ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ০৪ মে ২০২৫, ২১ বৈশাখ ১৪৩২

উন্নয়নের জাদুকরী ছোঁয়া পর্যটন নগরী কক্সবাজারেও

নতুন সুসজ্জিত রাস্তা সড়ক বাতিতে বদলে যাওয়া শহর

মোরসালিন মিজান, কক্সবাজার থেকে ফিরে

প্রকাশিত: ২৩:৪৬, ১৪ অক্টোবর ২০২৩

নতুন সুসজ্জিত রাস্তা সড়ক বাতিতে বদলে যাওয়া শহর

প্রশস্ত পরিচ্ছন্ন সড়ক। আলো ঝলমলে সুসজ্জিত চারপাশ দেখে মনেই হয় না কক্সবাজার শহর

অন্য অনেক পর্যটন এলাকায় একবার বা দুবার গেলেই চলে। অনেকে আর যেতে চান না। তবে সমুদ্রের ডাক উপেক্ষা করা কঠিন। বারবার সেখানে যায় মানুষ। কক্সবাজারে গিয়ে জীবনের ক্লান্তি, হৃদয়ের ভার থেকে মুক্ত হওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু সমুদ্র সৈকত প্রাকৃতিকভাবে প্রস্তুত থাকলেও, শহর কক্সবাজার পর্যটকদের বরণ করে নেওয়ার জন্য খুব একটা প্রস্তুত ছিল না। যে শহরে দেশের সব শহর থেকে ছুটে আসে মানুষজন, সে শরহটি ছন্নছাড়া অবস্থায় ছিল বহুকাল। প্রথম পা রেখে ভীষণ হতাশ হতে হতো। মনেই হতো না এটি অভ্যন্তরীণ পর্যটনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জেলা। শহরের প্রায় সর্বত্রই সরু গলি, ভাঙা নুড়ি কাঁদামাখা রাস্তা দৃশ্যমান হতো। যানজট তো ছিলই, ছিল জলজটও। ফুটপাত ছিল না বললেই চলে। আরও কত দুর্ভোগে পড়তে হতো পর্যটন নগরীতে এসে!   
কিন্তু এখন গল্পটা অন্য। পুরনো সে চেহারা থেকে যথেষ্টই বেরিয়ে এসেছে কক্সবাজার। ক’দিন আগে সরেজমিন শহর ঘুরে রীতিমতো অবাক হতে হলো। যেদিকে পা ফেলা যায়, সেদিকেই নতুন প্রশস্ত রাস্তা। শরতের বৃষ্টিতে ধোয়া রাস্তা একেবারে ঝক্ঝক্ করছিল। সুসজ্জিত সড়ক বিভাজকে চমৎকার বাগান করা হয়েছে। ব্যবস্থা করা হয়েছে আধুনিক সড়কবাতির। টালি বসানো উঁচু ফুটপাত আছে। আছে আরও অনেক কিছু। সব দেখে মনে হয় অন্য এক কক্সবাজার। 
শহরে ঢুকে প্রথমেই দৃষ্টি চলে যায় রাস্তায়। বাস টার্মিনাল বা বিমানবন্দর যেদিক দিয়েই প্রবেশ করা যাক, উন্নত রাস্তা। এ কারণে যাতায়াত আগের তুলনায় অনেক আরামদায়ক হয়েছে। হোটেল মোটেল জোনের কথাই আগে বলতে হয়।

সমুদ্র সৈকত ঘেঁষা সুগন্ধা পয়েন্ট ও সংলগ্ন এলাকাকে হোটেল মোটেল জোন হিসেবে জানেন সবাই। এখানে ৫০০ -এর বেশি হোটেল। এসব হোটেল দেখতে সুন্দর এবং বসবাসের উপযোগী হলেও, আশপাশের রাস্তাঘাট ছিল কাঁচা, নিচু এবং ভাঙাচোরা। সাম্প্রতিককালে এসব রাস্তা নতুন করে নির্মাণ করা হয়েছে। কোথাও ৪০ ফুট প্রশস্ত। কোথাও ৬০ ফুট। কংক্রিটের রাস্তা একটির সঙ্গে অন্যটি চমৎকারভাবে যুক্ত। ফলে যাতায়াত আগের তুলনায় অনেক সহজ হয়েছে। বিশেষ করে সুগন্ধা পয়েন্ট থেকে লাবনী পয়েন্ট পর্যন্ত সড়কটি সমুদ্র সৈকতে যাওয়া আসার জন্য ব্যাপকভাবে ব্যহৃত হয়। এখানে দুই লেনের ৮০ ফুট রাস্তা নতুন করে নির্মাণ করা হয়েছে।

