩১ হাজার ৩৭৫ জন। 
দেশের অন্যান্য জেলা থেকে পার্বত্য এলাকার হিসাব-নিকাশ বরাবরই আলাদা। ভিন্ন বাস্তবতার কারণে এখানকার রাজনৈতিক সমীকরণ বেশ জটিল।

সমতলে লড়াইটা আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলেও পার্বত্য এলাকায় তা নয়। এখানে আঞ্চলিক সংগঠনগুলোরও বেশ প্রভাব রয়েছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা বলছেন, বিএনপি নির্বাচনে না এলে খাগড়াছড়িতে নির্বাচনের বড় ফ্যাক্টর হবে আঞ্চলিক সংগঠন প্রসীত বিকাশ খীসা নেতৃত্বাধীন ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ)। তাই কোন দলের প্রার্থী বিজয়ী হবেন, তা অনেকটা নির্ভর করবে আঞ্চলিক দলটির প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ সমর্থনের ওপর। পরিসংখ্যান বলছে, ১৯৭০ সালে তিন পার্বত্য জেলা মিলে ২টি আসন ছিল। সে সময় পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা নির্বাচিত হয়েছিলেন।

১৯৭৯ সালে আসনটিতে জয়লাভ করেন জাসদ (আ স ম আবদুর রব) প্রার্থী উপেন্দ্র লাল চাকমা। ১৯৮৬ ও ১৯৮৮ সালে জাতীয় পার্টি (এরশাদ) প্রার্থী এ কে এম আলিম উল্ল্যাহ, ১৯৯১ ও ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ প্রার্থী কল্পরঞ্জন চাকমা, ১৯৯৬ ও ২০০১ সালে বিএনপি প্রার্থী আব্দুল ওয়াদুদ ভূঁইয়া, ২০০৮ সালে যতীন্দ্র লাল ত্রিপুরা এবং ২০১৪ ও ২০১৮ সালে আওয়ামী লীগ প্রার্থী কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরা বিজয়ী হন।
বর্তমানে এই আসনের সংসদ সদস্য আওয়ামী লীগের কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরা। এবারও তার ওপরই আস্থা রাখতে চান দলটির স্থানীয় নেতা-কর্মীরা। আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সামনের নির্বাচনেও কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরাকে দলের মনোনয়ন দেওয়া হবে, এটা প্রায় নিশ্চিত। এর আগে দুই মেয়াদে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন তিনি।
জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্মলেন্দু চৌধুরী বলেন, মনোনয়ন দেওয়ার এখতিয়ার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার। তবে এমপি কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরার ওপরই আমাদের ভরসা। তার কোনো বিকল্প নেই।
একই সুরে কথা বলেছেন জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আশুতোষ চাকমা। তিনি বলেন, বর্তমান এমপির নেতৃত্বে খাগড়াছড়িতে ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে। এলাকার মানুষের সঙ্গে তার ভালো যোগাযোগ রয়েছে। আমি মনে করি, তাকে মনোনয়ন দিলেই আওয়ামী লীগ খাগড়াছড়ির এই আসনটিতে আবারও জয়ী হবে।
তবে একাদশ সংসদ নির্বাচনের মতো দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনেও নৌকার মনোনয়ন চাইবেন জেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ও জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি কংজরী চৌধুরী। তিনি বলেন, ‘আমি এবারও দলের মনোনয়ন চাইব। দল মনোনয়ন দিলে নির্বাচন করব। না দিলে দলীয় সিদ্ধান্ত মেনে নেব।’
এ ছাড়া আওয়ামী লীগ থেকে সম্ভাব্য প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন পেতে এখন থেকেই যারা দৌড়ঝাঁপ করছেন তাদের মধ্যে রয়েছেন- সংরক্ষিত মহিলা সংসদ সদস্য বাসন্তী চাকমা, আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা রন বিক্রম ত্রিপুরা, তারই সহোদর সাবেক পার্বত্য মন্ত্রণালয়ের সচিব নব বিক্রম কিশোর ত্রিপুরা, জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি এবং পানছড়ি কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ সমীর দত্ত চাকমা, কেন্দ্রীয় উপ-কমিটির সদস্য ভবেশ্বর রোয়াজা নিকি ও সাবেক সংসদ সদস্য যতীন্দ্র লাল ত্রিপুরা।
সম্ভাব্য প্রার্থী হিসেবে কেন্দ্রীয় পর্যায়ে দৌঁড়ঝাপের পাশাপাশি তারা নানা জনসংযোগ কার্যক্রম চালাচ্ছেন। এ ছাড়া আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেতে নানাভাবে তদবির ও অনেকেই তৃণমূলের বঞ্চিত নেতাকর্মীদের এক করার জন্য নানা কৌশলে কাজ করে চলেছেন।