রাস্তা দিয়ে সাবলীলভাবে যানবাহন চলাচল করছে। সমুদ্রস্থানে নামার আরেকটি পয়েন্ট কলাতলী। কলাতলীর রাস্তাটিও আগের তুলনায় অনেক বড় হয়েছে, এখন ২০ ফুট প্রশস্ত। বেশিরভাগ রাস্তার দুই ধারে নতুন ফুটপাত নির্মাণ করা হয়েছে। উঁচু ফুটপাতে লাল- হলুদ টালি বসানো। পর্যটকরা কী যে স্বাচ্ছন্দ্য নিয়ে ব্যবহার করছেন! নিলয় নামের এক পর্যটক এসেছিলেন ঢাকা থেকে। সঙ্গে তার স্ত্রী সাথী। স্ত্রীকে দেখিয়ে তিনি বলেন, আগেও আমরা এসেছি কক্সবাজারে। তখন দেখা যেত সমুদ্র থেকে ওঠে কোথাও আর যাওয়ার জায়গা নেই। এখন শহরটাকে বড় মনে হয়। পরিচ্ছন্ন মনে হয়। তাই দুজনে একটু ঘুরে দেখছি।  
শহরের আরও ভেতরে, অর্থাৎ, প্রান্তিক এলাকাগুলো ঘুরে দেখা যায়, সেখানেও লেগেছে উন্নয়নের হাওয়া। বৌদ্ধ মন্দির সড়কে আগের মতো পানি জমছে না। কক্সবাজার ডিসি কলেজ এলাকাটিও অনেক ভেতরে। সেই অবদি পৌঁছে গেছে নতুন রাস্তা। স্থানীয়দের দেওয়া তথ্য মতে, নুনিয়াপাড়া এলাকার রাস্তা আগে ছিল ১৫ ফুট প্রশস্ত। এখন কোথাও ৪০ ফুট, কোথাও ৬০ ফুট প্রশস্ত করা হয়েছে। তিন রাস্তা মোড় পর্যন্ত এভাবেই গেছে সড়কটি। পেশকারপাড়া এলাকাটিও বেশ ব্যস্ত। এখানেও নতুন করে পাকা সড়ক করা হয়েছে। প্রধান প্রধান রাস্তার মাঝখানে দৃষ্টিনন্দন সড়ক বিভাজক। স্টেনলেজ স্টিল দিয়ে বিভাজকগুলো ঘিরে নেয়া হয়েছে। ভেতরে সবুজ বাগান। 
শহরের আরেক প্রান্তে গিয়ে দেখা যায়, রাস্তার পাশাপাশি একটি বিশাল সেতু নির্মাণ করা হচ্ছে। বেশিরভাগ কাজ এরই মাঝে শেষ হয়ে গেছে। স্থানীয় অধিবাসী ইউসুফ হোসেন জানান, এটি খুরুশকুল সেতু। এটি দিয়ে আরও কম সময়ের মধ্যে চট্টগ্রাম পৌঁছা যাবে।     
শহরের রাতের রূপটিও বেশ মায়াময়। এর অন্যতম কারণ এলইডি লাইট। নতুন প্রায় সব রাস্তায় এলইডি লাইটের ব্যবস্থা করা হয়েছে। এসব বাতি জ্বলে উঠতেই রাতটা উপভোগ্য হয়ে ওঠে। অন্যরকম দেখায় শহরটাকে। মো. হামিদ নামের এক প্রবীণ বলছিলেন, আমরা যারা এত বছর ধরে শহরে বাস করি তারাই এখন কক্সবাজারের অনেক রাস্তা ঘাট চিনতে ভুল করে ফেলি। এই ভুল করার মাঝে ‘তৃপ্তি’ আছে বলেও মন্তব্য করেন তিনি। 
কিন্তু কীভাবে এমন বদলে গেল শহর? কার বা কাদের হাত ধরে এই পরিবর্তন? উত্তর খুঁজতে গিয়ে জানা গেল, সদ্য সাবেক এক মেয়র এই পরিবর্তনের রূপকার। সাবেক এই মেয়রের নাম মুজিবুর রহমান। ২০১৮ সালের ২৫ জুলাই নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে কক্সবাজার পৌরসভার মেয়রের দায়িত্ব পান তিনি। উপকারভোগীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, অল্প সময়ের মধ্যেই বড় স্বপ্ন ও সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা নিয়ে মাঠে নেমেছিলেন মেয়র। করোনাকাল শুরুর আগে আগে শহর বদলে দেওয়ার কাজে হাত দেন তিনি। মহামারির মধ্যেও কাজ একেবারে বন্ধ ছিল না। আর সবকিছু স্বাভাবিক হয়ে এলে কাজের গতি অনেক বাড়িয়ে দেওয়া হয়। ফলে অতি অল্প সময়ের মধ্যে বদলাতে শুরু করে কক্সবাজার। 
এ প্রসঙ্গে কথা বলার জন্য মুজিবুর রহমানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, আমি ব্যক্তিগত জীবনে সুন্দরের পিয়াসী। পরিচ্ছন্নতা পছন্দ করি। কক্সবাজারকে নতুন করে গড়ার ক্ষেত্রে আমার এই বোধ কাজে লেগেছে। শহরটা তো আমার। আমি এই শহরেই জন্মগ্রহণ করেছি। অনেক মানুষ কক্সবাজারে বেড়াতে আসেন। ফিরেও যান। কিন্তু আমি এখানকার মানুষ। মেয়র বড় কথা নয়, আমি এই শহরের সন্তান। শহরটাকে তাই কিছু দেয়ার চেষ্টা করেছি। মেয়রের চেয়ারে বসে কক্সবাজারকে গোটা বাংলাদেশের ড্রইংরুমের মতো করে সাজাতে চেয়েছিলেন জানিয়ে তিনি বলেন, তারই কিছুটা হয়ত এখন পর্যটকদের চোখে পড়ছে। 
তিনি জানান, জিওবি এডিবি সিসিটিএফ ওএফআইডি ওয়ার্ল্ড ব্যাংক ইউএনডিপির মতো সংস্থার অর্থায়নে এসব কাজ করা হয়েছে। ২০১৮ সালে রাস্তা ড্রেন কালভার্ট এবং সড়কবাতি স্থাপনে ১৩টি প্যাকেজ বাস্তবায়ন শুরু করা হয়। ২০১৯-২২ সালে একই রকম ৮টি প্যাকেজ বাস্তবায়ন করা হয়। 
মুজিবুর রহমান জানান, রাস্তা ঘাট করার আগে ড্রেনেজ ব্যবস্থা সচল করতে হয়েছে। ফুটপাতের জন্য জায়গা বের করতে হয়েছে। কিন্তু এসব কাজ করতে গিয়ে বাধার মুখে পড়েননি? এমন প্রশ্নে জোরেসোরেই মাথা নাড়েন তিনি। বলেন, বারবার বাধা এসেছে। রাস্তা বড় করতে গিয়ে অবৈধ দখলদার উচ্ছেদ করতে হয়েছে। এগুলোতো কখনোই সহজ হয় না। আমাকেও অনেক কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে। 
এ পর্যায়ে নিজের পরিবারের প্রসঙ্গ টানেন মুজিবুর রহমান। বলেন, আমাদের পরিবারের প্রায় সবাই কক্সবাজার শহরে বাস করেন। তাদের অনেকের বাসা বাড়ি ভাঙা পড়েছে। আত্মীয়স্বজনেরা ভেবেছিলেন মেয়র আমাদের ঘরের লোক, সুতরাং আমাদের ক্ষতি হবে না। কিন্তু আমি ব্যক্তিগত সম্পর্কের ঊর্ধ্বে ওঠে মানুষের জন্য কাজ করেছি। এ কারণে তাকে অনেক ষড়যন্ত্রের, অনেক ক্ষতির শিকার হতে হয়েছে বলেও জানান তিনি। 
অবশ্য পরিকল্পনা অনুযায়ী সব কাজ শেষ করে যেতে পারেননি মুজিবুর রহমান। এই যেমন লাইট হাউস সড়ক ঘুরে দেখা গেল সেখানে ড্রেন উদ্ধার করা হয়েছে। কিন্তু রাস্তার কাজ অসমাপ্ত। আরও কিছু সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনাই বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি। তাহলে কী এখানেই শেষ? আর এগোবে না ড্রইংরুম বানানোর স্বপ্ন? জানতে চাইলে সাবেক মেয়র একটু রাজনীতির প্রসঙ্গ টানেন। বলেন, আমি আওয়ামী লীগের রাজনীতি করি। কক্সবাজার জেলা আওয়ামী লীগের বর্তমান সাধারণ সম্পাদক। 
আরও বড় পরিসরে কাজ করার স্বার্থে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে চাই। কক্সবাজারের সর্বস্তরের মানুষ আমার কাজের জন্যই আমাকে তাদের পাশে চায়। সংসদ সদস্য নির্বাচিত হলে নতুন একটা শুরু করার ইচ্ছে আছে বলে জানান তিনি। বলেন, তখন আপনারা আবার কক্সবাজারে আসবেন। দেখবেন, আরও কত কাজ আমি করতে পারি। মুজিবুর রহমানের এই স্বপ্ন কক্সবাজারের সবার মধ্যে ছড়িয়ে যাক। সত্যি সত্যি সারাদেশের সুসজ্জিত ড্রইংরুমে পরিণত হোক কক্সবাজার। আমাদেরও তা-ই প্রত্যাশা।

×