সম্প্রতি এক বক্তব্যে কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরা এমপি বলেন, ‘মনোনয়নের বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত।’
অন্যদিকে, খাগড়াছড়ি আসনে বিএনপি অনেকটাই সুসংগঠিত। কয়েকদিন আগেও প্রকাশ্যে ছোটখাটো গ্রুপিং দেখা গেলেও ইদানীং তা নেই। ওয়াদুদ ভূঁইয়ার নেতৃত্বে বিএনপি এখন গোছানো দল। এমনকি আগামী সংসদ নির্বাচনের জন্য প্রস্তুতিও নিয়ে রেখেছে দলটির নেতারা।
বিএনপির স্থানীয় নেতা-কর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জেলা বিএনপির সভাপতি ওয়াদুদ ভূঁইয়াই দলের একক প্রার্থী। তার বিপক্ষে বিএনপিতে আর শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী নেই। বিশেষ ক্ষমতা আইনে দুর্নীতি মামলায় সাজার কারণে ২০০৮ ও ২০১৮ সালের নির্বাচনে প্রার্থী হতে পারেননি সাবেক সংসদ সদস্য ওয়াদুদ ভূঁইয়া। ২০০৮ সালের সংসদ নির্বাচনে বিএনপি জোটের প্রার্থী ছিলেন জেলা বিএনপির তৎকালীন সহ-সভাপতি সমীরণ দেওয়ান। ২০১৪ সালে বিএনপি নির্বাচনে অংশ নেয়নি। সবশেষ ২০১৮ সালে বিএনপির মনোনয়ন পান ওয়াদুদ ভূঁইয়ার ভাতিজা ফরহাদ ভূঁইয়া। 
আসন্ন সংসদ নির্বাচনেও ধানের শীষের মনোনয়ন চাইতে পারেন কেন্দ্রীয় বিএনপির কার্যনির্বাহী সদস্য সমীরণ দেওয়ান ও ফরহাদ ভূঁইয়া। অবশ্য মামলা জটিলতায় দল থেকে ওয়াদুদ ভূঁইয়া মনোনয়ন না পেলেও তার কাছের কেউ মনোনয়ন পেতে পারে বলে মনে করছেন অনেকে।
তবে সম্প্রতি এক বক্তব্যে জেলা বিএনপির সভাপতি ওয়াদুদ ভূঁইয়া জানিয়েছেন, ‘নিরপেক্ষ সরকার ছাড়া বর্তমান সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচনে যাবে না বিএনপি। সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হলে শুধু খাগড়াছড়ি নয়, সারাদেশে বিএনপির বিজয় সুনিশ্চিত। বিএনপি নির্বাচনে অংশ নিলে প্রার্থী কে হচ্ছেন সেটি সময়ই বলে দেবে।’
খাগড়াছড়িতে জাতীয় পার্টির অবস্থান তেমনটা সুসংহত না হলেও নির্বাচনে বরাবরই প্রার্থী দেয় তারা। ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচনে লাঙ্গল প্রতীকের প্রার্থী হয়ে হেরেছিলেন জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির প্রেসিডিয়াম সদস্য সোলায়মান আলম শেঠ। সুযোগ পেলেই সোলায়মান শেঠ খাগড়াছড়ি ছুটে আসেন। ঈদ ও বিভিন্ন পার্বণে জেলার বিভিন্ন স্থানে দরিদ্রদের মাঝে শাড়ি, লুঙ্গি ও কম্বল বিতরণ করতে দেখা যায়। এ ছাড়াও প্রার্থী হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে জেলা জাতীয় পার্টির সভাপতি মনিন্দ্র লাল ত্রিপুরার। তিনি সাবেক জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান।
এদিকে, খাগড়াছড়িতে পাহাড়ি ভোটারের সংখ্যা বেশি হওয়ায় ইউপিডিএফ নির্বাচনে বড় প্রতিদ্বন্দ্বী। দূরবর্তী ও দুর্গম এলাকায় বিপুল ভোটার থাকলেও সেসব স্থানে আওয়ামী লীগ বা বিএনপির প্রভাব কম। ফলে ভোটের ব্যবধান গড়ে দেবে দুর্গম পাহাড়ি-অধ্যুষিত কেন্দ্রগুলো। তাই আগামী নির্বাচনে ইউপিডিএফ যে তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবে, সেই বিষয়ে দ্বিধা নেই। বিগত সংসদ নির্বাচনেও ইউপিডিএফ বিপুল ভোট পেয়েছে। তবে সুষ্ঠু নির্বাচন হলে এই দলের প্রার্থীকে জয়ের সম্ভাব্য তালিকা থেকে বাদ রাখাটা কঠিন।
সংগঠনটির জেলা সংগঠক অংগ্য মারমা বলেন, ‘দলের যেহেতু নিবন্ধন নেই, সে ক্ষেত্রে আমরা স্বতন্ত্রভাবে নির্বাচন করব। পাহাড়িদের অধিকারের কথা বলার জন্য, সংসদে যাওয়ার জন্য আমরা নির্বাচন করব। তবে এখনো আমরা প্রার্থী চূড়ান্ত করিনি।’
অপরদিকে, পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (এম এন লারমা) ও ইউপিডিএফ গণতান্ত্রিক সামনের নির্বাচনে যোগ্য কোনো প্রার্থী অথবা জাতীয় দলকে সমর্থন জানাতে পারে বলে ইঙ্গিত পাওয়া গেছে। এ ছাড়াও খাগড়াছড়িতে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (মার্কসবাদী), জাসদ (ইনু), ইসলামী ঐক্যজোট, ইসলামী ফ্রন্ট, জাকের পার্টি এবং ন্যাশনাল পিপলস পার্টির (এনপিপি) নির্বাচনে প্রার্থী দেওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

×